ভূমিকা: তিরিশের দশক আধুনিক বাংলা কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। তিরিশের দশকের কবিরাই প্রথম রবীন্দ্র বিরোধী চেতনায় ঋদ্ধ হলেন। তারাই রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন কাব্য ধারার সন্ধান দেন আধুনিক বাংলা কবিতায়। তাঁদের কাব্যে ব্যক্তির মনোজগত থেকে শুরু করে তাদের পারিবারিক সামাজিক জীবন চিহ্নিত করেন। এসময় পাঁচজন প্রতিভাধর কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে- বাংলা কবিতায় বিশেষ অবদান রাখেন; এঁরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে পরিচিত। তাই আধুনিক বাংলা কবিতায় তিরিশের দশক এক স্বতন্ত্র ও অনন্য সময় হিসেবে বিবেচিত।
তিরিশের দশকের শ্রেষ্ঠ পাঁচজন কবি এবং তাদের কাব্য: তিরিশের দশকে অসংখ্য কবির আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে পাঁচজন কবি ও তাদের কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
জীবনানন্দ দাশ : তিরিশের দশকের একজন আধুনিক এবং জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবদের একজন। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন। বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন সেকালের বিখ্যাত কবি। মায়ের কাছ থেকে তিনি কবিতা লেখার প্রেরণা লাভ করেছিলেন। স্বল্প সময়ের জন্য বিভিন্ন পেশা অবলম্বন করলেও মূলত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেন। কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতায় সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভবের এক জগৎ তৈরি করেন। বিশেষকরে গ্রামবাংলার নিসর্গের যে ছবি তিনি এঁকেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা চলে না। সেই নিসর্গের সঙ্গে অনুভব ও বোধের বহুতর মাত্রা যুক্ত হয়ে তাঁর হাতে অনন্যসাধারণ কবিতাশিল্প রচিত হয়েছে। এই অসাধারণ কাব্যবৈশিষ্ট্যকে রবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চিত্ররূপময়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া ব্যক্তিমানুষের নিঃসঙ্গতা, আধুনিক জীবনের বিচিত্র যন্ত্রণা ও হাহাকার এবং সর্বোপরি জীবন ও জগতের রহস্য ও মাহাত্ম্য সন্ধানে তিনি এক অপ্রতিম কবিভাষা সৃষ্টি করেছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন ‘নির্জনতম কবি’ বলে। উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক সৃজন, আলো- আঁধারের ব্যবহার, রঙের ব্যবহার এবং অনুভবের বিচিত্র মাত্রার ব্যবহারে তাঁর কবিতা লাভ করেছে অসাধারণত্ব। তাঁর নিসর্গবিষয়ক কবিতা বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিশেষ স্থান রয়েছে। জীবনানন্দের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: ‘ঝরাপালক’ (১৯২৮), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ [১৯৩৬], ‘বনলতাসেন’ [১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী’ [১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ [১৯৪৮], ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭), ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার কবিতার একটি বিশেষ দিক হলো প্রকৃতির ব্যবহার। উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি সর্বাশ্রেষ্ঠ। তাছাড়া ‘রূপসী বাংলার কবি’ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আর যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো পুরাণের ব্যবহার, প্রেম চেতনা, ইতিহাস
চেতনা, সৌন্দর্য চেতনা প্রভৃতি। সব মিলিয়ে তিরিশের দশকে জীবনানন্দ দাশের কাব্য বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর কবিতা বনলতা সেনের কয়েকটি ছত্র হলো-
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবন্তীর, কারুকার্য;
