প্রশ্নঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন তার বর্ণনা দাও।

অথবা, “তিতাস ও তীরবর্তী মালাে ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনচিত্ৰই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের প্রধান ভিত্তি”- আলােচনা কর।

অথবা, “তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস তীরের স্থানিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গে এতদঞ্চলের মালাে সম্প্রদায়ের আশা আকাঙক্ষা, হতাশা- বেদনা এবং উত্থান পতনের বিস্ময়কর কাহিনি শিল্পসফলভাবে উপস্থাপন করেছেন।”- এ সম্পর্কে তােমার মতামত দাও।

অথবা, “তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার আশৈশব অর্জিত অভিজ্ঞতারই বাণীরূপ দিয়েছেন।”- উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।

অথবা, “তিতাস একটি নদীর নাম’ চার খণ্ডে সমাপ্ত বৃহদায়তন উপন্যাসে তিতাস তীরবর্তী মালােদের জীবনচিত্রাঙ্কনে লেখকের দক্ষতা বিস্ময়কর।”- উক্তিটির যথার্থতা বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ [১৯৫৬] বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস সাহিত্যে একটি অনবদ্য ও যুগান্তসৃষ্টিকারী সংযােজন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত তিতাস তীরবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, সংগ্রামশীল, পরিশ্রমজীবী, ধীবর সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা-বেদনা, শ্রম-বিশ্রাম, সংকীর্ণতা- ঔদার্য। লেখক শিল্পরূপ দিয়েছেন এ উপন্যাসে। তিতাস তীরবর্তী কৃষক পল্লির জীবনবাস্তবতাও অসাধারণ নৈপুণ্যে অঙ্কিত হয়েছে এ উপন্যাসে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চার খণ্ডে সমাপ্ত বৃহদায়তন উপন্যাস। উপন্যাসে তিতাস তীরবর্তী মালােদের জীবনচিত্রাঙ্কনে লেখকের দক্ষতা বিস্ময়কর। তিতাস তীরের রং রেখা, পরিবেশ প্রতিবেশের সঙ্গে উপন্যাস বিধৃত ঘটনাপুঞ্জের রয়েছে সুগভীর ঐক্য। উপন্যাসের প্রতিটি ঘটনাই যেন এ অঞ্চলের রঙে রঙিন।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার আশৈশব অর্জিত অভিজ্ঞতারই বাণীরূপ দিয়েছেন। যে জীবনপরিবেশে তিনি লালিত পালিত ও বর্ধিত হয়েছেন, সেই জীবনকেই তিনি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় এ উপন্যাসের বিশাল ক্যানভাসে অঙ্কন করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত তিতাস তীরের গােকন গ্রামের অখ্যাত মালাে পরিবারে বেড়ে ওঠা এ ঔপন্যাসিক উপন্যাস রচনাকালে ছিলেন তিতাস থেকে দূরবর্তী অবস্থানে নগর কোলকাতায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে উপন্যাসের ঘটনাধারা, পরিণাম ও প্রতিপাদ্য নির্ণয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন স্মৃতিবিধুর অনুষঙ্গ। তবু আঞ্চলিক জীবনের সরল ও নিপুণ বিন্যাসে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে অসাধারণত্বে ভাস্বর।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাস এবং তিতাস তীরবর্তী অঞ্চলের local color and habitations পরমসূক্ষ্ম পরিচর্যায় উপস্থাপিত হয়েছে। নদী প্রধান বাংলাদেশে তিতাসের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। স্বভাবধর্মে এটি বাংলাদেশের অপরাপর নদী থেকে পৃথক। উপন্যাসের প্রারম্ভিক পর্যায়ে লেখকের ভাষ্য নিম্নরূপ-

“তিতাস একটি নদী। তার কুলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ; প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভােরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। মেঘনা পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মােড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণা পল্লীতাটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লিবালক তাতে সাঁতরাইয়া পার হইতে পারে না। আবার ছােটো নৌকায় ছােটো বউ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না। তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মতাে বক্রতা নাই, কৃপণের মতাে কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না।”

