প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার ছােটোগল্পের পটভূমি হল কলকাতা থেকে ত্রিশ মাইল দূরবর্তী ম্যালেরিয়া-মড়কে-শ্মশান হয়ে যাওয়া একটি গ্রাম। জনবিরল এই গ্রাম ও তার আশেপাশের অঞ্চলের প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশ এই গল্পে উঠে এসেছে।

তেলেনাপােতা-নিকটবর্তী বাসস্টপে নেমে দুইবন্ধুসহ গল্পকথক পার্শ্ববর্তী একটি জলার পাশে দাঁড়িয়ে অপূর্ব একটি শব্দ শুনতে পান। সেই শব্দ শুনে রােমান্টিক গল্পকথকের মনে হয় যে, ‘বােবা জঙ্গল থেকে কে যেন অমানুষিক এক কান্না নিঙড়ে বার করছে।’ আসলে সেটি ছিল তাদের নিতে আসা গােরুর গাড়ির শব্দ।

গােরুর গাড়িতে ওঠার পর ঘন অন্ধকার দুর্ভেদ্য জঙ্গলে কথকের মনে হয়েছিল—‘পরিচিত পৃথিবীকে দূরে কোথাও ফেলে এসেছেন। অনুভূতিহীন, কুয়াশাময় এক জগৎ শুধু আপনার চারিধারে। সময় সেখানে স্তন্ধ, স্রোতহীন।’ চলমান দৃশ্যগুলি দেখে কথকের মনে হল, অস্পষ্ট, নির্বাক পাহারাওয়ালার দল যেন মহাকালের সাক্ষী হবার বৃথা আশায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

পরদিন সকালে নিস্তব্ধ পানাপুকুরে মাছ ধরতে বসে মাছরাঙা পাখির মাছ শিকার, সাপের পুকুর সাঁতরানাে, ফড়িংদের পাতলা কাচের মতাে পাখা নাড়িয়ে উড়ে চলা দেখতে দেখতে এবং ঘুঘুপাখির উদাস করা ডাক শুনতে শুনতে ক্রমশ আনমনা হয়ে পড়েন কথক।

তেলেনাপােতার সেই প্রকৃতির সন্তান যামিনীর প্রতিও এক দুর্নিবার আকর্ষণ বােধ করেছিলেন কথক। ক্রমে ক্রমে সেই আকর্ষণ ঘটনা-পরম্পরায় প্রেমে পরিণত হয়। যে কারণেই একসময় হঠাৎই যামিনীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেন। তিনি। কিন্তু তেলেনাপােতা-মােহগ্রস্ত কথক যখন সেই পরিবেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন, তখন তার মনােজগতের আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়।

সুতরাং, যামিনীসহ তেলেনাপােতার প্রাকৃতিক পরিবেশ তেলেনাপােতা আবিষ্কার ছােটোগল্পে গল্পকথকের ওপর নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের কথকই হলেন এই গল্পের নায়ক। গল্পটির মধ্যে তার চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, সেগুলি হল :

রােমান্টিকতা: এই গল্পের কথক প্রাত্যহিক কাজকর্ম ও শহুরে কোলাহল থেকে মুক্তির জন্য কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন এক অখ্যাত গণ্ডগ্রাম তেলেনাপােতার উদ্দেশে। যামিনীর সঙ্গে সাময়িক প্রেমের অনুভূতির পর ফেরার সময় গােরুর গাড়ির একঘেয়ে শব্দকেই উপেক্ষা করে নিজের হৃৎস্পন্দনে তিনি কেবল একটি কথাই শুনতে পান, ‘ফিরে আসব, ফিরে আসব।’

আবেগপ্রবণতা: গল্পকথক হলেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এক ব্যক্তি। তাই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, মণি এবং যামিনীকে স্তম্ভিত করে দিয়ে তিনি মুহূর্তের মধ্যে যামিনীর মাকে যামিনীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেন।

দায়িত্ববােধের অভাব: এই গল্পে গল্পকথককে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বপরায়ণ এক নাগরিক যুবক বলে মনে হলেও শেষে দেখা যায় যে, তেলেনাপােতা থেকে ফিরে আসার পর ম্যালেরিয়া জ্বরে বিপর্যস্ত হয়ে যামিনীর মাকে দেওয়া তাঁর সমস্ত প্রতিশ্রুতিই তিনি ভুলে যান।

বাকপটুতা: ফেরার সময় যামিনী গল্পকথকের কাছে গিয়ে যখন বলে যে, তার বড়শি-বড়শি সব পড়ে রইল, তখন কথক হেসে বলেন যে, সেসব সেখানেই থাকুক। একবার পারেননি বলে, তেলেনাপােতার মাছ কিন্তু মােটেও তাঁকে বারবার ধোঁকা দিতে পারবে না। বাক্পটু ব্যক্তি ছাড়া ইমেজের এমন ব্যবহার কে করতে পারে?

তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পের নায়িকা চরিত্র যামিনী ছিল শয্যাশায়ী, অন্ধ, বিধবা মায়ের সহায়-সম্বলহীনা মেয়ে। পানাপুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে যামিনীর মুখের শান্ত, করুণ গাম্ভীর্য দেখে কথকের মনে হয়েছিল যে, জীবনের সুদীর্ঘ, নির্মম পথ সে পার হয়ে এসেছে। যামিনী চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে উল্লেখ্য সেগুলি হল-

জড়তামুক্ত ব্যবহার: যামিনীর আচরণে গ্রাম্য যুবতীর কোনাে দ্বিধা অথবা অহেতুক লজ্জা বা আড়ষ্টতা লক্ষ করা যায় না। তাই আমরা দেখি যে, ঠিক সময়ে বড়শিতে টান দিতে কথক যখন অসমর্থ হন, তখন যামিনী কলশি কাখে- করে ফেরার সময় ‘চকিত মুহূর্তে একটু যেন দীপ্ত হাসির আভাস’ প্রকাশ করেছিল।

সেবাপরায়ণতা ও দায়িত্ববােধ: যামিনীর মা নিরঞ্জনকে উদ্দেশ করে কথককে যথার্থই বলেছিলেন যে, যামিনীর মতাে মেয়ে হয় না। তেলেনাপােতার শ্মশানভূমিতে যামিনী একাধারে নারী ও পুরুষ হয়ে পরিবারের সব ঝক্কি ঝামেলা অসীম ধৈর্যে নিজের কাঁধে বহন করে নিয়ে চলেছিল।

বিচারবােধ: যামিনীর মধ্যে বিচারবােধ ছিল বলেই, নিরঞ্জন-সংক্রান্ত মনের যন্ত্রণা সে নিজের মধ্যেই চেপে রেখে দেয়। তার একমাত্র সঙ্গিনী মাকেও জানতে দেয় না তাকে শান্তি দিতেই।

তবে গল্পকথকের রােমান্টিক দৃষ্টিতে যামিনী ছিল রূপকথার বন্দিনি রাজকন্যা। অতীতের রহস্যমাখা স্বপ্নলােক থেকে সে যেন কথকের জীবনে ক্ষণিকের জন্য ভেসে ওঠা এক ‘স্বপ্নের বুদবুদ’।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপােতা আবিষ্কার’ ছোট গল্প আমরা বিবাহের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দুটি উদাহরণ পাই। দুটি ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুতি দান করা হয়েছিল এ গল্পের নায়িকা যামিনীকে। বিবাহের প্রতিশ্রুতি দান করে পরে তা ভাঙেন যথাক্রমে নিরঞ্জন নামক এক যুবক এবং এ গল্পের নায়ক, গল্পকথক স্বয়ং।

নিরঞ্জন ছিলেন যামিনীর মায়ের দূর সম্পর্কিত বােনপাে। নিরঞ্জন এবং যামিনীর ছেলেবেলাতেই যামিনীর মা তাদের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে রেখেছিলেন। বড়াে হয়ে ছােটোবেলায় স্থির করা গুরুজনদের বিবাহ-সম্বন্ধের ব্যাপারে তিনি তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। গল্পের ঘটনার চার বছর আগে নিরঞ্জন শেষবার তেলেনাপােতায় এলে যামিনীর মায়ের নাছােড়বান্দা অনুরােধে তিনি যামিনীকে বিয়ে করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। যদিও পরে তিনি অন্য জায়গায় বিয়ে করেন এবং ‘দিব্যি সংসার’ করে চলেন।

অন্যদিকে, কলকাতার ভিড়-ভাট্টায় হাঁপিয়ে-ওঠা গল্পকথক মাছ ধরার উদ্দেশ্যে তেলেনাপােতায় এসে যামিনীর সঙ্গে একটা রােমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বন্ধু মণির কাছে নিরঞ্জনের প্রতিশ্রুতি-ভঙ্গের কাহিনি শুনে কথক নিজে থেকেই মণিবাবুর সঙ্গে যামিনীদের ওপরের ঘরে যান, যামিনীর অন্ধ, বিধবা, বৃদ্ধা মার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে যামিনীর মাকে নিরঞ্জনরূপী কথক জানান যে, যামিনীকে তিনি নিশ্চিতভাবেই বিয়ে করবেন। কিন্তু কলকাতায় ফেরার পরেই ভাগ্যের পরিহাসে তেলেনাপােতার মশাবাহিত ম্যালেরিয়া তাকে শয্যাশায়ী করে দেয়। দীর্ঘদিন পরে সুস্থ হয়ে তিনি অনুভব করেন যে, তেলেনাপােতার স্মৃতি তার হৃদয়ে অস্তমিত এক নক্ষত্রে পরিণত হয়েছে।

