‘তামাদি আইন’ একটি  সময় নির্দেশক পদ্ধতিগত আইন[Procedural/adjective law]। এ আইনটি মূলত ল্যাটিন ম্যাক্সিম ‘Interest Reipublicae Ut Sit Finis Litium'[সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের স্বার্থে মামলার একটি সীমা থাকা উচিত।]  ‘vigilantibus non dormientibus Jura subveniunt’ [আইন জাগ্রতদের সহায়তা করে যারা তাদের অধিকারের ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক, যারা ঘুমিয়ে থাকে অর্থাৎ অধিকারের প্রতি উদাসীন আইন তাদেরকে সাহায্য করে না।] ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের তামাদি আইন-১৯০৮ কার্যকর আছে। এ আইন দখলের মাধ্যমে  ব্যবহার  স্বত্ব ও অন্যান্য সম্পত্তির ownership অর্জনের নিয়মাবলী সরবরাহ করে থাকে। যদি কোন ব্যক্তি তার প্রাপ্য আইনগত অধিকার আদায়ে কোন নির্দিষ্ট সময় অবধি পর্যন্ত উদাসীন থাকে অর্থাৎ আইনগতভাবে সামনে অগ্রসর না হয় তবে ওই ব্যক্তিকে তার অধিকার বিষয়ে মামলা দায়ের করতে আইন অনুমোদন করে না। যদি কোন ব্যক্তির আইনগত অধিকার সত্যি সত্যিই থাকে, তবে তা দ্রুত অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন- এটাই সত্য। তাই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে ব্যক্তি তার আইনগত দাবি বা অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা না করলে তা তামাদি আইনের বিধান অনুসারে বিনষ্ট  হয়েছে বলে গণ্য করা  হয়।

তামাদি আইন কি

What is the limitation act 

‘তামাদি’ শব্দটি একটি Loan-word [একভাষা থেকে অন্যভাষায় গৃহীত শব্দ]। কেননা, ‘তামাদি’ [تمادى] মূলত একটি আরবি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ বিলুপ্ত বা অচল বা ‘দাবি করার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত’ time-barred। পরবর্তিতে ‘তামাদি’ শব্দটি ফার্সি ভাষাতেও গৃহীত হয়। যাহোক, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আইনগত দাবি আদায় না করলে উক্ত দাবি বিলুপ্ত বা অচল বা  নষ্ট হয়েছে বলে গণ্য করাকে আইনের ভাষায় তামাদি বলে।

এবার আসি তামাদি আইন কি? দেখুন, তামাদি আইন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ যেখানে সকল প্রকার আইনগত দাবী বা স্বত্বের ক্ষেত্রে পক্ষগণের মধ্যে পারষ্পারিক বিরোধকে দীর্ঘায়িত না করে তা চিরদিনের জন্য নিষ্পত্তি করতে সাহায্য করে। তামাদি আইনে নির্দিষ্ট মামলার জন্য যে নির্দিষ্ট সময়সীমা আইনে উল্লেখ রয়েছে সেই সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের করতে না পারলে আদালত ঐ মামলা বাধ্যতামূলক খারিজ করবেন। নির্দিষ্ট সময়সীমার পর মামলা, আপীল বা দরখাস্ত দায়ের এবং আদালত হতে তা বাধ্যতামূলকভাবে খারিজ হওয়ার এই প্রক্রিয়াকেই সংক্ষেপে ‘তামাদি’ বলা হয়। [A. Ali Vs. District Judge;   21 DLR (SC) 139 ]

কোন তর্ক, প্রশ্ন ও বিবাদকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখা মানব সমাজের জন্য নিতান্তই ক্ষতিকর। উপরন্ত সামাজিক শৃঙ্খলার কারণে এক সময় এর ওপর ছেদ টানতে হয় এবং তামাদি আইন সেই ছেদ টানার ব্যবস্থা করে থাকে। [Rajendra Vs. Shanta; AIR 1973 (SC) 2537] 

তামাদি আইন ব্যাপকভাবে দেওয়ানী প্রতিকারে বাধা প্রদান করে থাকে। তামাদি আইন কখনই কোন ব্যক্তিকে মামলা দায়ের করতে উৎসাহিত করে না, তবে তামাদি আইন ঘোষণা করে যে, একটি বিশেষ সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর আর মামলা করা চলবে না। [New Delhi Vs. Employes Asso.; AIR 1972 (SC) 1935] 

যাহোক, আদালতে মামলা, আপীল বা অন্য কোন প্রকার দরখাস্ত দায়েরের সময়সীমা তামাদি আইনের প্রথম তফসিলে নির্ধারণ করা আছে। তামাদি আইনের প্রস্তাবনায় বলা আছে, ‘দেওয়ানী মামলার সময়সীমা বিষয়ক আইন একীভূত ও সংশোধণার্থে ও অন্যান্য লক্ষ্যে প্রণীত আইন।’ এ থেকে  বলা যায় যে, সকল প্রকার দেওয়ানী আইনগত দাবী বা স্বত্বের ক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য তামাদি আইনের সৃষ্টি হয়েছে । উল্লেখ্য, মূল মামলায় তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হয় মামলার কারণ [Cause of action] উদ্ভবের সময় থেকে এবং বাদীর বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ গণনা করা হয়। আর একটি কথা, তামাদি আইন যেহেতু একটি দেওয়ানী প্রকৃতির আইন। তাই, এ আইনে  রুজুকৃত মামলা দেওয়ানি আদালতে পরিচালিত হয়ে থাকে।

তামাদি আইনের উদ্দেশ্যাবলী

[Objects of the limitation act] 

তামাদি আইন-১৯০৮ এর বিধানাবলী বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যসমূহ পাওয়া যায়-

১. কোন দেওয়ানী মামলা-মোকদ্দমা, আপীল ও নির্দিষ্ট কিছু আবেদনপত্র আদালতে দায়ের করার মেয়াদ নির্ধারণ করা;

২. দখলের মাধ্যমে ব্যবহার স্বত্ব এবং অন্যান্য সম্পত্তির অধিকার অর্জনের নির্ধারিত নিয়ম নীতি [সময়সীমা ইত্যাদি] সরবরাহ করা;

৩. ব্যক্তির আইনগত দাবি বা অধিকার কোন সময়সীমার মধ্যে আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে তা নির্ধারণ করা। এতে করে সমাজে বিবাদ  দ্রুত নিস্পত্তির মাধ্যমে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়;

৪. মামলা-মোকদ্দমার দীর্ঘসূত্রিতা বজায় না রেখে জন-ভোগান্তি লাঘব করা; 

৫. তামাদি আইনের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো কোন মামলার জটিলতা রোধ করা; 

৬. মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা রোধ করে অর্থের অপচয়  বন্ধ করা; 

৭. নাগরিকদের প্রাপ্য আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতারণামূলক কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করা; 

৮. কোন অধিকার সচেতন ব্যক্তির প্রাপ্য আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সহায়তা করা;

৯.তামাদি আইনের মাধ্যমে ব্যক্তির আইনগত দাবি/অধিকারের দ্বন্দ্বকে প্রলম্বিত না করে স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা। 

মোটকথা, কোন  বিবাদ [আইনগত অধিকার/দাবি] নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ অনির্দিষ্ট সবার জন্য উন্মুক্ত না রেখে বরং ফলপ্রসূ নিশাত স্বার্থে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বা মেয়াদকাল সংরক্ষণের নির্মিত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো তামাদি আইনের মূল উদ্দেশ্য। এর ফলে প্রতিটি নাগরিক তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। কেননা, অধিকারের বিষয়ে নাগরিকের উদাসীনতা আইন-আদালত নিরুৎসাহিত করে এবং ব্যক্তিকে সহায়তা প্রদান করে না। এ বিষয়ে 19 DLR 514 তে বলা হয়েছে যে, যার দাবি যথাযথ, তিনি তা আদায় করতে তৎপর থাকবেন- এটাই আইন কামনা করে। 

তামাদি আইন কি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন

……