ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবন প্রণালী সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।
সাংস্কৃতিক সংঘাতের কারণঃ সমাজ ও সংস্কৃতি সদাপরিবর্তনশীল। সমাজকাঠামাের সাথে সংস্কৃতি ওতপ্রােতভাবে জড়িত। তাই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে সমাজকাঠামাের সর্বক্ষেত্রে একইভাবে প্রভাব পড়ে না। তাই সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা দেয়। সাংস্কৃতিক সংঘাতের কারণগুলাে নিম্নে তুলে ধরা হলাে-
(১) সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিঃ সংস্কৃতির প্রধান দুটি দিক হলাে- বস্তুগত ও অবস্তুগত। এই বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি সাংস্কৃতিক সংঘাতের অন্যতম কারণ। বস্তুগত সংস্কৃতি যে গতি ও হারে বৃদ্ধি পায় বা এগিয়ে চলে অবস্তুগত সংস্কৃতি সে তুলনায় অনেক ধীরে এগুতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ শিক্ষা, ব্যবসা বা অন্যকোনাে কারণে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ফলে তাদের বস্তুগত সংস্কৃতির উন্নতি ঘটে, কিন্তু তাদের আচার-আচরণ তথা অবস্তুগত সংস্কৃতি তার থেকে পিছিয়ে থাকে। ফলে সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা দেয়।
(২) গ্রামীণ ও শহুরে সংস্কৃতির পার্থক্যঃ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থাকে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে সমাজের দু’টি ধরন পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ একটি হলাে গ্রামীণ সমাজ এবং অন্যটি শহুরে সমাজব্যবস্থা এবং এই সমাজ দু’টিতে দুই ধরনের বা আলাদা সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। যদিও মূল সাংস্কৃতিক ধারা একই। শহরে উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফলে এখানকার মানুষ সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তুলনমূলকভাবে গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতির চেয়ে উন্নত। তা ছাড়া আমাদের দেশের গ্রামীণ পর্যায়কে আধুনিকীকরণ করে তােলা সম্ভব হয়নি। তাই এখানকার জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নত হয়নি এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও তারা পিছিয়ে রয়েছে। ফলে উভয় সমাজের যে সংস্কৃতিগত পার্থক্য তার কারণেই মূলত সাংস্কৃতিক সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে।
(৩) অর্থনৈতিক বৈষম্যঃ অর্থনীতি হলাে যেকোনাে সমাজের মূল ভিত্তি। অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে সমাজে সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা দেয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ ও সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের সংস্কৃতির সাথে দরিদ্র জনগােষ্ঠীর সংস্কৃতির বেশ পার্থক্য রয়েছে। সমাজে কেউ বিশাল অট্টালিকায় বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত, আর কেউ গাছতলা বা বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অথচ দু’শ্রেণির মানুষই একই সামজে পাশাপাশি বাস করছে। উভয়-সম্প্রদায়ের চাল-চলন, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, পােশাক-পরিচ্ছদ, রুচিবােধ সবছুির মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। ফলে উভয় সংস্কৃতির মধ্যে সংঘাত অনিবার্য।
(৪) মূল্যবােধের সংঘাতঃ বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী আরেফীনের মতে, বাস্তবতার সাথে মূল্যবােধের সংঘাতের ফলে সমাজে সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা দেয়। পরিবেশগত ভিন্নতার কারণে সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারায় উন্নত সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধরনের মূল্যবােধ কাজ করে। অন্যদিকে সভ্যতার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতি একটি স্বতন্ত্র ধারায় গড়ে উঠেছে যাকে বলা হয় লােকসংস্কৃতি। এই শহুরে ও লােক সংস্কৃতির মূল্যবােধের পার্থক্যের কারণে সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা দেয়।
(৫) চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনঃ বিভিন্ন চিন্তা-চেতনার মানুষ একটি সমাজে বসবাস করে। যার ফলে মানুষের মধ্যে চিন্তা-চেতনাগত বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তা ছাড়া সমাজস্থ মানুষের চেতনা কখনােই একই ধারায় পরিবর্তিত হয় না। তাই দেখা যায়, কেউ চিন্তাগত দিক দিয়ে যখন এগিয়ে যায় তখন পশ্চাৎ চিন্তার সাথে সংঘাতের সূত্রপাত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের চিন্তা-চেতনার সাথে তাদের বাবা-মার চিন্তা-চেতনার পার্থক্য রয়েছে।
(৬) প্রযুক্তির ব্যবহারঃ একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে ব্যাপক হারে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির এই ব্যবহার দেশের সর্বত্র সমান নয়। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এক অঞ্চল এগিয়ে গেলেও অন্য অঞ্চল পেছনে পড়ে থাকে। কেননা যেখানেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগবে সেখানেই সামগ্রিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসবে। সেদিক বিবেচনায় যেহেতু শহর জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব সাধারণত বেশি হয়ে থাকে অথবা প্রযুক্তির ছোঁয়াই শহুরে জীবন রূপান্তরিত হয়। আর যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার নেই তারা সাধারণত পশ্চাৎপদ থাকে। ফলে উভয় সমাজের মধ্যে একটি পার্থক্য সূচিত যার ফল হলাে সাংস্কৃতিক সংঘাত।
(৭) নগর-মানসিকতার অভাবঃ আমাদের সমাজে নগর বৃদ্ধি পেলেও নগর-মানসিকতা তৈরি হয়নি। নগরজীবনের সুযােগ-সুবিধা ভােগ করলেও নগর-মানসিকতা না থাকায় আমাদের চলনে-বলনে, চিন্তা-কর্মে নগর-সুলভ আচরণ তথা নগর-সংস্কৃতির অভাব দেখা দেয়। ফলে প্রচলিত সংস্কৃতি ও নগর-সংস্কৃতির মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
(৮) নগর পরিকল্পনার অভাবঃ পরিকল্পিত নগর ছাড়া সমাজের বা নাগরিক জীবনের সামগ্রিক উন্নতি আশা করা যায় না। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমাদের দেশে মূলত অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন হচ্ছে। যার ফলে উন্নত জীবনের চেয়ে আরাে নিম্নমুখী জীবন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে সাংস্কৃতিক ল্যাগ- এর সূত্রপাত হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে,বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক সংঘাত বিদ্যমান। আমাদের দেশে একদিকে গ্রামীণ বা লােকসংস্কৃতি, অন্যদিকে শহুরে বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। একদিকে বিশ্ব সংস্কৃতি, অন্যদিকে দেশিয় সংস্কৃতি। এভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়, তা আমাদের সমাজজীবনকে ব্যাহত করে।
Leave a comment