সূচনা: ১৯৬০-এর দশক থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এসময়ে মার্কিন বিদেশনীতিতে যুক্ত হয় এক নতুন বিষয়—তেল কূটনীতি।
প্রথম পর্যায়: বিংশ শতকের সূচনালগ্নে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল পরিমাণ তেলের সন্ধান মেলে। আগে পারস্য উপসাগর ও পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত দেশগুলি মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়া নামে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যভুক্ত আরব দেশগুলি হল—সৌদি আরব, কুয়েত, ইরান, ইরাক, জর্ডন, তুরস্ক, ওমান, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (United Arab Emirates) ইত্যাদি। মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু সংকটের (প্যালেস্টাইন সংকট, আরব-ইজরায়েল সংঘাত প্রভৃতি) সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার কারণে অনেকে সুদান, মিশর, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো (কার্যত উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত) ইত্যাদি দেশগুলিকেও পশ্চিম এশিয়ার দেশ হিসেবে দেখে থাকেন। এরপরেই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির দখলদারি নিয়ে ইউরােপীয় দেশগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
-
ব্রিটেন ও সােভিয়েতের দখলদারি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দখলদারির ক্ষেত্রে প্রথম ছাড়পত্র পায়।। ইরানে গঠিত হয় অ্যাংলাে ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (১৯০৮ খ্রি.)। এ সময়ে রাশিয়াও ইরান থেকে তেল সংগ্রহে আগ্রহ দেখায়। বিদেশি সাহায্যে তেল উত্তোলনের লক্ষ্যে ব্রিটেন ও সােভিয়েতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইরান এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইরানের উত্তরাংশে সােভিয়েত আর দক্ষিণাংশে ব্রিটেন নিজ নিজ দখলদারি কায়েম করে।
-
মার্কিন অংশীদারিত্ব কায়েম: আমেরিকা উপলব্ধি করে তার নিজের সঞ্চিত তেল আগামী দিনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ইতিপূর্বে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত সান রেমাে’চুক্তির তীব্র বিরােধিতা করে আমেরিকা। বেশ কিছুদিন টানাপােড়েনের পর টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে মার্কিনি অংশীদারিত্ব কায়েম হয়।
-
ইরানের সংসদীয় ঘােষণা ও আইন: তেল কূটনীতির প্রশ্নে ইরানের সংসদ বা মজলিস হস্তক্ষেপ করে। মজলিস এক ঘােষণায়। বলে ইরানের মাটি থেকে সমস্ত বিদেশি সৈন্য সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তেলের অধিকার বিষয়ক যাবতীয় আলােচনা স্থগিত থাকবে। এই ঘােষণার পরে ইরানের মজলিস এক আইন পাস করিয়ে তেলের খনিগুলিকে জাতীয়করণ করে নেয় (১৯৫১ খ্রি., ২৪ এপ্রিল)।
দ্বিতীয় পর্যায়
-
মার্কিন প্রতিক্রিয়া: ইরানের সংসদ মজলিস-এর ঘােষণায় ক্ষুদ্ধ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরােধ ঘােষণা করে। পাশাপাশি সুকৌশলে মার্কিন মদতে শাহ মহম্মদ রেজাকে ইরানে ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়। ক্ষমতায় এসে শাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তেলের বিনিময়ে অস্ত্র কেনার চুক্তি করে।
-
ইরান-ইরাক যুদ্ধ: ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইরানে শিয়া নেতা আয়াতুল্লা খােমেইনি-র নেতৃত্বে ইরানে শুরু হয় মার্কিন বিরােধিতা। সূচনা ঘটে শাহ্ মহম্মদ রেজা বিরােধী ইসলামীয় বিপ্লবের। এই পরিস্থিতি মােকাবিলার লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রােনাল্ড রেগান ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধনীতি গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ইরাককে ব্যবহার করেন। মার্কিনি সাহায্য নিয়ে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন ইরান আক্রমণ করেন (১৯৮০ খ্রি., সেপ্টেম্বর)। এই যুদ্ধে সাদ্দাম-বিরােধী অনারব মুসলিমগােষ্ঠী কুর্দদের শহর হালাজার ওপর ইরাক রসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটায়। এতে বহু অনারব মুসলিম ও ইরানি সেনা মারা যায়।
-
কুয়েত যুদ্ধ: ইরান-ইরাক যুদ্ধের ১০ বছর পরে ইরাক কুয়েতের ওপর আক্রমণ চালায়। তাই ইরাক কুয়েত আক্রমণ করার পরেই আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরােধ ঘােষণা করে। বহুদিন ধরে Organisation of Petroleum Exporting Countries বা OPEC নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কমে কুয়েত তেল বিক্রি করেছিল। এতে ইরাকসহ অন্যান্য আরব দেশের ক্ষতি হচ্ছিল। ইরাক চেয়েছিল কুয়েতকে নিয়ন্ত্রণে এনে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি তেল নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ইরাকের এই পদক্ষেপে আমেরিকা প্রমাদ গােনে। আমেরিকা ইরাককে সাবধান করে দিয়ে বলে নির্দিষ্ট সময়কাল (১৯৯১ খ্রি., ১৫ জানুয়ারি)-এর মধ্যে ইরাক কুয়েত ত্যাগ না করলে তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানাে হবে। কিন্তু ইরাক মার্কিনি হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করায় ২৮টি ইউরােপীয় রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে আক্রমণ করে। এই অসম লড়াইয়ের একমাস পরে ইরাক কুয়েত ত্যাগ করে।
-
ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ: নিজের প্রয়ােজনীয় তেলের শতকরা ৫০ ভাগ আমেরিকাকে বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। যার মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ আসত মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ, ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, প্রতিরক্ষা সচিব ডােনাল্ড রামসফেল্ড প্রমুখ প্রত্যেকেই ছিলেন তেলের জগতের অংশীদার। তাই মধ্যপ্রাচ্যের তৈলখনিগুলির মার্কিন এক্তিয়ারভুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের অতিরিক্ত আগ্রহ ছিল। তাই আমেরিকা চেয়েছিল ইরাকের তেলের ভাণ্ডারগুলি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশ পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র মজুত রাখার অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করেন। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর সমরাভিযানের কাছে ইরাক পর্যুদস্ত হয়। সাদ্দাম হুসেন পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। কুয়েত মুক্তি লাভ করে।
Leave a comment