অতিদূর সমুদ্রের পর; হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়াছে দিশা।”
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত: আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের [১৯০১-১৯৬০] একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম।
ত্রিশের দশকে যে পাঁচজন কবি বাংলা কবিতা রচনায় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অন্যতম। সুধীন্দ্রনাথের কবি মানস তাঁর ব্যক্তিমানসের নির্মাণ, তাঁর অধীত বিদ্যা, অর্জিত অভিজ্ঞতা ও অভীষ্ট সংকল্পের সংমিশ্রণ। দুই বিশ্বযুদ্বের (প্রথম ও দ্বিতীয়) অন্তবর্তী সংকট- সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য তিন ক্ষেত্রেই যখন সারাবিশ্ব দোলাচল পরিস্থিতি- তখন কাব্যের জগতে আবির্ভাব ঘটে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের। তাঁর কবিতা দ্বন্দ্বমুখর; মননের সঙ্গে আবেগের দ্বন্দ্ব, বুদ্ধির সঙ্গে প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব, বাস্তবের সঙ্গে আদর্শের দ্বন্দ্ব, ক্ষণিকতার সঙ্গে চিরন্তনতার দ্বন্দ্ব- আর সবার মূলে রয়েছে সুধীন্দ্রনাথের দার্শনিকসত্তা ও কবিসত্তার দ্বন্দ্ব। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’ [১৯৩০), ‘অর্কেস্ট্রা’ [১৯৩৫], ‘ক্রন্দসী’ [১৯৩৫], ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৩৭), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৬), ‘প্রতিধ্বনি’ এবং ‘দশমী’ (১৯৫৬)। ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫) সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বেশি সংস্কারকৃত কাব্যগ্রন্থ। ‘অর্কেস্ট্রা’ হলো সম্মিলিত বাদ্যযন্ত্রের সুর- যার প্রতিটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ। ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, নৈরাশ্য, বিচ্ছিন্নতা, ঐতিহ্য, মৃত্যু চেতনা, ঈশ্বরভাবনা, দার্শনিকচিন্তা প্রকাশিত হয়েছে। তথাপি, আত্মপীড়ন, আত্মদহন, আত্মবিকর্ষণের চেতনাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। ভিন্ন ভিন্ন কবিতাগুলো রসপরিণতির দিক থেকে এমন পরস্পর সংলগ্ন যে, শেষ পর্যন্ত কবিতাগুলো একত্র হয়ে একই সুর উপস্থাপন করে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন: “মালার্মে প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট: আমিও মানি যে, কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ। তিনি ফারসি কবি মালার্মের মতো প্রতীক শব্দের প্রয়োগ করেছেন তাঁর কবিতায়। যেমন-
“আমার সঙ্কীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘি আজ দর্শনের সীমা
ছুটেছে দক্ষিণাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো।”
শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে তাঁর আসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে তাঁর কলাকৌশল ভারতচন্দ্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভারচন্দ্রের মতোই তিনি ভাষাকে এত সংযত ও পরিচ্ছন্ন করে তুলেছেন যে অনেক ক্ষেত্রে তা প্রবাদ বাক্যের অসামান্যতা লাভ করেছে:
ক. এক বেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা।
খ. সৃষ্টির রহস্যমান আলিঙ্গন, পুনরলিঙ্গন।
গ. বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।
ঘ. অনুমানে শুরু, সমাধা অনিশ্চয়ে, জীবন পীড়িত প্রত্যয়ে প্রত্যয়ে।
অমিয় চক্রবর্তী: আধুনিক কবিদের মধ্যে সর্বাপ্রেক্ষা জটিল ও দ্বিধাবিভক্ত মনের অধিকারী কবি অমিয় চক্রবর্তী। দৃষ্টির জগৎ ও ধ্যানের জগৎ এদুটি বিষয় নিয়ে তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বিজ্ঞান চেতনারও পরিচয় দেন। তাঁর কাব্যসাধনা শুরু হয়েছিল ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তাঁর কবিতা প্রধানত রবীন্দ্রানুসরণ। উত্তর-তিরিশে তাঁর কবিতায় পালাবদল ঘটে। ১৯৩৫ সালে ‘খসড়া’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরে তিনি অবিসংবাদিতভাবে আধুনিক কবিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ‘একমুঠো’ [১৯৩৯), ‘মাটির দেয়াল’ (১৯৪২), ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ [১৩৫০], পারাপার, পালা বদল, ঘরে ফেরার দিন ইত্যাদি অমিয় চক্রবর্তীর কাব্য। তাঁর কবিতায় পরিশীলিত এবং বিদগ্ধমনের পরিচয় চিহ্নিত-
“আমার হঠাৎ হাওয়া মন
আয়নার
তারি ‘পরে রূপ নিয়ে চলে যায়
উদাসীন ঘুরন্ত প্রকৃতি।
……………………………………………
চোখ নেভে, রং কোথা পাবে মন!” [খসড়া]
বুদ্ধদেব বসু: আধুনিক বাংলা কাব্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮- ১৯৭৪]। তিরিশের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। তিনি শুধু কবি-নন- সাহিত্যসমালোচক এবং কবিদের স্রষ্টাও বটে। তিনি ‘কবিতা’ নামে সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তাঁর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দীর বন্দনা’ [১৯৩০], ‘পৃথিবীর প্রতি’ (১৯৩৩), ‘কঙ্কাবতী’ (১৯৪৩), ‘শীতের প্রার্থনা’, ‘বসন্তের উত্তর’, ‘নতুন পাতা’, ‘দময়ন্তী’, ‘দ্রৌপদীর শাড়ী’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্য। তাঁর কবিতা থেকে উদাহরণ-
“ঘুমের আড়ালে কাল সারারাত্রি পুড়েছে চোখেরা,
ভোরের হাওয়ায় আজ ছেড়ে গেছে হৃদয়ের জ্বর;
শুধু আছে হৃদয়ের অবসাদ-চারিদিকে ক্লান্তির কুয়াশা।”
বিষ্ণু দে: তিরিশের যুগে বাংলা কবিতায় মৌলিক রচনা গুণে যারা খ্যাতি অর্জন করেন বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২] তাঁদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ থেকে বিষ্ণু দের কবিতার পার্থক্য সহজেই অনুভব করা যায় আর এটাই তার মৌলিকতা। এমৌলিকতার মধ্যে কিছুটা কৃত্রিমতা ও আতিশয্যা আছে। মনে হয় কবির উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের সাথে পার্থক্যটিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। বিষ্ণু দে এমন একজন কবি যিনি এলিয়টেয় কাছে ঋণী হয়েও মৌলিক প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃত। তার কাব্যে মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে। বিষ্ণু দে ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩২], ‘চোরাবালি’ [১৯৩৮], ‘পূর্বলেখ’ (১৯৪০), ‘সন্দ্বীপের চর’ [১৯৪৭], ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ [১৯৫০] ‘অন্বিষ্ট’ প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি মার্কসধারার কবি। তাঁর অনেক কবিতায় রাজনৈতিক মতের এবং তির্যক ব্যঙ্গ দৃষ্টির প্রকাশ ঘটে। তাঁর কবিতা থেকে উদাহারণ-
“নাকি তুমি অজানিতে ভরে দাও ডালি?
নাকি আমি সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি
পড়েছি প্যারিসে গিয়ে, তাই চোখে আনো
কৌতূহলে নামে বস্তু?”
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বাংলা কাব্য সমৃদ্ধকরণে তিরিশের দশক একবিশেষ জায়গা দখল করে আছে। এ সময়ের কবিদের কবিতায় ব্যক্তির মনোবেদনার চিত্র সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে। কোনো কোনো করি মার্কসবাদের দিকে নজর দিয়েছেন। রবীন্দ্র-ঘরানা অতিক্রম করে নতুন কাব্যক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে তিরিশের দশকের কবিদের হাতেই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রোত্তর যুগে কবিতার এই বিপ্লব একদিকে যেমন অপরিহার্য ছিল- তেমনি তা আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রয়োজনের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক কবিতা-সৃষ্টিতে তিরিশের দশক বিশেষভাবে চিহ্নিত।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment