ঈশ্বর গুপ্ত যে যুগে আবির্ভূত হন, সে যুগ ছিল নতুন ও পুরাতনের সন্ধিস্থল। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলা সংস্কৃতি ইংরেজ অভ্যুদয়ে বিরাট এক অভিঘাতের মুখোমুখি হল। এই অভিঘাতে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল তা অভূতপূর্ব। একে সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় বলা হয়েছে “Battle between the Oriental and Occidental”, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংঘাতে এদেশে যে সংস্কৃতি-দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল, তা এক সংকটের রূপ নেয়। ইংরেজ রোমান্টিক কবিতার প্রবর্তনায় এদেশের শিষ্ট সাহিত্যে বায়রণ, শেলী, কীটস ও ব্লেকের প্রভাব পড়েছিল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বিহারীলাল বা বায়রণের কাব্যেও এই প্রভাব-চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। হেমচন্দ্রকে কবিত্বের তুলাদণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে বিচার করা চলে। কিন্তু হেমচন্দ্রের কবিতায় শিষ্ট সমাজের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। মধুসূদন এই যুগের মহাকবি, কিন্তু তাঁর কাব্যেও রোমান্টিক কবিতার ছায়া পাওয়া যায়। নবযুগের ইংরেজি কাব্যের এই নবধারা বাংলা কাব্যকে প্রভাবিত করেছিল। ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর দুর্বার বন্যায় যখন তিরিশের দশক উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তখন এই নব্যতন্ত্রীদের সঙ্গে সরাসরি দ্বৈরথে নেমে পড়েছিলেন গুপ্ত কবি।

গুপ্ত কবি ছিলেন দোটানার কবি, কারণ পুরাতন ও নবীনের দ্বন্দ্বে তিনি ছিলেন দীর্ণ। একদিকে তিনি বাংলাসাহিত্যের আবহমানকালের অনার্য সংস্কৃতির ধারাকে শোষণ করেছেন, যা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ছিল। সম্পদ। মঙ্গলকাব্য, ব্রতকথা, ছড়া প্রভৃতি লোককথায় যে প্রাকৃত মনোভাব সৃষ্ট তার উত্তরাধিকারী ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। এইজন্য অনেক সমালোচক তাঁকে গ্রীক দেবী Janus-এর সঙ্গে তুলনা করেন। অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন—“বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁহার যে গুরুত্ব, তাহা ঐতিহাসিক গুরুত্ব। গ্রীক দেবতা ‘জেনাস’-এর (যাহার নাম হইতে জানুয়ারি মাসের উৎপত্তি) দুইটি মুখের একটি গত দিনের দিকে, আর একটি অনাগত দিনের দিকে। ঈশ্বরচন্দ্রকেও বাংলা সাহিত্যের ‘জেনাস’ বলা যায়, তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন আধুনিক যুগের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া দুইটি যুগকে একসূত্রে গ্রথিত করিয়া আছেন। তাঁহার এক মুখ প্রাচীন অতীতে, আর এক মুখ অনাগত ভবিষ্যতে। তাই তাঁর কার্যতায় একদিকে যেমন পুরাতন ধারার অনুবর্তন আছে, অন্যদিকে তেমনি নতুন ধারার ইঙ্গিতও আছে। সুতরাং ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় রসবিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে তাঁহার কবিতাগুলি বিশ্লেষণ করিয়া ইহার মধ্যে প্রাচীন, আধুনিক যুগের সূত্র দুইটি কেমন করিয়া একত্র বিধৃত হইয়া আছে তাহা দেখা দরকার।”

সমালোচক তাঁর কবিতাকে সমাজনিষ্ট মনের প্রকাশ হিসেবে বিচার করেছেন। তিনি যে সমাজে বাস করতেন, সে সমাজের স্ত্রীশিক্ষা, গো-হত্যা-নিবারণ, সমাজের আচার-অনাচার, বিদেশীদের অনুকরণ প্রিয়তা এই সব বিষয় বর্ণিত হয়েছে। সমাজের সঙ্গে যার যোগ ঘনিষ্ঠ, দৃঢ়বদ্ধ, তার পক্ষেই এই ধরনের কবিতা রচনা সম্ভব। তাঁর কবিতার আঙ্গিক রোমান্টিক কবিতার আঙ্গিক সচেতনতায় পূর্ণ নয়। তাঁর কবিতার ভাষা গদ্যভাষা, তাঁর কবিতা বিবৃতিমূলক। এই ধরনের কবিতাকে ‘Didactic poetry’ বা Poetry of statement’ বলা হয়। বাঙালির মুখের ভাষাকে, বাংলার বুলিকে তিনি কাব্যে স্থান দিয়েছেন। তাঁর কবিতা নিরাভরণ ভঙ্গীতে রচিত পয়ার ত্রিপদী। প্রাচীন বাংলা কাব্যসাহিত্যের পাঁচালী কাব্যের আঙ্গিকে তাঁর কবিতা রচিত। এই সবক্ষেত্রে কবি প্রাচীন ধারার অনুবর্তন রক্ষা করেছেন।

