সূচনা: ইন্দোচিন বলতে আন্নাম, টংকিং এবং কোচিন চিনকে বােঝায়। এই ইন্দোচিনের অধিবাসীরা দীর্ঘদিন বিভিন্ন ইউরােপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে পরাধীন ছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এই অঞ্চল ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পায়।

[1] ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ: উনিশ শতক নাগাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত সমগ্র ইন্দোচিন উপদ্বীপ অঞ্চলটি ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের আওতায় আসে। মূলত উনিশ শতকে তৃতীয় নেপােলিয়ানের আমলেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা ঘটে। এর মধ্যে আবার বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইন্দোচিনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে।

[2] জাপানি সাম্রাজ্যবাদ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির প্রয়ােগ ঘটাতে শুরু করে। এদিকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়কালে জার্মান আক্রমণে ফ্রান্স কোণঠাসা হয়ে পড়লে সেই সুযােগে জাপান সমগ্র ইন্দোচিনে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ইন্দোচিন জাপানি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়। জাপানি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ইন্দোচিনবাসী একজোট হয়। ফলস্বরূপ বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা হাে-চি মিন (নগুয়েন-আই কুয়ােক)-এর নেতৃত্বে ইন্দোচিন, ভিয়েতনাম নামে আত্মপ্রকাশ করে।

[3] ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পট্সডাম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল জাপান ইন্দোচিন থেকে সরে গেলে ইন্দোচিনের উত্তরাঞ্চলে জাতীয়তাবাদী কুয়ােমিং তাং চিন ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্রিটেন দায়িত্ব নেবে। এদিকে হাে-চি-মিন-এর নেতৃত্বে হ্যানয় অঞ্চলে অস্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। হাে-চি-মিন এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম থেকে ব্রিটিশ ও চিনা সামরিক বাহিনী সরে যায়। এই সুযােগে ফ্রান্স পুনরায় ভিয়েতনামে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু হাে-চি-মিন ভিয়েতনামে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন, পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা দেন। অবশেষে ভিয়েতমিন গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ফ্রান্স ভিয়েতমিনের সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় (১৯৪৬ খ্রি., মার্চ)। চুক্তির শর্তানুসারে হাে-চি-মিন এর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে ইন্দোচিন ফেডারেশন এবং ফরাসি ইউনিয়নের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু অচিরেই এই চুক্তিকে অবজ্ঞা করে ফ্রান্স ভিয়েতনামে নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। আমেরিকাও ফ্রান্সের এই উদ্যোগকে সমর্থন করে। এমনকি ব্রিটেনও ইন্দোচিনে ফ্রান্সকে তার পূর্বতন সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সমর্থন জানায়।

[4] মার্কিনি হস্তক্ষেপ

  • ফ্রান্সকে সাহায্য: ইন্দোচিনে হাে-চি-মিন-এর নেতৃত্বাধীন সরকারকে সাম্যবাদী সােভিয়েত ও চিন সমর্থন জানালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে সরাসরি সাহায্য করার নীতি গ্রহণ করে।

  • প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ: জেনেভা সম্মেলন (১৯৫৪ খ্রি., ২০ জুলাই)- এ গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামে দীর্ঘ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটে। তারপরই সাম্যবাদের প্রসার রােধের লক্ষ্যে আমেরিকা সরাসরি ভিয়েতনাম সংকটে অংশগ্রহণ করে। মার্কিন প্রশাসন প্রথমেই দক্ষিণ ভিয়েতনামে বাও-দাই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করে ফ্রান্স বিরােধী ও সাম্যবাদ বিরােধী নেতা ন-দিন-দিয়েমকে।

  • সিয়াটো গঠন: উত্তর ভিয়েতনামে হাে-চি-মিনের সরকারকে চিন ও সােভিয়েত তার সাহায্য অব্যাহত রাখে। পক্ষান্তরে ইন্দোচিন সহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সাম্যবাদ মুক্ত করার লক্ষ্যে মার্কিন উদ্যোগে গঠিত হয় সিয়াটো (SEATO) বা ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া  চুক্তি সংস্থা। এদিকে দিয়েমের মার্কিন তােষণে দক্ষিণ ভিয়েতনামে গণ অসন্তোষ দেখা দেয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরােধিতার লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতীয় মুক্তি মাের্চা (NLF)।

  • মার্কিনদের পরাজয়: দক্ষিণ ভিয়েতনামে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় জেনারেল নগুয়েন ভ্যান থিউ- এর হাতে। ভিয়েতকং বাহিনী ও উত্তর ভিয়েতনামের বাহিনীর মিলিত আক্রমণে মার্কিনিরা পিছু হটে। প্যারিস সম্মেলনে (১৯৭৩ খ্রি., ২৩ জানুয়ারি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং ভিয়েতকং-এর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মার্কিন প্রশাসন তাদের সৈন্য ও পরামর্শদাতাদের ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে নিতে রাজি হয়।

উপসংহার: শেষপর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়। আত্মপ্রকাশ ঘটে সংযুক্ত, স্বাধীন, সার্বভৌম সমাজবাদী ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের।