অষ্টম শতক থেকে ভারতে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান বণিকদের আগমন শুরু হলেও, কিংবা অষ্টম শতকের গোড়ায় ভারতের সিন্ধু অঞ্চলে আরবীয় শাসন সূচিত হলেও, এদেশের ধর্ম বা সামগ্রিক রাজনীতির ওপর তার বিশেষ প্রভাব ছিল না। মুসলমান বণিকরা দক্ষিণ ভারতে যথেষ্ট সমাদৃত হতেন। বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ ছাড়া তাঁরা ভারতীয় কোন বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। অন্যদিকে সিন্ধু অঞ্চলে প্রায় তিন শতক কাল ব্যাপী আরবীয় শাসন জারী থাকলেও, বৃহত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে তার কোন প্রভাব ছিল না। সিন্ধুপ্রদেশের সীমিত ভূখণ্ডের বাইরে আরবরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোন প্রয়াস নেয় নি। অবশিষ্ট ভারতে তখন একাধিক ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তি দাপটের সাথেই রাজত্ব চালাত। শিল্প-সংস্কৃতির দিক থেকে ভারতে আগমনের সূত্রে আরবীয় সংস্কৃতি কিছুটা সমৃদ্ধ হলেও, ভারতের ক্ষেত্রে লক্ষনীয় কোন প্রভাব ছিল না। সাধারণভাবে তুর্কী শাসকদের অধীনে দিল্লী সুলতানী প্রতিষ্ঠার কাল (১২০৬ খ্রিঃ) বা পরবর্তী কালকেও ভারতীয় সংস্কৃতির গতি-ধারায় কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা বা নবযুগের সূচনা বলা যায় না।

স্বভাবতই পশ্চিমী ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গী ও ভারত ইতিহাসের কাল বিভাজনের যৌক্তিকতা বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। হিন্দুযুগ, মুসলিম যুগ এবং ব্রিটিশ যুগ এহেন জাতি-শাসনকাল ভিত্তিক বিভাজন আদৌ যুক্তিসিদ্ধ নয়। একইভাবে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ বা আধুনিক যুগ নামক কাল বিভাজনের মধ্যেও ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রার্থক্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় না। ভারতের ইতিহাসের কাল বিভাজনের ক্ষেত্রে পশ্চিমী ঐতিহাসিকেরা সাধারণভাবে মুসলমান শাসনের আগে পর্যন্ত সময়কে ‘প্রাচীন যুগ’ এবং মুসলমান শাসনকালকে ‘মধ্যযুগ’ নামে চিহ্নিত করেছেন। আবার ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনপর্বকে ‘আধুনিক’ যুগ বলেছেন। এক্ষেত্রে ইউরোপের তথাকথিত অন্ধকারাচ্ছন্ন (সামন্ততান্ত্রিক) মধ্যযুগের সাথে ভারতে তুর্কী-আফগান ও মুঘল শাসনকালকে ‘সমধর্মী’ (identical) রূপে তুলে ধরার প্রবণতা স্পষ্ট। কিন্তু ইতিহাসগতভাবে তা সঠিক নয়। কারণ ভারতে মুসলমান শাসনকালেই নব-নগরায়ণ ঘটেছিল এবং বাণিজ্যিক পুঁজির গুরুত্ব বেড়েছিল। কেউ কেউ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (১৫২৬ খ্রিঃ) পর্যন্ত কালকে মধ্যযুগ বলে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী। আবার কারো কারো মতে, আকবরের সিংহাসনারোহন পর্যন্ত মধ্যযুগকে প্রসারিত করতে চেয়েছেন। তৃতীয় পক্ষ মনে করেন যে, ব্রিটিশের শাসন শুরুর আগে পর্যন্ত ভারতে মধ্যযুগ প্রচলিত ছিল। কালবিভাজন সংক্রান্ত এমত বিতর্কের শেষ নেই। আসলে ইতিহাস হল একটি জাতি, সমাজ বা দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদির ধারাবাহিক উত্তরণ, অবনমন বা পরিবর্তনের বিবরণ। তাই স্কুল কালবিভাজন বিজ্ঞানসম্মত নয়। তবে আলোচনার সুবিধা এবং কালগত বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের জন্য কিছু বিভাজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্রমবিবর্তনের ধারার বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে সময়কালকে বোঝা যেতে পারে। এজন্য চাই সুতর বিভাজন। প্রাক্‌-ইতিহাস, প্রায়-ইতিহাস, বা আদি-মধ্যযুগ, পরবর্তী মধ্যযুগ ইত্যাদি কালপর্ব স্থির করে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তনগুলিকে চিহ্নিত করা সহজ হয়েছে।

দিল্লীতে সুলতানী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ফলেও ভারতের ইতিহাস কোন নতুন যুগে পদার্পণ করেনি; কেবল আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রম বিবর্তনের ধারায় একটি বিশেষ স্তরে উপনীত হয়েছে। ভারতে তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে হিন্দু সংস্কৃতি ও জীবনধারা সর্বপ্রথম এমন একটি বহিঃশক্তির স্থায়ী সান্নিধ্যে আসে, যাদের ধর্মভাবনা, সমাজব্যবস্থা, আচার-আচরণ হিন্দুদের সম্পূর্ণ বিপরীত। এইভাবে একটি বিপরীত সংস্কৃতির (antithesis) সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, আচার-বিচার ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসতে থাকে। ইসলামের সাম্য ভাবনা, জাতিবর্ণ বিমুক্ত সমাজব্যবস্থা, একেশ্বরবাদের গভীরতা ইত্যাদি ভারতের প্রচলিত সমাজ জীবনকে দোলা দেয় এবং নানাক্ষেত্রে মিশ্র সংস্কৃতির গুরুত্ব অনুভূত হতে থাকে। কে. এম. আশরাফ-এর মতে, মুসলিম শাসনের প্রথম পর্বে (তুর্কী-আফগান শাসন) ভারতীয় সংস্কৃতির গঠনাত্মক শক্তিগুলি বিকাশলাভ করেছিল। এই যুগে স্থাপিত বনিয়াদের ওপরেই পরবর্তীকালে মুঘলরা সংস্কৃতির গৌরবময় সৌধ রচনা করেছিলেন।

ইতিহাসচর্চা ও উপাদান :

ইতিহাসের প্রধান ভিত্তি তার উপাদান। আধুনিক কালে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির ফলে ইতিহাসের উপাদানের কোনো অভাব অনুভূত হয় না। কিন্তু প্রাচীনকালে যখন মানুষের সমাজ, সভ্যতা ও অর্থনীতি গঠনমূলক স্তরের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল, তখন ইতিহাসের উপাদানের একান্ত অভাব ছিল। ভারতবর্ষের মতো অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে ইতিহাসচর্চাই তখন গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হত। প্রাচীন সভ্যতার বিকাশভূমি ও সাহিত্যচর্চার প্রাচীনতম কেন্দ্র গ্রিসদেশের পণ্ডিতেরা ভারতীয়দের ইতিহাস-বিমুখতা দেখে একদা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রকাশ্যে। অবশ্য কালের গতিতে সেই অভাব ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। সাধারণভাবে মুসলমানদের অনুপ্রবেশের কাল থেকে ইংরেজদের ক্ষমতাদখলের মধ্যবর্তী কালকে ভারত-ইতিহাসে ‘মধ্যযুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এই পর্বে ভারত-ইতিহাসের বহু লিখিত উপাদান পাওয়া যায়। কারণ, মুসলমান পণ্ডিতেরা যথেষ্ট ইতিহাস সচেতন ছিলেন। তাই আরবদের সিন্ধুদেশ আক্রমণের সময় থেকে পরবর্তীকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে মুসলমান পণ্ডিতেরা নানাভাবে ইতিহাসমূলক উপাদানসমৃদ্ধ গ্রন্থ, কাব্য, সাহিত্য রচনা করে সমকালীন ইতিহাস রচনার কাজকে কিছুটা মসৃণ করেছেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ডওয়েল (Dodwell) লিখেছেন: “The advent of Islam begins a great series of Indian chronicles……… The Muslim chronicles are far superior to our own. (English) medieval chronicles-.”

মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসবিদ্যায় আরবীয় ও পারসিক—এই দুটি ইতিহাস রচনার ঐতিহ্যের প্রতিফলন দেখা যায়। এই দুটি ধারাকে ভিত্তি করেই মূলত মধ্যযুগের লেখকরা ইতিহাস রচনার করণকৌশল ও প্রেরণা গ্রহণ করেছেন। তুর্কি-আফগান যুগে ভারতের ইতিহাসচর্চার দর্শন ও নিয়মবিদ্যার উৎস ছিল আরবীয় ও পারসিক ধারা। তবে এই দুটি ধারার মধ্যে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রভেদ লক্ষণীয়। আরবীয় ইতিহাসবিদ্যার লক্ষ্য ছিল প্রসারিত। এখানে রাজনৈতিক ঘটনাবলি ছাড়াও সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু পারসিক ইতিহাসবিদ্যার পরিধি সংকীর্ণ। এখানে সামগ্রিকভাবে সমকালের বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পেত না। পারসিক লেখকরা প্রধানত শাসকশ্রেণির কার্যকলাপের মধ্যেই ইতিহাসচর্চাকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত বলে মনে করতেন। আরব ঐতিহাসিকেরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে থেকে ইতিহাসচর্চার কাজে লিপ্ত থাকায় তাঁদের সঙ্গে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনার কাজ অনেকটাই সহজ ছিল। কিন্তু পারসিক ঐতিহাসিকেরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য হয়ে জীবনযাপন করায় রাজশক্তির স্তাবকতা করতে বাধ্য হতেন।

ভারতে তুর্কি-আফগান শাসনের প্রথম পর্বের ইতিহাসচর্চায় তুর্কি-আফগান সংস্কৃতির প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। এ যুগের ইতিহাসচর্চায় আরবীয় ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য একান্তই অনুপস্থিত। কারণ এই পর্বের ইতিহাসকাররা বৃত্তিগত কারণে রাজপরিবার বা রাজকীয় দরবারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। দশম শতকের পরবর্তী কালে পশ্চিমদিকে আনাতোলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্বদিকে ভারত ভূখণ্ড পর্যন্ত তুর্কি অভিযান প্রসারিত হলেও; আরবীয় সংস্কৃতির সাথে অপরিচয়ের ফলে ইতিহাসচর্চায় সংকীর্ণতা থেকে যায়। এ যুগে ভারতীয় ইতিহাসবিদ্যা ছিল মূলত ভারতের বাইরে বিকাশমান ইসলামিক ইতিহাসচর্চার প্রতিস্ফুরণ। অধ্যাপক হার্ডি (P. Hardy) ভারতে ত্রয়োদশ শতক থেকে পঞ্চদশ শতকের মধ্যবর্তীকালীন ইতিহাসচর্চাকে ‘মুসলিম ইতিহাসচর্চার ঔপনিবেশিক যুগ’ (‘A colonial period in Indo-Muslim historiography) বলে বর্ণনা করেছেন।

তুর্কি-আফগান যুগে ইন্দো-মুসলিম ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ছিলেন সমাজের সর্বোচ্চতলার মানুষেরা। সুলতান, অভিজাত ও উচ্চ-প্রশাসক গোষ্ঠীর মহত্ত্ব, কৃতিত্ব ও ক্ষমতার বিস্তার, শৌর্যবীর্য ছিল ইতিহাসের মূল উপজীব্য। মুসলিম ইতিহাসচর্চার এই ধারা ‘মনাফিব’ বা ‘ফজাইল’ নামে পরিচিত। শিক্ষামূলক ইতিহাস বা সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ ইতিহাস রচনার দৃষ্টান্ত খুবই সীমিত। আমির খসরু, জিয়াউদ্দিন বারাণী, ইয়াহিয়া-বিন-আহমেদ, সিরহিন্দি প্রমুখের রচনা, ‘ফজাইল’ রচনার শ্রেণিভুক্ত। এঁদের রচনা গদ্যে লিখিত রাজপ্রশস্তিমূলক। কিছুটা ব্যতিক্রমী রচনা পাওয়া যায় ইসামীর ইতিহাসে। তুর্কি-আফগান যুগে ইতিহাসচর্চা প্রেরণাগত ও পদ্ধতিগত দিক থেকে ছিল ভারত বহির্ভূত (extra Indian) একটি ধারণা। ভারতীয় ঐতিহ্যের সাথে তার কোনো মিল ছিল না। প্রধান প্রধান পারসিক ইতিহাসকাররা পয়গম্বর, খলিফা, সুলতান ও উচ্চ-অভিজাতদের জীবনধারা ও কর্মসূচির মধ্যেই ইতিহাসকে আবদ্ধ করে রাখেন। এইচ. আর. গিব (H.R. Gibb) মনে করেন, শিক্ষামূলক ও রচনাশৈলীবিশিষ্ট ভারতীয় ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ইতিহাস লেখা মুঘল আমলে শুরু হয়।

মধ্যযুগের ইতিহাসকাররা মূলত রাজবংশের ইতিহাস লিখেছেন। এঁদের রচনার কেন্দ্রে ছিল রাজপুরুষ ও অভিজাতদের ক্রিয়া-কলাপ, জীবনধারা। সাধারণ মানুষের জীবন-কথা এঁদের রচনায় প্রায় অনুপস্থিত। অধিকাংশ লেখক কোনো-না-কোনো রাজপুরুষের পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য ছিলেন। স্বভাতই পৃষ্ঠপোষক সুলতানের ত্রুটী বা দুর্বলতা তাঁরা এড়িয়ে গেছেন। প্রায় সকলেই ইতিহাসচর্চার শুরুতে ঈশ্বরিক শক্তির অনিবার্যতাকে মেনে নিয়েছেন। ঈশ্বরের ইচ্ছায় মানুষ, সমাজ, রাজনীতির ক্রিয়া-প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী থেকেছেন। ইহজাগতিক ঈশ্বরিক শক্তির প্রতীক হিসেবে পয়গম্বর মহম্মদ এবং প্রথম চারজন খলিফার প্রশংসা তাঁদের কলমে ঝরে পড়েছে। আবার ইতিহাস নির্মাণ করার ক্ষেত্রে তাঁরা নিজ নিজ জীবনের প্রেক্ষাপট দ্বারাও অনেকটা প্রভাবিত হয়েছেন। যেমন, জিয়াউদ্দিন বারানী এবং মিনহাজ-উস্-সিরাজের লিখনপদ্ধতি দৃষ্টিভঙ্গীগত কারণে স্বতন্ত্র্য ছিল। মিনহাজ ছিলেন মধ্য-এশিয়ার মানুষ। সেখানকার রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যর আলোকে তিনি সুলতানীর রাষ্ট্রনীতি ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে বারাণী ছিলেন দিল্লীর মানুষ এবং অভিজাততন্ত্রের সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত একজন অভিজাত। তাই স্থানীয় অভিজ্ঞতা এবং দিল্লীর রাজনীতির টানা পোড়েন তাঁর রচনার প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে।

সুলতানি পর্বের সমকালীন ইতিহাসকারদের রচনার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ড. এস. কে. মুখার্জী লিখেছেন যে, তাঁরা মূলত দু’ধরনের ইতিহাসচর্চা করেছিলেন। একটি ছিল রাজনৈতিক ও ব্যাখ্যামূলক, অপরটি ছিল আংশিক বর্ণনামূলক ও আংশিক ব্যাখ্যামূলক। প্রথম ধারার লেখকরা কেবল ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। ঘটনার কার্য-কারণ ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন নি। অন্য দিকে দ্বিতীয় ধারার লেখকরা ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তবে আধুনিক ইতিহাস চর্চায় তথ্য যাচাই করার মত ব্যাপার সেকালে ছিল না। তথ্য যাচাই করার অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না, কিংবা সুযোগও বিশেষ ছিল না। তাঁর পূর্ব ইতিহাস থেকে তথ্য পেয়েছেন বলে উল্লেখ করলেও তথ্যের বিবরণ দিতে পারেন নি। স্বভাবই ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র সেকালের রচনায় অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল লেখকের (ঐতিহাসিক) ব্যক্তিগত চরিত্র, পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর।

সুলতানি পর্বের শাসকদের অনেকেই ইতিহাসভিত্তিক সাহিত্য রচনায় উৎসাহী ছিলেন। যুদ্ধ বিজয়ের পাশাপাশি ইতিহাসকারদের পৃষ্ঠপোষকতার কাজেও তাঁরা উদার ছিলেন। অবশ্য এই সকল দরবারী ইতিহাস-লেখকদের রচনা সম্পর্কে কিছুটা সতর্কতার প্রয়োজন আছে। কারণ সর্বশক্তিমান শাসকের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য এই সকল ইতিহাসবিদদের রচনায় প্রভুর গুণকীর্তন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। বহুক্ষেত্রেই রাজকীর্তি সম্পর্কে অতিশয়োক্তি ঘটেছে। আবার বহু লেখক ধর্মীয় চিন্তাভাবনা দ্বারা এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে, ইসলামবিরোধী কিংবা ইসলামস্বীকৃত নয় এমন সমস্ত কাজকেই তাঁরা বিরূপভাবে উপস্থিত করেছেন। এই কারণে ড. মহিবুল হাসান তাঁর ‘Historians of Medieval India’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, এই সকল ইতিহাসবিদদের মানসিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আধুনিক পাঠকদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি।

মধ্যযুগের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে অ-মুসলমান লেখকদের রচনাও বিশেষ মূল্যবান। সমসাময়িক শিখ, মারাঠা ও রাজপুত জাতিগোষ্ঠীর লোককথা থেকে তৎকালীন সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির বহু তথ্য পাওয়া যায়। সর্বোপরি ছিল বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ। মধ্যযুগে ভারতে আগত এই সকল বহিরাগত পর্যটক ভারতে অবস্থানকালে তাঁদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলি থেকে সমকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির নানা তথ্য পাওয়া যায়।

মধ্যযুগের সূচনা থেকেই সরকারি দলিলপত্র সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হয়। ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি দলিল-দস্তাবেজ নিঃসন্দেহে খুবই নির্ভরযোগ্য উপাদান। তবে অনুন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থার জন্য মধ্যযুগীয় সরকারি নথিপত্রের, বিশেষত সুলতানি আমলের অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। অবশ্য যেটুকু রক্ষিত হয়েছে, তার ইতিহাসগত মূল্য অপরিসীম।

সুলতানি আমলের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে, সম্ভবত সর্বাধিক সহায়ক তথ্য সরববাহ করেছে সমকালীন ঐতিহাসিকদের রচনাবলি। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা চলে, মূলত এগুলির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে সুলতানি আমল সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের ধ্যানধারণা।

হাসান নিজামী :

মহম্মদ ঘুরির একটি অভিযানের সঙ্গী হিসেবে হাসান নিজামী এদেশে আসেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বাস করেন। ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থে তিনি ১১৯২ থেকে ১২২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের ধারাবাহিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। কুতুবউদ্দিন আইবকের জীবনী ও কার্যাবলি এবং ইলতুৎমিসের আমলের প্রথম দিকের ঘটনাবলি সম্পর্কে এই গ্রন্থটি বিশেষ উপযোগী। সুলতানি আমলের প্রথম পর্বের নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে নিজামী এই ইতিবৃত্তে অকারণ ও অপ্রয়োজনীয় বহু ঘটনাবলি অলংকারবহুল বাক্যবিন্যাসের মাধ্যমে উপস্থিত করেছেন। ফলে এর ইতিহাসমূলক গুরুত্ব কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

মিনহাজ-উস্-সিরাজ :

একই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আর একটি গ্রন্থ হল মিনহাজ-উস্-সিরাজের’ ‘তবাকত-ই-নাসিরি’ (১২৬০ খ্রিঃ)। সামগ্রিকভাবে মুসলমান-শক্তির প্রসার এবং নির্দিষ্টভাবে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুলতানি শাসনাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের আকর গ্রন্থ হিসেবে এটি স্বীকৃত। মিনহাজ ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে আসেন। আমৃত্যু তিনি দিল্লিতে ছিলেন। মাঝে প্রায় তিন বছর তিনি বাংলার রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে কাটিয়েছিলেন। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বহু শহর যেমন মুলতান, লাহোর, উচু, গোয়ালিয়র ইত্যাদি পরিভ্রমণ করে তিনি হিন্দুস্তানের পরিবেশ ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। মিনহাজ সুলতান নাসিরউদ্দিনের সময় দিল্লির প্রধান কাজি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উচ্চপদস্থ রাজকর্মী হওয়ার ফলে সুলতানি আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থার খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। এই গ্রন্থের ঘটনাবলি, সন ও তারিখ সঠিক বলেই অনুমান করা হয়। তবে বলবনের সিংহাসনারোহণ পর্যন্ত জীবিত থাকলেও তিনি এই গ্রন্থে নাসিরুউদ্দিনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনাবলি উল্লেখ করেছেন। মিনহাজ বিভিন্ন মৌলিক উপাদান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। বারাণীর মতই তিনিও ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি, ধর্মতত্ত্ববিদ, কূটনীতিক ও রাষ্ট্রবিদ। সমকালীন ইতিহাসমূলক রচনাবলীর সাথে তাঁর ভালোই পরিচয় ছিল। এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী, জনশ্রুতি, পর্যটকদের সাক্ষ্য ইত্যাদি থেকে তিনি রচনার রসদ সংগ্রহ করেছেন।

