অথবা, দর্শনশাস্ত্রে ঈশ্বরের ধারণা কীরূপ?
অথবা, ঈশ্বরের ধারণা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ কর।
অথবা, সমালোচনাসহ ঈশ্বরের ধারণা ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ মানুষ প্রকৃতিগতভাবে উৎসুকপরায়ণ। সবকিছুতে মানুষের কৌতূহল থাকে। আর এ থেকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে । আদিমকালে মানুষ গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, পশু, পাথর, আগুন প্রভৃতির পূজা করত এবং তাদের দেবতা বা ঈশ্বর মনে করত। মধ্যযুগীয় দর্শনে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। মানুষ প্রকৃতির আরাধনা বাদ দিয়ে ঈশ্বরকে পরম আধ্যাত্মিক সত্তা বলে মনে করে। তাই এ যুগে ঈশ্বরের প্রকৃতি নিয়ে মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঠে আসে। আধুনিক যুগে এসে ঈশ্বরের অবস্থান, আকার, প্রকৃতি, ধারণা প্রভৃতি সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের মনে ঈশ্বর সম্পর্কে যে বিভিন্ন ধারণা জন্ম নেয়, তার দার্শনিক তাৎপর্য নিরূপণের জন্যই ঈশ্বরসম্পর্কীয় বিভিন্ন ধারণা নিয়ে দর্শনে আলোচনা করা হয়।
ঈশ্বরের ধারণাঃ প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত ঈশ্বরের ধারণা তথা তার অস্তিত্ব, একত্ব, সরূপ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এ থেকে ঈশ্বরের ধারণাকে দু’টি প্রধান দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যায়। যথা- ক। দার্শনিক ধারণা খ। ধর্মীয় ধারণা। নিম্নে এদের বিস্তারিত দেওয়া হলোঃ
(ক) দার্শনিক ধারণাঃ অধিকাংশ দার্শনিকই সাধারণত ঈশ্বরকে একটি আধ্যাত্মিক সত্তা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তাদেরকে আস্তিক বলে। আর যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় তারা হলো নাস্তিক। নিম্নে আস্তিক ও নাস্তিক দার্শনিকদের, সম্পর্কীয় ধারণাগুলো আলোচনা করা হলোঃ
ঈশ্বর সম্পর্কে আস্তিক দার্শনিকদের ধারণাঃ ঈশ্বর সম্পর্কে কতিপয় আস্তিক দার্শনিকদের ধারণা নিম্নরূপঃ
(১) প্লেটোর ধারণাঃ পাশ্চাত্য দর্শনে ঈশ্বরসম্পর্কীয় আলোচনা প্রথমবারের মতো পুনরায় উপস্থাপিত হয় গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর আলোচনায়। প্লেটোর মতে জগতের পৃথক দু’টি রূপ রয়েছে। যথাঃ ১। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত এবং ২। ধারণার জগত। তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে প্রতিভাসের জগত এবং ধারণা জগতকে প্রকৃত জগত বলেছেন। প্লেটোর মতে, ধারণার জগতের প্রতিটি ধারণাকে প্রাথমিকভাবে একটি সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট ধারণা বলা যায়। একে তিনি কল্যাণের ধারণা বলেছেন। আর এই কল্যাণের ধারণা প্লেটোর দর্শনে ঈশ্বর নামে পরিচিত।
(২) এরিস্টটলের ধারণাঃ ঈশ্বরের ধারণা প্রবর্তনে এরিস্টটলের চিন্তাধারা একটা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে । তিনি ঈশ্বরের ধারণা স্পষ্ট করতে কার্যকারণ নিয়ম বিশ্লেষণ করেন। তার মতে, কারণ চার প্রকার, যথা- ১। আকারগত কারণ, ২। নিমিত্ত কারণ, ৩। উপাদান কারণ ও ৪। পরিণতি কারণ। এরিস্টটল বলেন, ঈশ্বর হলেন জগতের আকারগত কারণ, নিমিত্ত কারণ ও পরিণতি কারণ আর জড় পদার্থ হচ্ছে জগতের উপাদান কারণ, ঈশ্বর আদি কারণ বা আদি প্রবর্তক, যিনি সকল পরিবর্তনের মধ্যে অপরিবর্তন আছেন।
(৩) আনসেলমের ধারণাঃ মধ্যযুগীয় দার্শনিক আনসেলম ঈশ্বর সম্পর্কে বলেন, ধারণা থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। আমরা যে সকল বিষয় চিন্তা করি, তাদের মধ্যে ঈশ্বরসম্পর্কীয় চিন্তায় হচ্ছে সর্বাধিক। অস্তিত্ব পূর্ণাঙ্গতার একটি ধর্ম, তাই ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।
