আলোচ্য বক্তব্যটি বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম সাহিত্যকীর্তি কমলাকান্তের দপ্তর-এর ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত হয়েছে। এখানে বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রবন্ধটিকে রূপকধর্মী করে বিড়ালের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের পক্ষে এক তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ সহযোগে পরিবেশন করেছেন। লেখক বিড়ালকে ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে অঙ্কিত করেছেন। এর মাধ্যমে আমাদের সমাজে ধনী-দরিদ্রের যে গুরুতর বৈসাদৃশ্য রয়েছে তা লেখক কমলাকান্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
কমলাকান্ত তাঁর শয়নঘরে সান্ধ্যনেশায় মগ্ন হয়ে হুঁকা হাতে নিয়ে চারপায়াতে ঝিমোচ্ছিলেন। তখনও তাঁর আহার প্রস্তুত হয়নি। তাঁর নেশাগ্রস্ত মনে নানা ভাবনায় সে বিভোর। এ-নেশাগ্রস্থ ভাবনায় তিনি ভাবছেন যে তিনি যদি নেপোলিয়ন হতেন, তা’হলে হয়তো ওয়াটার্লু যুদ্ধে জয়ী হতেন। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধে (ওয়াটালু) সম্মিলিত ব্রিটিশ ও প্রাশিয়ান বাহিনির ব্রিটিশ সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটনের নিকট পরাজিত হওয়ায় কমলাকান্ত মর্মাহত। এমন সময় তিনি একটি বিড়ালের ডাক শুনতে পান। এখানে এই প্রসঙ্গে তিনি ভাবলেন ব্রিটিশ সেনাপতি ডিউক বুঝি বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে সামনে এসেছেন। পুনরায় বিড়ালের ‘মেও’ ডাক শুনে তিনি ভাবলেন—ডিউক হঠাৎ মার্জার রূপে তাঁর কাছে আফিমের জন্য এসেছেন। কমলাকান্ত তখন নেপোলিয়ান—তাই ঠিক করলেন তাঁর প্রতিপক্ষ ডিউককে আফিম দেবেন না। ঠিক সে সময় আবার ‘মেও’ ডাকে তিনি সচকিত হয়ে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন—এটি একটি বিড়াল মাত্র, ডিউক নন।
প্রসন্ন গোয়ালিনী কমলাকান্তের জন্য যে দুধ রেখেছিল, সেই বিড়াল তার সবটুকু পান করে, ‘মেও’ ডাকে পরম তৃপ্তি লাভ করেছে, তা জানিয়ে দিল। এই ডাকের মাধ্যমে হয়তো কমলাকান্তকে মার্জার জানিয়ে দিচ্ছে যে ‘কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই’। অর্থাৎ পৃথিবীতে চিরকালই একদল মানুষের শ্রমের সুফল ভোগ করছে, তা জানিয়ে দিল। এই ডাকের মাধ্যমে হয়তো কমলাকান্তের মার্জার জানিয়ে দিচ্ছে যে ‘কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খাই কই’। অর্থাৎ পৃথিবীতে চিরকালই একদল মানুষের শ্রমের সুফল ভোগ করছে সুবিধা ভোগী অন্য আরেক দল মানুষ। এখানে বিড়ালের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে কমলাকান্ত ব্যঙ্গ করে দেখাতে চান অসাম্যের বিরুদ্ধে ‘মেও’ ডাকটি প্রতিবাদের প্রতীকি স্বরূপ।
তারপর বিড়াল একাধিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ, তথ্যনিষ্ঠ বক্তব্য যুক্তি সহকারে সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার জন্য ধনীর কাছ থেকে চৌর্যবৃত্তির সাহায্যে ক্ষুধা নিবারণ করার অধিকারের কথা ঘোষণা করছে। পৃথিবীর সমস্ত জীবই যে প্রকৃতির নিবারণ বশীভূত, অর্থাৎ বাঁচার জন্য তাদেরও যে ন্যুনতম খাবার প্রয়োজন—শক্তিমানেরা অনেক সময় সেকথা বিস্মৃত হন। বিড়াল প্রথমেই প্রাণীজগতের সেই ঐক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তারপর বিড়াল নিজের ভঙ্গিতে আত্ম-পক্ষ সমর্থনে তর্ক ও যুক্তির জল ক্রমশ বিস্তার করে চলছে। যেহেতু বিড়াল কমলাকান্তের জন্য রক্ষিত দুধ পান করেছে এবং উপকৃত হয়েছে, সেইহেতু উপকারের ফল কমলাকান্তের অবশ্যই প্রাপ্য। বিড়াল দুধ পান করেছে বলেই বিনা শ্রমে কমলাকান্তের সেই হেতু কিছু পণ্য সঞ্চয় হয়েছে।
