প্রশ্নঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে কাদির মিয়া চরিত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাস নদী তীরবর্তী মুসলমান চাষি জীবনের আচার আচরণের প্রতীক কাদির মিয়া। সংস্কৃতিমনা মানুষ কাদির মিয়া মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, দরদি। সে কৃষিজীবী, ব্যবসায়ী।

উপন্যাসের তথ্যালােকে বলা যায়- কাদির মিয়া উৎপাদিত কষিজাত ফসল বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। নিজের ক্ষেতে উৎপাদিত আলু এক দিন নৌকায় করে বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। নিজের ক্ষেতের আলু এক দিন নৌকায় করে বাজারে বিক্রি করতে যাওয়ার পথে নদীর প্রবল স্রোতে ও ঝড়ে তা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। পুত্র ছাদির ও কাদির মিয়াকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে বনমালী ও ধনঞ্জয়। বিক্রি করতে নেওয়া আলু বাজারে সাজানাের সময় কাদির মিয়া ইচ্ছাকৃতভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কতকগুলাে আলু দূরে সরিয়ে রাখে। এই আলুগুলাে বাজারে আশ্রয় নেওয়া অসহায় ছেলেগুলাে কুড়িয়ে নেবে, অসহায়দের প্রতি কাদির মিয়ার মনােভাব এ রকম। ‘সাইত’ করার আগে কাদিরের এ ধরনের বদান্যতা সব সময় ভালাে লাগে না পুত্র ছাদিরের। এ প্রসঙ্গে কাদির বলে, “বড় অভাগা এরা। কেউর মা নাই, বাপ নাই, লাথি ঝাটা খায়, কেউর মা আছে কিন্তু দানা দিতে পারে না। কেউর বাপ আছে মা নাই।” অবশ্য, মানুষের জন্য কাদিরের এই মায়া-মমতা সম্পর্কে পুত্র ছাদিরও সন্তুষ্ট। কাদিরের সততা ধর্মভীরুতার জন্য গ্রামের মানুষও কাদির মিয়াকে সম্মান করে। বনমালী কাদির মিয়াকে মনে করেছে পয়গম্বর মুহাম্মদের পথের মানুষ। পয়গম্বরের মতাে মানুষকে ভালােবাসে কাদির মিয়া, সে যেন সেই পয়গম্বরের মহত্ত্বেরই একটুখানি পরশ লাভ করেছে। কাদির সম্পর্কে বনমালীর এই ধারণা কাদির মিয়ার চরিত্রকে করে তুলেছে মহানুভব। পারিবারিক জীবনেও কাদির অত্যন্ত স্নেহশীল। পুত্রবধূ খুশির চোখের জল দেখে মনে পড়ে তার নিজ কন্যা জমিলার কথা, “বেদনায় বুকটা টনটন করিতে লাগিল; মনে মনে বলিল, মুহুরী যত দোষের দোষী না, তার চাইতে অধিক দোষী করিয়া আমার এই অসহায় মেয়েটাকে সকলে মিলিয়া জর্জরিত করিতেছে। আমি যত দোষের দোষী না…শােনে আর চোখের জল ফেলে?……. জমিলা। সেও …… মা মরা মেয়ে।” এ উক্তিতে একজন স্নেহশীল পিতার পরিচয়ই যেন ফুটে উঠেছে। কাদির মিয়া শক্ত নৈতিকতার মানুষ। সে বিয়াই নিজামত মুহুরীর ওপর ক্ষিপ্ত আর্থিক লেনদেন শােধে তার অপারগতার জন্য নয়; বরং ক্ষিপ্ত তার ঘােরানাে প্যাঁচানোআচরণের কারণে। এ ছাড়াও কাদির মিয়ার নৈতিকতায় আঘাত দিয়েছে মাগন সরকার। অবলীলায় সে কাদির মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে শিক্ষিত মানুষদের রূপটিকে যেন বিষাক্ত করে তুলেছে কাদির মিয়ার কাছে। সে কারণে তার ধারণা জন্মেছে, শিক্ষিত মানুষ মাত্রই মন্দ। তাই ছাদিরের ইচ্ছার বিরােধিতা করে কাদির মিয়া নাতি রমুকে স্কুলে পড়তে দিতে চায় না। ছাদির মনে করে দুনিয়ার হালচাল জানতে হলে লেখপড়া করা দরকার; কিন্তু কাদির মিয়া তার বিয়াই নিজামত মুহুরীর মতাে অনেক উদাহরণ দেখায়। সে বলে: “ইশকুলে পাঠাইলে, তাের শশুরের মত মুহুরী হইতে পারিবে আর শাড়ীর বিছানায় বউকে ও বউয়ের বিছানায় শাশুড়ীকে শােয়াইয়া দিয়া দূরে সরিয়া ঘুসের পয়সা নিতে পারিবে।”

সরল মানসিকতার জন্যই সে যায়নি মামলা মােকদ্দমার পথে; সে মানুষকে বিশ্বাস করতে প্রস্তুত। আত্মবিশ্বাসের জোরেই কাদির মিয়া মাগন সরকারকে জব্দ করে। মাগন ঠাকুরের ঘটে বীভৎস মৃত্যু। এই কাদির মিয়াকে আবার পাওয়া যায় উপন্যাসের শেষে, মালােদের দুর্দিনে। অনাহারী মালােদের জন্য সে খুলে দেয় তার ধানের গােলা। কাদির মিয়া আবারও তার উন্নত চরিত্রের পরিচয় রেখেছে এই উদার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।