কবি বুদ্ধদেব বসুর কথা আসতেই প্রথমেই মনে পড়বে কল্লোল পর্বের কথা যে কল্লোর পর্বের কবি গোষ্ঠীরা এক যোগে রবীন্দ্র বিরোধিতায় নেমে পড়েছিলেন। যাঁদের মূল উদ্দেশ্য নতুন কিছু করা, রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করে রবীন্দ্রনাথে হারিয়ে যাওয়া নয়, একটা স্বতন্ত্র পথের দিশারি হয়ে কাব্য সমুদ্রে অবগাহন করতে হবে। এই কল্লোল পর্বের প্রধান এবং নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। যাঁর রচনায় সর্বপ্রথম পাওয়া যায় রবীন্দ্র বিরোধিতার সুর। রবীন্দ্রনাথ এক সময় বলেছিলেন, প্রকৃত সমালোচনাই হল—পূজা, অর্থাৎ সমালোচনার আর এক নাম পূজা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একথাগুলো কবি বুদ্ধদেব বসু বোধকরি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। আর কোনও কবি যখন সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, সেখানে ফুটে ওঠে অপূর্ব শিল্প সুষমা। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, তাঁর ‘প্রবন্ধ সংকলন’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধক’ প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন রবীন্দ্র সমসাময়িক কিংবা তাঁর পরবর্তী কবিরা রবীন্দ্রনাথকে পরিহার করতে গিয়ে অথবা গ্রহণ করতে গিয়ে নিজেদের এবং অপরকে কত প্রকারে ঠকিয়েছেন যা সমগ্র বাংলা কাব্যের জগতে হাস্যাস্পদ হয়ে আজও বিরাজমান।

রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধক প্রবন্ধে লেখক বুদ্ধদেব বসু সর্বপ্রথম স্বভাব-কবি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কাব্যের জগতে ‘স্বভাব কবি’ নামক এই শব্দটি প্রচলিত আছে সে সম্বন্ধে আমরা কী বুঝি এবং কাদের কাদের এই পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি তা তিনি প্রমাণ সহযোগে আলোচনা করেছেন। ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাসকে স্বভাব কবি হিসাবে চিহ্নিত করে এর একটা নিখুঁত সংজ্ঞাও প্রদান করেছেন—“যিনি একান্তই হৃদয় নির্ভর প্রেরণায় বিশ্বাসী, অর্থাৎ যিনি যখন যেমন প্রাণ চায় লিখে যান। কিন্তু কখনোই লেখার বিষয়ে চিন্তা করেন না, যার মনের সংসারে হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির সনাতন সম্বন্ধ।” স্বভাব কবির এই বৈশিষ্ট্য নিরূপণের পর গোবিন্দ দাস কেন স্বভাব কবি তা তিনি তথ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেন। এই স্বভাব কবি যেমন ব্যক্তিগত কারণে সৃষ্টি হয় তেমনি আবার ঐতিহাসিক কারণেও সৃষ্টি হয়। এই প্রসঙ্গে নজরুলের কথা টেনে এনে তিনি বলেছেন সময় পরিবেশ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলকে স্বভাব কবি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।

ঐতিহাসিক সূত্রে স্বভাব কবিত্ব নিরূপণে নজরুলের প্রসঙ্গ এলেও প্রাবন্ধিকের মূল বক্তব্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তিনি জানিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ছিল আকাস্মিক, অভাবিত। কারণ, রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে কাব্যের অঙ্গনে রবীন্দ্র প্রতিভার কোনো সূত্রের লক্ষণ অনুপস্থিত ছিল। দাশরথি রায়ের পাঁচালি, রাম প্রসাদের মাতৃভক্তি, ঈশ্বর গুপ্তের সাংবাদিক সুলভ কবিত্ব, মধুসূদনের বীররস পূর্ণ তুর্য ধ্বনির সঙ্গে কোথাও মিল ছিল না রবীন্দ্রনাথের কবি বৈশিষ্ট্য। তাই সেই সময়ে বজ্র নির্দোষের মতো সূর্যের রঙিন আলোকচ্ছটা বিকিরণের ন্যায় ধূমকেতুসম রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব পাঠককুল সহজেই মেনে নিতে পারেনি। সবাই একযোগে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে—এক কথায় “বিস্মিত, মুগ্ধ, বিচলিত, বিব্রত, ক্রুদ্ধ এবং আবির্ভূত।” সমালোচকের ভাষায় রবীন্দ্রনাথের লেখনি “সমালোচনার মহলে নিন্দার অবিরাম উত্তেজনা।” অর্থাৎ সমালোচক প্রমাণ করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ যে কৌশলে কাব্যের জগতে অবতীর্ণ হন তা সহজেই উপভোগ করার মতো মানসিক পরিণত হয়ে ওঠেনি তখনকার পাঠককুল, তাই তারা রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে মগ্ন হয়ে পড়লেন—সহজ সরল গদ্যে লেখা শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে ও ছন্দের চাকচিক্যময় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যে।