সুতরাং, তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পে নিরঞ্জন এবং গল্পকথক—এই দুই প্রতিশ্রুতি-ভঙ্গকারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক তথাকথিত শহুরে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যবিত্ত-মানসিকতার সমালােচনা করেছেন।

“দেশের লােক ভারি নিশ্চিন্ত হল।”—কীভাবে দেশের লােক ভারী নিশ্চিন্ত হল?

“একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা।”- ‘কর্তার ভূত’ রচনা অবলম্বন করে এই ‘অদৃষ্টের চালে চলা’র তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।

“সেই জেলখানার দেয়াল চোখে দেখা যায় না।- সেই জেলখানার বিস্তৃত বিবরণ দাও। সেই জেলখানার কয়েদিদের ঘানি ঘােরানাের কথা আলােচনা করাে।

“শুনে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আর মাসতুতাে-পিসতুততার দল কানে হাত দিয়ে বলে,—কোন্ কথার উত্তরে কী বলে তারা?

“কেননা ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনাে ভাবনাই নেই;”—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।

“অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারও জন্য মাথাব্যথাও নেই।”— কার সম্বন্ধে, কেন লেখক এ কথা বলেছেন?

“শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে।”- আদিম আভিজাত্য’ অনুভব করার কারণ কী?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনায় ‘দেশে যত শিরােমণি-চূড়ামণি’-র বক্তব্য কী ছিল?

“এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে।” কারা, কাদের কাছে খাজনা চেয়েছে? খাজনা দিতে না পারার কারণ কী?

“দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ” -এর সঙ্গে বুড়াে কর্তার কথােপকথন ‘কর্তার ভূত’ অবলম্বনে লেখো এবং রূপকার্থ আলােচনা করাে।

‘ওরে অবােধ, আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই, তােরা ছাড়লেই আমার ছাড়া’—এখানে কে কাদের অবােধ বলেছেন? উক্তিটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“কর্তা বলেন, সেইখানেই তাে ভূত।”- কোন প্রসঙ্গে এবং কেন কর্তা এ কথা বলেছেন?

‘কর্তার ভূত’ রচনায় ওঝা প্রসঙ্গটির তাৎপর্যটি লেখাে।

“সে ভবিষ্যৎ ভ্যাও করে না ম্যাও করে না” -সে ভবিষ্যৎ ভ্যা বা ম্যা করে না কেন?

“কেননা ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেছে”- ওঝাকে ভূতে পেলে কী ক্ষতি হওয়ার কথা লেখক বলেছেন?

‘কর্তার ভূত’- কি নিছক ভূতের গল্প, নাকি রাজনৈতিক রূপক কাহিনি? ব্যাখ্যাসহ লেখাে।

“ভূতের রাজত্বে আর কিছুই না থাক…শান্তি থাকে”- মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করাে।

কেন কিছু দেশবাসীর ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে দ্বিধা জাগল?

‘কর্তার ভূত’-রচনাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করাে।

রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ রচনাটির ভাষাশৈলী তথা রচনাশৈলী পর্যালােচনা করাে।

‘তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।’ -কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের এমন ‘ভয়ংকর সজাগ থাকার কারণ কী?

“কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল।”—কারণটি পর্যালােচনা করাে।

কর্তার ভূত গল্পে যে সামাজিক সত্যের দিকে লেখক নির্দেশ করেছেন তা নিজের ভাষায় লেখাে।

তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পের রচনাশৈলী পর্যালােচনা করাে।

ছােটোগল্প হিসেবে ‘তেলেনাপােতা আবিষ্কার’ রচনাটি কতখানি সার্থক, তা পর্যালােচনা করাে।

তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পের মধ্যে রােমান্টিকতার যে যে বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তা আলােচনা করে রােমান্টিক গল্প হিসেবে এর সার্থকতা বিচার করাে।

তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পে লেখক গল্প বলার ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদ ব্যবহারে যে নতুনত্ব এনেছেন তা আলােচনা করাে।