কমলাকান্ত বিড়ালের যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে লাঠি নিয়ে তাকে শাস্তি দিতে অগ্রসর হ’লে বিড়াল তাঁকে আরও কথা শুনতে অনুরোধ করে ওর বক্তব্য হচ্ছে যে অভাবই চৌর্যবৃত্তির প্রধান কারণ। যাঁরা সাধু মহাত্মা, তাঁরা চুরি করেন না, কেননা তাঁরা অভুক্ত থাকেন না। তাদের এই প্রয়োজনাতিরিক্ত ধনসঞ্চয়ই গরিবদের অভুক্ত থাকতে বাধ্য করে যার ফলে অভাবগ্রস্ত লোকেরা চুরি করতে বাধ্য হয়। এ বিষয়ে চোরের শাস্তি হ’লে অবাধ ধনসঞ্চয় ও কার্পণ্যের জন্য আপাতত সাধুরও শাস্তি হওয়া উচিত। মানুষ স্বভাবতই তার নিম্নবর্গীয়দের থেকে অপেক্ষাকৃত উচ্চবর্গীদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি ভাবনা সাধারণ মানুষকে সহজেই ভাবিত করে তোলে। অথচ যাদের জন্য ভাবা উচিত তাদের জন্য ভাবে না। অর্থাৎ তেলা মাথায় তেল দেওয়া—বিড়ালের আবেদন যেন মানবিকতাবোধে পরিপূর্ণ। আবার নিজেদের মধ্যে ‘সোহাগের বিড়াল’ উল্লেখে বড়োলোকের বিলাসিতার প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে। এমন কি ধনী পরিবারের অপচয় বৃত্তির প্রতিও কমলাকান্তের দৃষ্টি এসেছে। তাই এ-যুগের সর্বহারা আর তাদের দারিদ্র্যতাকে ভাগ্যের বিড়ম্বনা বলে মানতে রাজি নয় বিড়াল। মানুষের স্বাভাবিক অধিকার নিয়েই এখন তারা বাঁচতে চায়। এখানে যেন নবজাগরণের মানবতাবাদের প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
এ সকল চুক্তি কমলাকান্তের নিকট অসহ্য হয়ে দেখা দিল। তারপর কমলাকান্ত অনেকটা ধমকের সুরে মার্জারকে আসতে বলেন—এখানে বিড়ালের বক্তব্যগুলি সোসিয়ালিস্টিক অর্থাৎ সমাজবিদ্রোহমূলক। তাঁর বক্তব্য আছে—মানুষ যদি তার খুশিমতো ধন সঞ্চয় করতে না পারে এবং তা যদি ভোগ করতে না পারে, তবে কেহই আর ধন সঞ্চয় করবে না; তাতে সমাজেরও ধন বৃদ্ধি হবে না। এবং তার সমর্থনে আরও বলেন যে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা ধনীর ধন বৃদ্ধিকেই সমাজের ধন বৃদ্ধি বলে থাকেন; কিন্তু সমাজতন্ত্রে ভাবিত বিড়াল এখানে তা মানতে রাজি নয়, কারণ ধনীর ধনবৃদ্ধিতে প্রকৃত পক্ষে সমাজের অপামর মানুষের উপকার হয় না। সেখানে দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়—মুষ্টিমেয় ধনিকরাই উপকৃত হয়। তারপর সর্বশেষে বিচারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বিড়াল-কমলাকান্তকে অনুরোধ করেছে যে সে যেন বিড়ালের মতো তিন দিন উপবাস করে তাঁর চুরি করে খেতে প্রবৃত্তি না হয় তাহলে সে মাথা পেতে তাঁর প্রদত্ত শাস্তি অবশ্যই গ্রহণ করবে। অর্থাৎ স্বয়ং কমলাকান্ত অনাহারে থেকে যদি ক্ষুধার প্রবৃত্তি বোধ না করেন তবেই তিনি বিড়ালকে শাসন করতে পারেন।
অবশেষে যুক্তিতর্কে পরাস্ত হয়ে কমলাকান্ত বুঝলেন যে প্রচলিত রীতিনীতি বিরুদ্ধ ভাব বলে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা বিড়ালের সঙ্গে সমঝোতায় আসার চেষ্টা বৃথা। অতঃপর কমলাকান্ত বিড়ালকে কিছু নীতি উপদেশ দিলেন। সর্বশেষে কিছু লোভও দেখালেন ওই সব নীতিবিরুদ্ধ আন্দোলন ত্যাগ করে যেন ধর্মাচরণে মন দেয়। কিন্তু বিড়াল তার আপন মতবাদে অটল থাকবে বলে জানিয়ে প্রস্থান করে।
‘বিড়াল’ প্রবন্ধে উপরোক্ত মন্তব্য বঙ্কিমচন্দ্র সমাজচেতনার এক নতুনতর বোধের জগতে আমাদের উত্তীর্ণ করেছে—এ রোধ হচ্ছে সাম্যবাদের কথা। এই রচনায় চুরি করে দুধ খেতে এসেছে যে বিড়াল সে মূলত সোস্যালিষ্ট সমাজের প্রতিনিধি আর তাকে দুধ থেকে যারা বঞ্চিত করে তারা ধনীক সমাজের প্রতিনিধি। সমাজের ধন-বৈষম্য, বঞ্চিতের ওপর নীতি ধর্মের অসার উপদেশ বর্ষণ এবং তার প্রতিবাদে সমাজতন্ত্রীবাদী বঙ্কিমচন্দ্রের তীব্র প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে “বিড়াল”। সামাজিক ধন-সঞ্চয়ের সুফল যদি সমাজে প্রতিটি ভোগ্য না হয় তবে তা অর্থহীন। বিড়ালের দুধের দাবি সমস্ত সর্বহারাদের ন্যায্য প্রাপ্যের দাবী। পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠে সাম্যবাদের ভাষা পেয়েছে এই বিড়ালের মধ্যে।
Leave a comment