সমাজচিন্তার ক্ষেত্রেও তিনি সংরক্ষণশীল। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের ব্যঙ্গ করে লিখেছেন—

‘বিবিজান চলে যান লবেজান ক’রে।

শাড়ীপরা এলো চুল আমাদের মেম

বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্।

সিন্দুরের বিন্দু সহ কপালেতে উচ্চি৷৷

নসী, যসী, ক্ষেমী, রামী, যামী, শামী, গুল্কি”।

এই চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়—

‘আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল

ব্রতধর্ম করতে হবে।

একা বেথুন এসে শেষ করেছে,

আর কি, তাদের তেমন পাবে।’

বিধবা বিবাহ লেখক পছন্দ করেন না, কিন্তু বিলাত থেকে সে আইন প্রত্যাহারের সম্ভাবনাও তাঁকে বিচলিত করে। এদিকে তিনি লেখেন—

“কালগুণে এই দেশে বিপরীত সব। 

দেখে শুনে মুখে আর নাহি সরে রব।

একদিকে কোশাকুশী আয়োজন নানা।

আরদিকে টেবিলে ডেবিল খায় খানা। 

পিতা দেয় গলে সূত্র, পুত্র দেয় কেটে।

বাপ পুজে ভগবতী, বেটা দেয় পেটে।”

দুই প্রজন্মের এই দ্বন্দ্ব বর্ণনার সাহায্যে বীরত্ব কৌতুক-শ্লেষ-বিদ্ধ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্ত করা চলে যে ‘ঈশ্বরচন্দ্র তিক্ত দ্বিধায় সীমাবদ্ধ। উনিশ শতকের সমাজের সংস্কৃতির যে আপাতবিরোধ তা ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় এইভাবে ধরা পড়েছে।

সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে ঈশ্বর গুপ্ত আশাবাদী নন। তিনি মনে করেন, দেশজ সংস্কৃতি শেষ হয়ে গেছে। এদেশের মেয়েরা চালাকচতুর ও আধুনিক হয়ে উঠবে, ক্রমে সভ্য হয়ে উঠবে, তারা সাঁজ-সেঁজুতির ব্রত আর করবে না, তারা সমাদরে পিঁড়ি পেতে গুরুজন ও প্রিয়জনদের খেতে দেবে না। তারা গুঠন খুলে সেজেগুজে সভায় যাবে, পার্টি করবে, গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে নিজের হাতে গাড়ী চালিয়ে ছুটবে। এই ছিল প্রাচীনপন্থী মানুষের পক্ষে বেদনার চিত্র, কারণ দেশজ ঐতিহ্যের এখানে অবসান হয়ে যায়। কবির উদ্ধৃতিতে—

“লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল,

তারাই এখন চড়বে ঘোড়া।

ঠাটঠমকে চালাকচতুর

সভ্য হবে থোড়া থোড়া!

আর কি এরা এমন ক’রে

সাঁজ সেঁজুতির ব্রত নেবে? 

আর কি এরা আদর করে

পিড়ি পেতে অন্ন দেবে?

পর্দা তুলে’ ঘোমটা খুলে

সেজেগুজে সভায় যাবে। 

আপন হাতে হাঁকিয়ে বর্গী

গড়ের মাঠের হাওয়া খাবে।”

কবি ছিলেন ভিক্টোরিয়ার ভক্ত, তিনি লিখেছিলেন,

‘ওগো মা ভিক্টোরিয়া

কর গো মানা, যত তোর রাঙা ছেলে আর যেন মা 

চোখ রাঙে না চৌখ রাঙে না।।”

তিনিই আবার মার্শম্যানকে বিদায় দেন :

“শুনিতেছি বাবাজান এই তব গণ 

সাক্ষ্য দিতে করিতেছ বিলাতে গমন।।

জোড় করে পশুপতি করি নিবেদন।

সেখানে কোরো না গিয়ে প্রজার পীড়ন।।

ভূত প্রেত সঙ্গীগুলি সঙ্গে লয়ে যাও। 

এখানে বলিয়া কেন মাথা আর খাও? 

বাজাই বিজয়ী বাদ্য টস টস্ টম্ 

কিসে তুমি কম?

বাজাও ব্রিটিশ শিঙে বম বম বম্।”

এইভাবে তাঁর কাব্য আলোচনা করলে দেখা যায়, যে গুপ্ত কবির স্ববিরোধিতা ছিল অসামান্য। এইজন্য তাঁকে সমালোচক গ্রীক দেবী Janus-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। গুপ্ত কবি প্রাকৃত পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, তাই তাঁর মন দেশজ সংস্কৃতিতে বদ্ধ। কিন্তু নতুন যুগের হাওয়া কখনো কখনো তিনি গ্রহণ করেছেন। এই জন্যই তাকে আপাত বিরোধের কবি বলা হয়।