রবীন্দ্র প্রতিভা যখন মধ্য গগনে বিরাজমান তখন সমগ্র বঙ্গ-সাহিত্য জুড়ে চলল— পুরাতনের সঙ্গে নতুনের সংঘর্ষ। সে সংঘর্ষে পাঠককুল প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ল। সমালোচকের মতে প্রায় দু’দশক জুড়ে এই সংঘর্ষ চলেছিল। এই সময়ে যে সকল কবিদের আবির্ভাব ঘটেছিল স্বভাবতই তাদের দায়িত্ব বেড়ে যায়, কারণ রবীন্দ্রনাথ যতদিন পর্যন্ত পাঠকদের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে ততদিন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত করার জন্যে এই সমসাময়িক কবিদের দায়িত্ব সহকারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যদি পাঠক হৃদয় জয় করতে পারে তবে তাদেরও পথ মসৃণ হয়ে যাবে। এই পরিকল্পনার ফলেই দেখা দিল মহাসংকট। তাদের পক্ষে যেমন রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করতে হল তেমন তাকে এড়িয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। এই ভাবধারা গ্রহণ করার ফলে এক শ্রেণির নতুন কবি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হল। যেমন—– যতীন্দ্রমোহন, করুণানিধান, কিরণধন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি। এঁদের সম্পর্কে প্রাবন্ধিক বললেন—“তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিল রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ এবং অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ।”

বাংলা কাব্য জগতে যখন মধ্যযুগীয় অক্ষরবৃত্ত সুরে পাঁচালি, ভক্তিগীতি, বীররসের সুর প্রবহমান ঠিক সেই পরম লগ্নে রবীন্দ্রনাথ এলেন নতুন সুর নিয়ে। যে সুরের ব্যাপকতা, গভীরতা ছিল সুদূর প্রসারী। যার জ্যোতি ছিল সূর্যের ন্যায়। সেই জ্যোতিকে ম্লান করার মতো তেমন কোনো প্রতিভাধর কবির জন্ম ঘটেনি। তাই যাঁরা এসেছিলেন তারা সশ্রদ্ধচিত্তে রবীন্দ্রনাথকে বরণ করে নিয়েছেন। এ সম্পর্কে আরও গভীরতর কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক যা লিখেছেন তা থেকে বোঝা যায়—

  • (১) রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের ফলে বাংলা কবিতা লেখার কাজ আরও কঠিন হয়ে গেল। 

  • (২) রবীন্দ্রনাথকে ভালোভাবে না বুঝে তাঁর ভাব ভাষা ছন্দকে অনুসরণ করতে গিয়ে অন্যান্য কবিরা অনুকরণ দোষে দুষ্ট হয়ে পড়লেন। 

  • (৩) রবীন্দ্রানুসারীরা রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করতে গিয়ে ঠকলেন এবং বুঝলেন, এই অনুকরণ কত অসাধ্য এবং তা তাদের সামর্থ্যের বাইরে। 

  • (৪) রবীন্দ্রনাথের রচনাশৈলী এত সহজ ও শোভন ছিল যে অগ্নিতে পতোম্মুখ পতঙ্গের মতো রবীন্দ্রানুসারীরা সহজেই তাতে ঝাঁপ দিলেন। প্রাবন্ধিকের ভাষায়— “রবীন্দ্রনাথের মতো হতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথেই হারিয়ে গেলেন তাঁরা বড়ো জোর তাঁর ছেলেমানুষী সংস্করণ লিখলেন।”

  • (৫) রবীন্দ্রনাথের কাব্যের বড়ো বৈশিষ্ট্য হল কোনো অবলম্বন ছাড়াই পাঠকের কাছে ব্যক্ত করা, এককথায় স্বনির্ভর। সেটাই পরবর্তী কবিদের কাছে হয়ে উঠল বিপজ্জনক। 

  • (৬) রবীন্দ্রনাথের কাব্যের উপাদান ছিল তার চেনা জগতের তার চার পাশের প্রকৃতি পরিবেশ থেকে নেওয়া, অথচ তাঁর ভক্তরা সেটাকেই সহজ মনে করে বিষম ঠকলেন। তাই রবীন্দ্র প্রতিভার গুণগুলি সহজ সরল প্রাঞ্জল হলেও তা হজম করা দুসাধ্য ছিল।

সমালোচক বুদ্ধদেব বসু, রবীন্দ্রানুসারী কবি ভক্ত সমাজকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একই সময়ে আবির্ভাব হয়েও রবীন্দ্রনাথ থেকে নতুন একটা পথের সন্ধান দিলেন। সেটা তাঁর ছন্দের যাদুকরী কৌশল, রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য গভীরভাবে লাভ করেও একটা বিদ্রোহের ভাব নিয়ে কাব্যের জগতে আবির্ভূত হলেন বটে তবে নিজেকে প্রতারিত করা ছাড়া কিছুই পেলেন না। কেবলমাত্র ছন্দের স্বাতন্ত্র্যের দ্বারা নিজেকে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছিলেন, তবে এই ছন্দের যে অন্তরাত্মা ভাব তা মূলত রবীন্দ্রনাথেরই অনুসরণ মাত্র। একদা রবীন্দ্রনাথ নিজেই চণ্ডীদাসের পদাবলি পড়ে বিস্মিত হয়েছেন এবং মুগ্ধ চিত্তে বলেছেন—চণ্ডীদাস এক কথা বলেন আর পাঠককে দিয়ে দশ কথা বলিয়ে নেন। অনুরূপ ভাবে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ এক কথা লেখেন—তা দশ কথা পাঠকদের কাছ থেকে লিখিয়ে নেন। সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ কবিরা সেখানেই মস্ত ভুল করলেন—রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে লিখলেন বটে কিন্তু পাঠকের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারলেন না। ছন্দের যাদুকরী স্পর্শে ক্ষণিকের জন্যে পাঠককুল মুগ্ধ হলেও পরে তা আবার স্বাভাবিক খাতেই বইতে থাকল। তাই অনুকরণ যেমন অনিবার্য ছিল এবং প্রকৃত অনুকরণ তেমন অসম্ভব হয়ে পড়লো।

এই প্রসঙ্গে সমালোচক বলতে ভুল করেননি, সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দ ছিল মূলত–“শুধু মিহি সুর, ঠুনকো আওয়াজ, চটপটে তাল, আর উদ্দেশ্যহীন কসরৎ। শুধু ছন্দের জন্যই ছন্দ লেখা।” উদাহরণ স্বরূপ বলেছেন—“সত্যেন্দ্রনাথের তুলতুল টুকটুক/টুকটুক তুলতুল/কোন ফুল তারতুল/নেই তুল কোনও ফুল।” যে তুলনা রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা—“ওগো বধূ সুন্দরী/তুমি মধু মঞ্জুরি।” গাণিতিক দিক থেকে হয়তো সম পর্যায়ভুক্ত কিন্তু—“ওগো বধু সুন্দরীতে প্রাণের যে স্পর্শটুকু আছে, যার জন্য ওটি কবিতা হতে পেরেছে।” আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখাটি কেবলমাত্র ছন্দ হয়েই রইল। সচকিত বিদ্যুৎচমকের মতো ছন্দের এই আকস্মিক আবির্ভাব পাঠককুলকে বিস্মিত বিমূঢ় করে তুললেও তা সাময়িক মাত্র। সমালোচক বলেছেন—“সেই সময়ে যে সব ভুরি পরিমাণ নির্দোষ, সুশ্রাব্য এবং অন্তসার শূন্য রচনা কবিতা নাম ধরে বাংলা ভাষায় মাসিক পত্রে বোঝাই হয়ে উঠেছিল, কালের সম্মার্জনী ইতিমধ্যেই তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।” তাই বলতে হয় রবীন্দ্রনাথ “একমেব অদ্বিতীয়ম।” তাঁর সমতুল্য কেহ ছিল না। যাঁরা হতে চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের সমুচিত খেসারত দিতে হয়েছিল।