এরকম সহজ ও সাবলীল ভঙ্গির কারণেই তিতাস বাংলাদেশের নদী স্রোতস্বিনীর মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এর উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসও রহস্যপূর্ণ। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসের রং রেখা স্বভাব দার্শনিকতামণ্ডিত করে পরিবেশন করেছেন। ‘প্রবাস খণ্ডের’ শুরুতে তিনি মালােপাড়ার অবস্থা, অবস্থান, ঘর গেরস্থালির স্বরূপ অঙ্কন করেছেন এভাবে-

“তিতাস নদীর তীরে মালােদের বাস। ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানাে জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তকলি সুতা কাটার, জাল বােনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালােদের সংসার। নদীটা যেখানে ধনুকের মত বান্ধিয়াছে, সেইখান হইতে গ্রামটার শুরু। মস্ত বড় গ্রামটা তার দিনের কলরব রাতের নিশুতিতেও ঢাকা পড়ে না। দক্ষিণপাড়াটাই গ্রামের মালােদের।”

মালােপাড়ার দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, বঞ্চিত, বিড়ম্বিত ও নিগৃহীত ধীবর সম্প্রদায়ের একটি পূজাব্রতকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাংশ উন্মােচন করেছেন লেখক। এ পূজাব্রতের নাম মাঘমণ্ডলের ব্রত। এ ব্রতের স্থায়িত্বকাল সারা মাঘ মাস। এ মাসে কুমারী কন্যারা প্রার্থিত বরের আকাক্ষায় এ পূজা করে। এতদৃপ্রসঙ্গে লেখকের বর্ণনাংশ লক্ষণীয়-

“এ পাড়ার কুমারীরা কোনকালে অরক্ষণীয়া হয় না। তাদের বুকের উপর ঢেউ জাগিবার আগে, মন যখন থাকে। খেলার খেয়ালে রঙিন, তখনই একদিন ঢােল সানাই বাজাইয়া তাদের বিবাহ হইয়া যায়। তবু এই বিবাহের জন্য তারা দলে, দলে মাঘমণ্ডলের পূজা করে। মাঘ মাসের ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করিয়াছে, প্রতিদিন স্নানের শেষে বাড়িতে আসিয়া ভঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জল দিয়া সিড়ি পূজিয়াছে, মন্ত্রপাঠ করিয়াছে; লও লও সুরুজ ঠাকুর লও স্কুটার জল, মাপিয়া পুখিয়া দিব সপ্ত আজল। আজ তাদের শেষ ব্রত।”

অধিকাংশ মালাে-শিশু পাঠশালা বিমুখ। মৎস্যই যেহেতু তাদের জীবিকার প্রধান উপকরণ, সৈহেতু পাঠশালায় হাতেখড়ির পরিবর্তে তাদের হাতেখড়ি হতাে নাও-জালে। স্বল্পকাল ব্যবধানে তারা হয়ে উঠতাে নিপুণ জেলে। তাই শৈশব কৈশােরের আনন্দমুখর দিনগুলােতেও তারা গৃহকোণ অলস ও নিশ্ৰুপভাবে সময়ক্ষেপণ না করে মৎস্য শিকারের জন্য তিতাসে বেরিয়ে পড়ে। ‘খল-বাওয়া’ উপলক্ষে এখানকার একটি পরিবারের কোন এক তন্বী-তরুণীকে কেন্দ্র করে চৈত্রের মাঝামাঝি পর্যায়ে ফাগ-রাঙানাে দোলপূর্ণিমার উৎসবে কিশাের অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হয়। বসন্তের উৎসবমুখর এ উদাত্ত দিবসে অজানা আবেগে স্পন্দিত হয় কিশােরের হৃদয়, পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়কালে অনঙ্গ দেবতা যেন তাদের অজান্তেই নিক্ষেপ করে পুস্পশর। অতঃপর-

