অথবা, দর্শন কী কী বিষয় নিয়ে আলােচনা করে বর্ণনা কর।
অথবা, দর্শনের আলোচ্য বিষয় কী?
অথবা, দর্শনের পরিধি আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভ করাই দর্শন। দর্শন সমগ্র সত্তার প্রকাশ, স্বরূপ ও আদর্শ উপলব্ধির চেষ্টাকারী। দর্শন হলাে বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে গােটা সত্তার একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা। এ সত্তার নিজের স্বরূপ, প্রকাশ এবং কোনাে মূল্য আছে কি না- দর্শন এসব বিষয়ের পর্যালােচনা করে থাকে। সুতরাং দর্শন এমন এক অনুশীলনের দিকনির্দেশনা দান করে যার মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রায় সবগুলাে শাখাই অনিবার্যভাবে অন্তর্গত। তাই দর্শন হচ্ছে জীবন ও জগৎকে ঘিরে উদ্ভূত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান।
দর্শনের পরিসর/পরিধি/আলােচ্য বিষয়ঃ কোনাে বিষয়ের পরিসর বলতে আমরা বুঝি সে বিষয়ের আলােচনার বিষয়বস্তুর আওতা বা পরিধি। অর্থাৎ দর্শন যেসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করে, সেগুলােই দর্শনের আলােচনার পরিধি বা বিষয়বস্তু। মানুষের অভিজ্ঞতার এমন কোনাে দিক নেই, যা দর্শনের আলােচনার বাইরে। এদিক থেকে দর্শনের পরিধিকে খুব ব্যাপক বলা যায়। যেসব বিষয় নিয়ে দর্শনের আলােচনার ক্ষেত্র বিস্তৃত সেগুলােকে মােটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
১. বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology)
২. তত্ত্ববিদ্যা (Ontology)
৩. মনােদর্শন (Philosophy of mind)
৪. জ্ঞানবিদ্যা (Epistemology)
৫. মূল্যবিদ্যা বা মূল্যসম্পর্কীয় দর্শন (Axiology)।
নিম্নে এগুলােকে একটি ছকের সাহায্যে দেখানাে হলাে:
(১) বিশ্বতত্ত্ব (cosmology): বিশ্বতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Cosmology’। শব্দটি গ্রিক Kosmos থেকে উদ্ভত হয়েছে। ‘Kosmos’ শব্দটির অর্থ সুশৃঙ্খল বিশ্বজগৎ। দর্শনের এই শাখায় বিশ্বজগতের পরিদৃশ্যমান দিকের অনুসন্ধান করা হয়। দর্শনের এই শাখা রূপবিজ্ঞান বা জগদর্শন নামেও আখ্যায়িত হয়ে থাকে। বিশ্বজগৎ দেশ-কাল, জড়-প্রাণ, বিশ্বজগতের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ, অর্থাৎ সৃষ্টি, বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে দর্শনের এ শাখা আলােচনা করে।
(২) তত্তবিদ্যা (Ontology): অনেকে তত্ত্ববিদ্যাকে দর্শনের প্রাণস্পন্দন বলে আখ্যায়িত করেন। বিশ্বজগতের প্রকৃত সত্তাসম্পর্কীয় আলােচনাকেই সাধারণত তত্ত্ববিদ্যা বলা হয়ে থাকে। Ontology শব্দটি গ্রিক শব্দ Ontos এবং Logos থেকে উদ্ভূত হয়েছে । ‘Ontos’ শব্দটির অর্থ সত্তা এবং ‘Logos’ শব্দটির অর্থ বিজ্ঞান। তাই Ontology অর্থ হচ্ছে সত্তাসম্পর্কীয় বিজ্ঞান।
(৩) মনােদর্শন (Philosophy of mind): মনােদর্শনে প্রধানত মন বা আত্মার স্বরূপ, দেহ ও মনের সম্পর্ক, ইচ্ছার স্বাধীনতা ও আত্মার অমরত্ম নিয়ে আলােচনা করা হয়। মনােদর্শন সাম্প্রতিককালে দর্শনের একটি বিশিষ্ট শাখা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
(৪) জ্ঞানবিদ্যা (Epistomology): দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বা বিভাগ হলাে জ্ঞানবিদ্যা। দর্শনের যে শাখায় জ্ঞানের উৎপত্তি, সীমা, যথার্থতা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে আলােচনা করা হয় তাকে বলা হয় জ্ঞানবিদ্যা। দর্শন জীব, জগৎ ও ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে আলােচনা করে। কিন্তু তার আগে দার্শনিককে এরূপ জ্ঞানলাভের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে বিচার করে দেখতে হবে। জ্ঞানের উৎস কী, জ্ঞান লাভের উপায় কী, কতটুকু জ্ঞানলাভ সম্ভব, জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয়, যথার্থ জ্ঞানের শর্ত কী কী, জ্ঞানের সীমা কতদুর, জ্ঞানের সত্য-মিথ্যা কিভাবে নিরূপণ করা যায়- জ্ঞানবিদ্যা জ্ঞানসম্পর্কিত এ রকম প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করে।
(৫) মূল্যবিদ্যা বা মূল্যসম্পর্কিত দর্শন (Axiology): মানবসভ্যতার ইতিহাসে দর্শনের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি আলােচনা করলে দেখা যায় যে, দর্শনের অন্যতম কাজ হচ্ছে মানবসভ্যতার প্রকৃত মঙ্গলের পথ নির্দেশ করা। আর সে হিসেবে বিশ্বতত্ত্ব, তত্ত্ববিদ্যা, মনােদর্শন, জ্ঞানবিদ্যার চুলচেরা আলােচনা এবং সাম্প্রতিককালের ভাষা বিশ্লেষণকারীদের যৌক্তিক বিশ্লেষণপদ্ধতি সবই ক্ষুন্ন হবে। যদি না এ আলােচনার সাথে মূল্যসম্পর্কিত দার্শনিক আলােচনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই দর্শনের আরেকটি প্রধান শাখা হচ্ছে মূল্যবিদ্যা বা মূলসম্পর্কিত দর্শন। ধর্মীয় মূল্য, নৈতিক মূল্য সৌন্দর্যগত মূল্য ইত্যাদি মূল্য নিয়ে মূল্যবিদ্যায় আলােচনা করা হয়।
অধিবিদ্যা ছাড়া কি ভালাে দর্শন সম্ভবঃ অধিবিদ্যা ছাড়া ভালাে দর্শন সম্ভব কি না, অথবা অধিবিদ্যার সাথে দর্শনের সম্পর্ক কী- এসব প্রশ্নের উত্তর চট করে দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বিস্তারিত আলােচনা দরকার। দর্শন হলাে জগৎ ও জীবনের সামগ্রিক আলােচনা। বিজ্ঞানের আলােচনার পদ্ধতির মতাে দর্শন প্রকতির কোনাে সুনির্দিষ্ট বিভাগ নিয়ে আলােচনা করে না, বরং দর্শন হচ্ছে জগৎ ও জীবনের অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গি।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আপাতঃদৃষ্টিতে অধিবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অধিবিদ্যা দর্শনের একটি শাখা। তা ছাড়া অধিবিদ্যার ব্যাখ্যা একমাত্র দর্শনের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব, অন্য কোনাে বিজ্ঞানের মাধ্যমে নয়। সুতরাং অধিবিদ্যা ছাড়া দর্শন অলােচনা ডানাবিহীন পাখির মতাে অবস্থা।
Leave a comment