(৪) অগাস্টিনের ধারণাঃ ঈশ্বর সম্পর্কে অগাস্টিনের ধারণা ঈশ্বর জগতের আদি, মধ্য অন্ত এবং ইশ্বরের আদি মধ্য ও অন্ত বলে কিছু নেই। তার মতে, ঈশ্বরই জগতের আকার ও উপাদানের একমাত্র স্রষ্টা। যেহেতু তিনি কালাতীত, তাই তিনি আদি ও অস্তিত্বশীল।
(৫) ডেকাটের ধারণাঃ আধুনিক দার্শনিক ডেকাট মনে করেন, মানুষের মনে তিন ধরনের ধারণা আছে। যথাঃ আগন্তুক, কৃত্রিম ও সহজাত ধারণা। ঈশ্বরের ধারণাই সহজাত ধারণা। অর্থাৎ এই ধারণা মানুষ জন্মের সময় নিয়ে আসে। তার মতে ঈশ্বর একটি পূর্ণসভা, তিনি অসীম, অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পূর্ণাঙ্গ।
(৬) কান্টের ধারণাঃ ঈশ্বরের ধারণাকে কান্ট বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার অতীন্দ্রিয় আদর্শ বলে মনে করেন। তার মতে, ঈশ্বর দয়াবান, ন্যায়বিচারক, পাপ ও পুণ্যের শাস্তি ও পুরস্কারদাতা। তাই একমাত্র নৈতিক মুক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বরের ধারণা লাভ করা যায়।
(৭) স্পিনোজার ধারণাঃ স্পিনোজা ঈশ্বরকে দ্রব্য হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। স্পিনোজার দর্শন দ্রব্য, গুণ ও প্রত্যংশা এ তিন ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এদের মধ্যে দ্রব্য এক ও অদ্বিতীয়। তাই স্পিনোজা এই দ্রব্যকে ঈশ্বরের ধারণায় সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই ঈশ্বরের অসংখ্য গুণ বিদ্যমান।
ঈশ্বর সম্পর্কে নাস্তিক দার্শনিকদের ধারণাঃ যেসব দার্শনিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে যুক্তি দিয়েছেন তারা নাস্তিক বা দাম্ভিক। তাদের ধারণা নিম্নরূপঃ
অধিকাংশ নাস্তিক দার্শনিকের মতে, ঈশ্বর বলতে কিছু নেই। তারা জগত সৃষ্টির পেছেনে ক্রমবিবর্তন বা বিবর্তনবাদের আশ্রয়স্থল। এদের মধ্যে অন্যতম কাল মার্কস তার সমর্থক ছিলেন। এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাওসেতুং প্রমুখ। এরা ঈশ্বরকে অস্বীকার করে জড় এবং জগতের মূল উৎস মনে করেন।
অস্তিবাদী দার্শনিকদের একটি অংশ এ মতবাদে বিশ্বাসী। যেমন ভারতীয় দর্শনে চার্বাক সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। তারা অতীত ও ভবিষ্যৎকে বিশ্বাস করে না। তাই বর্তমানকে উপভোগ করতে বলে।
মার্কসীয় দর্শনের মতে এরাও মনে করেন যে, জড়ই জগতের স্রষ্টা। মৃত্যুর পর কোনো কাজের হিসাব বা বিচার হবে না। এভাবেই তারা ঈশ্বরকে অস্বীকার করতে প্রয়াসী হয়।
(খ) ধর্মীয় ধারণাঃ ধর্মের দিক থেক ঈশ্বরের ধারণা আবার দু’টি মতবাদে বিভক্ত যথাঃ (ক) আস্তিকবাদ ও নাস্তিক বাদ।
১। আস্তিকবাদঃ যারা ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাস করে, তাদের আবার ৩টি ভাগ রয়েছে। যথাঃ
(১) বহু ঈশ্বরবাদঃ প্রাগৈতিহাসিক যুগ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে আদি মানুষ বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির পেছনে বহু অতীন্দ্রিয় দেবতা আছে বলে বিশ্বাস করত। প্রাচীন গ্রিস, মিসর ও ভারতবর্ষে এটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। প্রকৃতিতে যখনই কোনো বিপর্যয় তখনই তারা তাকে দেবতা ভেবে পূজা করত। প্রকৃতির বিভিন্ন কার্যক্রম দেবতারা ভাগ করে পরিচালিত করে বলে মনে করা হতো। এরা নিজ নিজ বিভাগের সকল কিছু করে থাকে। এসব দেবতার মধ্যে রয়েছে- সূর্য দেবতা, সমুদ্র দেবতা প্রভৃতি।