“কিশােরের গালে আবির দিতে মেয়েটার হাত কাঁপছিল; বুক দুরু দুরু করিতে লাগিল। তার ছন্দময় হাতখানার কোমল স্পর্শ কিশােরের মনের এক রহস্যলােকের পদ্মরাজের ঘােমটা ঢাকা দলগুলিকে একটি একটি করিয়া মেলিয়া দিল। সেই অজানা স্পর্শের শিহরণে কাপিয়া উঠিয়া সে তাকাইল মেয়েটির চোখের দিকে। সে চোখে মিনতি। সে মিনতি বুঝি কিশােরকে ডাকিয়া বলিতেছেঃ বহু জনমের এই আবিরের থালা সাজাইয়া রাখিয়াছি। তােমারই জন্য। তুমি লও। আমার আবিরের সঙ্গে তুমি আমাকেও লও।”

দোল পূর্ণিমার উৎসবে যে মেয়েটির রূপবিভায় মুগ্ধ ও চমকিত হয় কিশাের, সেই মেয়েটিকেই মােড়ল-গিন্নির সহায়তায় গান্ধর্ব-বিধানে বিবাহ করে কিশাের এবং সেখানকার মালাে সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি নিয়ে সে তার স্বগ্রাম গােকন ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথিমধ্যে মেঘনার অথৈ জলে রাত্রির অন্ধকারে দস্যুদলকর্তৃক অপহৃত হয় কিশােরের স্ত্রী ও সম্পদ দুই-ই। অপ্রত্যাশিত ও মর্মান্তিক এ ঘটনায় বিধ্বস্ত হয় কিশােরের হৃদয় এবং চিরকালের জন্য উন্মাদ হয়ে যায় সে।

গােকনঘাট গ্রামে নতুন করে পুত্র অনন্তকে নিয়ে সংসারধর্ম শুরু হয় কিশােরের স্ত্রীর। এ অচেনা পরিবেশে পদার্পণ করে কিশােরের স্ত্রী প্রথমাবধি অনুভব করে গ্রামবাসীদের উষ্ণ আন্তরিকতা। সহযােগিতার হাত সম্প্রসারিত করে সবাই। বসতঘর নির্মাণের পর জীবন জীবিকার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় অনন্তর মা। মালােপাড়ার অধিকাংশ নারী লক্ষ্মীর মতাে সেও সুতা। বুননের মাধ্যমে জীবিকার্জনের উপায় করে নেয়। কৃচ্ছসাধনার মধ্য দিয়ে পুত্র অনন্তকে নিয়ে সে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নঘাের বাস্তবতায় পথ চলে সে। যে নতুন সমাজ প্রকারে সে স্বেচ্ছাবন্দিনী, সে সমাজের প্রথা পদ্ধতি কখনাে কখনাে তাকে আতঙ্ক শিহরিত করে; দুরদুর বক্ষে সে অপেক্ষা করে ভয়ংকর কোনাে তথ্যচিত্রের। কারণ একদিন-

“সন্ধ্যার অল্প আগে দুইটি ছেলে বাড়িবাড়ি নিমন্ত্রণ করিতে আসিল। ছেলে দুটি পাড়ার এক প্রান্ত হইতে শুরু করিয়া প্রত্যেক বাড়িতে বলিয়া গেল, ঠাকুর সকল, ঘরে নি আছ, আমার একখানা কথা। ভারতের বাড়িতে আজ দশজনের সভা। তােমরার নিমন্ত্রণ। পান তামুক খাইবা, দশজনের দশকথা শুনবা।”

শুধু মালাে সম্প্রদায়েরই নয়, তিতাস-তীরের মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র ও বিশ্বস্ত ভঙ্গিতে রূপান্তিত করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। হিন্দু মুসলিমের সৌহার্দপূর্ণ জীবনযাপন এবং তাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা-চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে এ উপন্যাসে। মালােপাড়ার মাতবর রামপ্রসাদের সঙ্গে শরীয়তুল্লা বাহারুল্লার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় একটি অসাম্প্রদায়িক জনজীবনের চিত্রই ঔপন্যাসিক অঙ্কন করেছেন। এ উপন্যাসে লেখক মালাে সম্প্রদায় ও কৃষক সম্প্রদায়ের জীবনযাপন পদ্ধতির উৎস ও প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন রামপ্রসাদ ও বাহারুল্লার প্রেক্ষণবিন্দু থেকে। তাদের কথােপকথন লক্ষণীয়-

“বাহারুল্লা বলিল, “মাললাগুষ্টি সুখে আছে। মরছি আমরা চাষারা। ঘরে ধান থাকলে কি, কমরে একখানা গামছা জুটেনি? পাট বেচবার সময় কিছু টেকা হয়। কিন্তু খাজনা আর মহাজন সামলাইতে সব শেষ। কত চাষায় তখন জমি বেচে। তােমরা তারার দোয়ায় অখন অবধি আমার জমিতে হাত পড়ছে না। পরে কি হইব কওন যায় না।”

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের ‘জন্ম মৃত্যু বিবাহ’ অধ্যায়টি মালাে সম্প্রদায়ের বিবিধ উৎসব ও জীবনাচার বিষয়ক। জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ প্রসঙ্গে মালােপাড়ায় জীবনের যে সাড়া জাগে তা ই অভিজ্ঞতার ভাষা দিয়ে পরিবেশন করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। মালােপাড়ায় রামকেশবের পরিবারের যে বেদনাময় উপাখ্যান, তা যেমন সংবেদনাময় চিত্তকে আবেগায়িত করে, ঠিক তেমনি কালােবরণের পরিবারের সুখী জীবনযাপন ও উৎসব আনন্দ ও জনপদের বিপুল মানুষকে দেয় বৈচিত্র্যের আস্বাদ। মালােপাড়ায় নবাগত শিশুর বয়ােবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাকে কেন্দ্র করে পালিত হয় বিবিধ আচার-অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুর কল্যাণ। অনুষ্ঠানের রীতি পদ্ধতি লক্ষণীয়-

“ছয় দিনের দিন ঘরে দোয়াত কলম দেওয়া হইল। এই রাতে চিত্রগুপ্ত আসিয়া সে দোয়াত হইতে কালি তুলিয়া সেই কলমের সাহায্যে শিশুর কপালে লিখিয়া যায় তার ভাগ্যলিপি। অষ্টম দিনে আট কলাই।”

কালােবরণদের ছােটোবৌয়ের ছেলের অন্নপ্রাশন প্রসঙ্গে লেখক এ উপন্যাসে আরেকটি উৎসবের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। কালীপূজা উপলক্ষ্যে মালােপাড়া বিপুল সমারােহে জেগে ওঠে। কালীপূজা উপলক্ষ্যে আমােদ প্রমােদ ও নৃত্য সংগীতে মালো সম্প্রদায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেও উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিনে তারা ব্যয় করে খাওয়া দাওয়ার জন্য।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘রামধনু’। এ অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিঃস্ব বালক অনন্তের অসহায়-উদাস ও কল্পনাপ্রবণ মনােদৃষ্টিকেই কেবল উপস্থাপন করেননি, সে সঙ্গে তিতাস-তীরের জনজীবন ঘনিষ্ঠ জীবনচিত্রও আন্তরিকভাবে অঙ্কন করেছেন। কৃষক আর ধীবরের প্রেমময় ও সৌহার্দময় সম্পর্ক উপস্থাপনের সূত্রে লেখক এ অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা চেতনাও পরিবেশন করেছেন-

“এরা জেলে। চাষার জীবনের মতই এদের জীবন। উঁচু বলিয়া মানের ধূলি নিক্ষেপ করা যায় না এদের উপর, বরং সমান বলিয়া গলায় জড়াইয়া ধরিতেই ভালাে লাগে। কাটিলে কাটা যাইবে না, মুছিলে মুছা যাইবে না, এমনি যেন একটা সম্পর্ক আছে জেলেদের সঙ্গে চাষীদের।”

উপযুক্ত উদ্ধৃতিতে যেমন তিতাস তীরবর্তী মানুষের অসাম্প্রদায়িক জীবনচেতনা পরিস্ফুট হয়েছে, ঠিক তেমনি তাদের সংবেদশীল মনােদৃষ্টিও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মায়ের মৃত্যুর পর এরকম উদার সংবেদশীল জীবনপরিবেশে অনন্ত আশ্রয় খুঁজে পায়। অর্থনৈতিক অনটন সত্ত্বেও বাসন্তী মাতৃস্নেহে আগলে রাখে অনন্তকে। কিন্তু বালক অনন্ত অনন্তপথের অভিযাত্রিক। সংসারের সীমাবদ্ধ আঙিনা ছেড়ে সে ছড়িয়ে পড়তে চায় প্রকৃতির বিশাল সৌন্দর্যলােকে। মাতৃশ্রাদ্ধের দিন কয়েক পর গােকনঘাট পরিত্যাগ করে অনন্ত চলে যায় নবীনগর গ্রামে উদয়তারার পিত্রালয়ে। অনন্তকে কেন্দ্র করে বাসন্তীদের পারিবারিক কলহ যখন চরমে, তখন উপায়হীন বাসন্তীর তীব্র ভৎসনায় অতিষ্ঠ হয়ে অসহায় অনন্ত আশ্রয় নেয় উদয়তারার কাছে। স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনন্তের দৃষ্টিপথে উন্মােচিত হয় নতুন দিগন্ত।

নবীনগর গ্রামের নতুন পরিবেশে অনন্তের কিশাের মন নিত্যনব অভিজ্ঞতায় আন্দোলিত হয়। এ গ্রামের এক বৃদ্ধ বৈষ্ণব বৈষ্ণববাচিত বাৎসল্যরসে বিভাের হয়ে অনন্তের মধ্যে যশােদাদুলাল ও শচীনন্দনের সাদৃশ্য অনুভব করে। এ বৃদ্ধ বৈষ্ণবের সংস্পর্শ অনন্তকে দেয় অনুভববেদ্য কল্পনাশক্তি। এ গ্রামে শ্রাবণ মাসব্যাপী মনসার গান, পদ্মপুরাণপাঠ, বেহুলার চির-এয়ােতির স্মারক উৎসবরূপে ‘জালা-বিয়া’-র আয়ােজন এবং তজ্জনিত হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে অনন্তের কিশােরহৃদয় উদ্দীপিত ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। নবীনগর গ্রামে উদ্‌যাপিত পূজাপার্বণের মাধ্যমে অনন্তের মানস সংগঠনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এ গ্রামে এসে কিশােরী অনন্তবালার সঙ্গে সে হার্দ সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ হয়। এ সম্পর্ক ক্রমশ বিস্তারিত হয় পত্র পল্লবে। অনন্তের বেদনাময় অথচ চির উৎসুক জীবনযাত্রায় এ সম্পর্ক হয়ে ওঠে মহার্ঘস্বরূপ।

মালাে সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি যে সমাজের নিম্নতম স্তর পর্যন্ত এর আবেদন সঞ্চারিত করে সর্বসাধারণকে রুচি ও অনুভূতির এক মহিমান্বিত পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিল, তার কারণ এর অসাধারণ প্রাণশক্তি। উপন্যাসের এতদসংক্রান্ত একটি এলাকা লক্ষণীয়-

“মালােদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল। গানে গল্পে প্রবাদে এবং লােকসাহিত্যের অন্যান্য মালমসলায় যে সংস্কৃতি ছিল অপূর্ব। পূজায় পার্বণে, হাসিঠাট্টায় এবং দৈনন্দিন জীবনের আত্মপ্রকাশের ভাষাতে তাদের সংস্কৃত ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মালাে ভিন্ন অপর কারাে পক্ষে সে সংস্কৃতির ভিতরে প্রবেশ করার বা তার থেকে রস গ্রহণ করার পথ সুগম ছিল না। কারণ মালােদের সাহিত্য উপভােগ আর সকলের চাইতে স্বতন্ত্র পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত তাদের গানগুলি ভাবে যেমন মধুর, সুরেও তেমনি অন্তরস্পর্শী। সে ভাবের, সে সুরের মর্ম গ্রহণ অপরের পক্ষে সুসাধ্য নয়। ইহাকে মালােরা প্রাণের সঙ্গে মিশাইয়া নিয়াছিল, কিন্তু অপরে দেখিত ইহাকে বিদ্রুপের দৃষ্টিতে। আজ কোথায় যেন তাদের সে সংস্কৃতিতে ভাঙন ধরিয়াছে।”

মালােদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনে যে করুণ বিপত্তি নেমে আসে তা অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ভঙ্গিতে অদ্বৈত মল্লবর্মণ পরিবেশন করেছেন এ উপন্যাসের চতুর্থ খণ্ডের ‘ভাসমান’ অধ্যায়ে। যখনই মালােরা আত্মসংস্কৃতিতে উদাসীন, নিস্পৃহ ও বীতরাগ হয় তখনই বিনষ্টির মুখােমুখি হয় তাদের সমাজসংহতি, সহযােগিতামূলক মনােবৃত্তি, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, জীবনের মর্যাদাবােধ ও অস্তিত্বরক্ষার স্পৃহা। তাদের জীবনযাত্রা পরিবর্তিত হয় এবং তারা উপার্জনে হয় নিরুৎসাহিত।

উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে মহামারীর মতাে মৃত্যু এসে মালােদেরকে নিশ্চিহ্ন ও সর্বস্বান্ত করে দেয়। সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে কোনাে রকমে টিকে থাকে বাসন্তী আর কিশােরের বৃদ্ধ পিতা রামকেশব। অনন্ত কুমিল্লার শাহরিক পরিবেশে শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠলেও গােকনঘাটের মালাে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরুদূর। অনন্তবালারা চলে যায় আসামে। নিস্তব্ধ ও প্রায়লুপ্ত বিশাল মালােপড়া কালের সাক্ষী হয়ে হতশ্রী রূপ নিয়ে পড়ে থাকে। উপন্যাসের একেবারে অন্তিমে লেখক মালােপাড়ার যে হতদশা অঙ্কন করেছেন তা একান্তভাবে হৃদয়স্পর্শী-

“ধানকাটা শেষ হইয়া গিয়াছে। চরে আর একটিও ধানগাছ নাই। সেখানে এখন বর্ষার সাঁতার জল। চাহিলে কারাে মনেই হইবে না যে এখানে একটা চর ছিল। জলে থই থই করিতেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জল। দক্ষিণের সেই সুদূর হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালােপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে। কিন্তু এখন সে মালােপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালােপাড়া আর নাই। শূন্য ভিটাগুলিতে গাছ গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া সাে সাে শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দের তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।”

তাই সার্বিক আলােচনা থেকে বলা যায়- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস তীরের স্থানিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গে এতদঞ্চলের মালাে সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা, হতাশা-বেদনা এবং উত্থান পতনের বিস্ময়কর কাহিনি শিল্পসফলভাবে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ জীবনের অন্তর্কঠামাের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে চৈতন্য প্রবাহও যে পরিবর্তিত হয়ে যায় তা এ উপন্যাসের বিপুল পরিসরে প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মানসের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। তিতাস বিধৌত জনপদের স্থানিক বর্ণনার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস সাহিত্যে এটি একটি কালজয়ী সংযােজন।