ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনায় দুর্ধর্ষ তুর্কী-কাহিনি এক দুর্বার বন্যার মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তখন গৌড়াধিপতি লক্ষণ সেনের রাজত্বকাল। কথিত আছে লক্ষণ সেন তাঁর রাজধানী নবদ্বীপ, ত্যাগ করে গঙ্গাপথে পূর্ববঙ্গাভিমুখে যাত্রা করেন। এই সময় তুর্কিরা গৌড় লুণ্ঠনের জন্য ধাবিত হয়। বাংলার বুকের উপর যে ধ্বংস, লুণ্ঠন ও অত্যাচারের তাণ্ডব চলেছিল তা ভয়াবহ।

তুর্কি আক্রমণে বাংলার সামাজিক অবস্থা:

তখনকার সময় গৌড় ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক রাজধানী, কিন্তু তার সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল নবদ্বীপ মুসলমান বিজয়ের পূর্বে সেন আমলে নবদ্বীপ ছিল বাংলার রাজধানী। মুসলমান আমলে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব লুপ্ত হয়। নবদ্বীপ তার বিদ্যাচর্চার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নিয়ে নব্যন্যায়ের পীঠস্থান রূপে খ্যাতিলাভ করে সমগ্র ভারতে। সমাজে উচ্চস্তরে যখন এইভাবে চলছিল সামাজিক প্রতিরোধের প্রয়াস ঠিক তখনি সমাজের নিম্নস্তরে হয়েছিল এক ভয়াবহ ভাঙনের সূত্রপাত।

সামাজিক বিধিবিধানের কঠোরতায় পতিত, নির্যাতিত, হতমান নিম্নশ্রেণির মানুষেরা সামাজিক সাম্য সন্ধান, সমবিচার এবং স্বস্তির আকাঙ্ক্ষায় দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্যে ধাবিত হয়। সমাজের উচ্চশ্রেণির ধর্মীয় গোঁড়ামি, মধ্যশ্রেণির অনৈতিক ব্যভিচার ইত্যাদির ফলে নৈরাশ্য পীড়িত নিম্নশ্রেণির দলে দলে ধর্ম ও সমাজ ত্যাগে সেদিন বাঙালি হিন্দু সমাজের উঠেছিল নাভিশ্বাস। ভাঙনের সেই ভয়াবহ মুহূর্তে নবদ্বীপের বুকে ভূমিষ্ঠ হলেন যুগনায়ক শ্রীচৈতন্য। প্রথম জীবনে তিনি অর্থহীন সামাজিক উন্নাসিকতা ও পাণ্ডিত্যের অভিমানকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলেন। পরবর্তী জীবনে সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি মান-হীনকে দিলেন মান, আশাহীনকে দিলেন আশা ও ভালোবাসা। এইভাবে গড়ে উঠে সমাজের পরিবর্তন। আর শ্রীচৈতন্যদেব হলেন সেই বিপুল সামাজিক বিপ্লবের মহানায়ক।


তুর্কি আক্রমণে বাংলার সাহিত্যে প্রতিক্রিয়া :

তখনকার দিনে মানুষের মনে দেব দেবীর লীলা যেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল তেমনি সাহিত্যেও তার পূর্ণ প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। তার উপর মুসলমানদের আক্রমণের ফলে এক বিপর্যয়কর রাষ্ট্রবিপ্লবের মধ্যে বাংলার কুটিরে কুটিরে আবার সেই দেব দেবীর পদধ্বনি শোনা যেতে লাগল।

ষোড়শ শতাব্দী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাল। কারণ এই সময় হোসেন শাহের মতো প্রকৃত গুণগ্রাহী, উদার হৃদয় সুলতান গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার যে অনুকূল পরিমন্ডলের সৃষ্টি হয়েছিল, হোসেন শাহের পুত্র ও আঞ্চলিক শাসন কর্তারা তা উৎসাহের সঙ্গে বরণ করেছিলেন। অন্যদিকে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবে এক আশ্চর্য মহিমায় স্বর্ণপ্রসু হয়ে উঠল বাংলা সাহিত্যের প্রান্তর।

এই দুই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক ব্যক্তির প্রেরণায় সৃষ্টির অভূতপূর্ব মহোল্লাসে সাড়া পড়ে যায় দিকে দিকে। দুজনের একজন রাজা, অন্যজন সন্ন্যাসী। এই দুই জনের একজনও একটিও পদ রচনা করেন নি। কিন্তু তাঁদের প্রেরণায় বহু কবির সৃষ্টির উৎসমুখ খুলে গিয়েছিল এবং রচিত হয়েছিল ভাবসমৃদ্ধ কাব্য।

তুর্কি আক্রমণে বাংলার যুগ বিভাজন :

১২০৬ খ্রীঃ বখতিয়ার খিলজির মৃত্যুর পর দেড়শত বছর গোটা দেশের উপর যে রাজনৈতিক ঝঞ্ছা প্রবাহিত হয়েছিল তার ফলে ওই সময়কে অন্ধকার যুগ বা তমসা যুগ বলা হয়। এই সময় রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় সমাজের সর্বদিকেই বিশৃঙ্খলা দেখা গিয়েছিল।

এই বিশৃঙ্খলা থেকে মানুষ নিজেদেরকে বাঁচানোর চেষ্টার ত্রুটি করেনি। আঘাতে আঘাতে যেমন তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তেমনি বাঁচার প্রেরণাও ছিল অটুট। তাই এই যুগকে মানস প্রস্তুতির কাল বা যুগ বলা হয়।

একের পর এক সুলতান যখন এই বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করতে অসমর্থ হয়ে পড়েছিলেন তখন আবির্ভাব ঘটে হোসেন শাহের। তিনি বিদেশি হয়েও এদেশকে তাঁর নিজের দেশ বলে মনে করেছিলেন এবং মানুষের কল্যাণ করেছিলেন। অন্যদিকে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবে মানুষের মধ্যে স্বস্তিবোধের ছায়া ফুটে ওঠে। এক কথায় চৈতন্য-রেঁনেসাঁস সমাজ ও সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।