(২) দ্বি-ঈশ্বরবাদঃ ইতিহাসের ক্রমধারায় কালক্রমে বহু ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস মানুষের কমে যায়। ধীরে ধীরে মানুষ বহু ঈশ্বরবাদের ওপর দ্বি-ঈশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মতবাদ অনুসারে একই ঈশ্বর একই সাথে ভালোমন্দ শুভ-অশুভ, কল্যাণ-অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারেন না। আর তাই শুভ, কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য একজন ঈশ্বর ও অকল্যাণ, অশুভ ও অমঙ্গলের জন্য আরেকজন ঈশ্বররের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। অতঃপর এই দ্বি-ঈশ্বরবাদীরা দুটি সত্তা অর্থাৎ শিব ও অশিববাদ এ বিশ্বাসী।
(৩) একেশ্বারবাদঃ ধর্মীয় ইতিহাস বিকাশের সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে একেশ্বরবাদ। একেশ্বরবাদ বহুদেবতা ও দ্বি-ঈশ্বরবাদের ভুল ধারণা ভাঙিয়ে মানুষ এক অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান একা ঈশ্বরের দিকে মানুষকে ধাবিত করতে সফল হয়েছে। মতবাদ অনুসারে ঈশ্বরই সর্বশক্তিমান এবং তিনিই জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। তিনি অসৃষ্ট, অনন্ত ও শাশ্বত। এ মতই বিধৃত হয়েছে কুরআনে। সুরা ইখলাসে বলা হয়েছে, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়- উৎসৃষ্ট এবং সবকিছুর স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। তিনি বিশ্বের সবকিছু প্রতিপালন, পরিপোষণ ও পরিচালনা করেন। এবং আল্লাহর কোনো সমকক্ষ ও শরিক নেই।
সমালোচনাঃ ঈশ্বরের ধারণা হিসাবে বহুঈশ্বরবাদ ও দ্বি-ঈশ্বরবাদের সমালোচনা ব্যাপক হলেও একেশ্বরবাদ যেমন সালোচনা করা হয়নি। বহু ঈশ্বরবাদে দেবতাকে মানুষ হিসাবে কল্পনা করা হয়, প্রকৃত তাদের ওপর বিভিন্ন কাজের দায়ভার চাপানো হয়, যা অযৌক্তিক। তাছাড়া বহু-ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী হলে জগতে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা থাকবে না। তাই একে ধর্মীয় মত বলা যায় না।
দ্বি-ঈশ্বরবাদে দুই ঈশ্বরের বর্ণনা করা হয়েছে। কিছু শুভ ও অশুভ ঘটাতে দু’জন সত্তা লাগে না। ঈশ্বর অশুভ ঘটায়, যাতে শুভের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে। তাই মাঝে মাঝে আমাদের অশুভ ঘটে।
অতঃপর যাই হোক ঈশ্বরের ধারণা হিসাবে একেশ্বরবাদই অধিক যুক্তিসঙ্গত ও সন্তোষজনক।
নাস্তিকবাদঃ নাস্তিকবাদ অনুযায়ী এ জগতের পেছনে বহু, দুই বা এক, কোনো জগতই নেই। এই জগত জাতি ও জড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এবং কালের পরিক্রমাই বিবর্তনের ধারায় এটি বর্তমান রূপ লাভ করেছে। নাস্তি বাদীরা জড়বাদের সমর্থক। তাই এ মতবাদ অনুযায়ী, প্রত্যক্ষণই ভাব লাভের একমাত্র উৎস। যা প্রত্যয়নযোগ্য নয় তা প্রকৃত জ্ঞান নয়। এই নাস্তিকবাদের নানা রূপ রয়েছে। যেমন, নির্বিকার বা গোড়া নাস্তিকবাদ। সংশয়মূলক নাস্তিকবাদ, বিচারমূল নাস্তিকবাদ, ব্যবহারিক নাস্তিকবাদ ইত্যাদি। এরা প্রত্যেকই ঈশ্বরকে অস্বীকার করে। তাদের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে যেহেতু প্রত্যয়নযোগ্য কোনো যুক্তি নেই, তাই ঈশ্বর বলতে কিছু নেই।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ঈশ্বর সম্পর্কে দার্শনিক ও ধর্মীয় ধারণা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ কেউ মনে করেন ঈশ্বর আছেন এবং কারো মতে সেই তবে এটা শুধু দার্শনিকদের মধ্যে নয়, ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যেও বিদ্যমান উভয় পক্ষ যুক্তি প্রমাণের সাপেক্ষে তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস করেছেন। তবে নাস্তিকের চেয়ে আস্তিক্যবাদী যুক্তি ও প্রমাণ ও বেশি এবং আস্তিকের সংখ্যাও জগতে বেশি। তাই বলা যায় ঈশ্বরই এ জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক।
Leave a comment