মিনহাজের ইতিহাসের পরিধি খুবই ব্যাপক। প্রায় কুড়িটি রাজবংশের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তবে গুরুত্ব পেয়েছে গজনি ও ঘুর বংশ, ইলবেরী তুর্কী সুলতানগণ এবং মোঙ্গল আক্রমণের কাহিনী। দিল্লির সুলতানি শাসনের দুই প্রধান নিয়ন্ত্রক উলেমা ও অভিজাত শ্রেণির কথা তাঁর রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। সুলতানি শাসনের প্রতি নিজের দুর্বলতা তিনি গোপন করেন নি। বিশেষত তাঁর পৃষ্ঠপোষক গিয়াসউদ্দিন বলবনের বহু দুষ্কর্ম তিনি আড়াল করে গেছেন। বলবনসহ ইলতুৎমিসের আমলের চল্লিশজন অভিজাতর ‘চক্র’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি পঁচিশ জনের পরিচয় দিয়েছেন। তবে এদের ভূমিকার তিনি কেবল প্রশংসাই করেছেন।

মিনহাজউদ্দিনের লেখায় দরবারের রাজনীতি এবং আমির-ওমরাহদের কাহিনি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি তুর্কি-অভিজাতদের দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করেছেন। তুর্কিগোষ্ঠীর বিরোধী হিন্দুস্তানি ওমরাহ ইমাদ-উদ্দিন রাইহানের কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। মিনহাজউদ্দিনও ধর্মীয় ও নৈতিক বিধানের বাহক রূপেই ইতিহাসকে গ্রহণ করেন। দৈবশক্তির অনিবার্যতাকে ঘটনার নিয়ন্ত্রক বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। নীতিবাদ ও উপদেশাবলির ভাণ্ডারে ইতিহাসকে পরিণত করায় তাঁর ইতিহাসও পারসিক ধারার আবর্তে ঘুরপাক খায়। আধুনিক ইতিহাসচর্চার মানবিকতাবাদ তাঁকে প্রভাবিত করতে পারেনি। মানুষ কেবল দৈব-ইচ্ছার ভিত্তিতেই কাজ করে। মানুষের কর্মধারা কোনো স্বাধীন পরিবর্তনশীল চেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না—এই ধারণার ভিত্তিকেই তিনি ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেন। ইতিহাসমূলক গ্রন্থ হিসেবে ‘তবাকত্‌-ই-নাসিরি’ ত্রুটিমুক্ত নয়। তিনি মূলত ব্যক্তির জীবনকে কেন্দ্র করে ঘটনাবলীর উল্লেখ করেছেন। ফলে ঘটনাবলীর কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা তিনি করেন নি। এমনকি বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার প্রয়াসও তাঁর লেখায় অনুপস্থিত। রাজতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের বাইরে তিনি জীবনের সন্ধান করেন নি। ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, জীবনধারা, ধর্ম-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি নিস্পৃহ ছিলেন। ফলে ইতিহাসের সর্বদর্শী চরিত্র তাঁর রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় না। ড. জগদীশ নারায়ণ সরকারের মতে, মিনহাজ-এর রচনা খুবই সংক্ষিপ্ত। কোনো কোনো আলোচনা এতটাই সংক্ষিপ্ত যে, তার ব্যবহারিক মূল্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পি. হার্ডির মতে, মিনহাজ এমন কিছু উপাদানের উল্লেখ করেছেন, যেগুলির অস্তিত্বই নেই। উপরন্তু তিনি উপাদানের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের কোনো চেষ্টা করেননি। হার্ডিলিখেছেন, “The Tabaquat-i-Nasiri is literally composed to Strata upon Strata of frozen narratives.” “বস্তুত মিনহাজ নীতিবোধকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইতিহাস লেখেননি, তাঁর লেখাকে অলংকৃত করার জন্যই নীতিবোধকে যুক্ত করেছেন। ঐতিহাসিক নিজামী (K. A. Nizami) মনে করেন, মিনহাজউদ্দিন ইতিহাসের কালানুক্রমের ওপর অকারণ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এর পরিণামে তাঁর ইতিহাস একটি ‘স্থূল, অনুজ্জ্বল ও নীরস’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে (‘has made history adull, dark and insipid affair’)। এই রচনা থেকে সমকালীন আর্থসামাজিক চিত্র পাওয়া যায় না।