সর্বকালের বিশিষ্ট মনস্বী প্রাবন্ধিক অন্নদাশংকর রায় তাঁর “যে দেশে বহুধর্ম বহুভাষা” প্রবন্ধে প্রধানত বহুধর্মী রাষ্ট্র ভারতের ধর্ম ও ভাষা সম্বন্ধীয় মূল নীতি কী হওয়া উচিত সে বিষয় তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ প্রসূত মূল্যবান অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বহুধর্মের দেশে ভারতবর্ষ সে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম কিংবা অপর কোনো ধর্মকেই স্বীকৃত না দিয়ে নিজেকে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করে শুধু যথার্থ ন্যায়নীতি বোধের ও সুবিবেচনারই পরিচয় দিয়েছে, তা’ নয় এক নামকত্বের হাত থেকেও নিষ্কৃতি পেয়েছে। ভাষার প্রশ্নটি অনেকখানি জটিলতার। কারণ, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার বলেই সেখানে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকতে পারে, কিন্তু পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানের প্রধানতম মাধ্যমে ভাষা-বিষয়ে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকতে পারে না, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার জন্য কোনো না কোনো ভাষা ব্যবহার আবশ্যক। এই কারণেই এই বিষয়ে বিশেষভাবে বিবেচনার প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধর্মের ক্ষেত্রে যারা উদারতা দেখাতে পেরেছেন ভাষার ক্ষেত্রে তারা বহুভাষী রাষ্ট্রে ও একটিমাত্র রাষ্ট্র ভাষার সপক্ষতা করে অধিকাংশ লোকের ইচ্ছাকে মানতে গিয়ে অপর সকলকে বঞ্চিত করে শুধুমাত্র হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন। অথচ এর পিছনে সকলের সম্মতি নেই। ভারতের অহিন্দিভাষীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হবার আশঙ্কাগ্রস্থ। ধর্মের মতোই ভাষার ব্যাপারেও আমাদের বিজ্ঞতার পরিচয় দান প্রয়োজন।
হিন্দির পূর্বে ইংরেজিই ছিল ভারতের সরকারি ভাষা। এক সময়ে দায়ে পড়ে ইংরেজিকে মেনে নিতে হলেও কালক্রমে তাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এক্ষণে হিন্দি তস্থলবর্তী হওয়াতে মনে হতে পারে যে বিরোধটা বুঝি ইংরেজির সঙ্গে হিন্দির নিয়ে। কিন্তু আসল তর্কটা হিন্দি বনাম ইংরেজি নিয়ে নয়। ১৯৬৫ খ্রিঃ আপাত-ব্যবস্থা হিসাবে হিন্দিকেও রাখা হয়েছে। কিন্তু এরপর যদি ইংরেজিকে বিদায় দিয়ে হিন্দিকেই একচ্ছত্রাধিপত্য দেওয়া হয়, তবে তার বিরোধ বাঁধবে ভারতের অবশিষ্ট প্রায় সকল ভাষার সঙ্গেই। কারণ এখনই ভিন্ন ভাষা-ভাষীদের অনেকেই হিন্দির বিরোধিতা করে যাচ্ছে। এখানকার শাসক দল হিন্দির পক্ষপাতী হতে পারেন, পরবর্তীকালে যদি এমন কোনো দলের হাতে শাসন ক্ষমতা যায়, যারা হিন্দির পক্ষপাতী নয়, তারা অহিন্দিভাষীদের হিন্দিভাষীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারেন। ফলত লড়াই বেঁধে যাবে হিন্দির সঙ্গে তামিল বাংলা, পাঞ্জাবি প্রভৃতি ভাষার। কারণ, তারা দেখবে, জন্মসূত্রেই হিন্দিভাষী রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নে এক কদম এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু হিন্দির কি সেই যোগ্যতা আছে ? বিষয়টা একটু বিচার করে দেখা যেতে পারে।
হিন্দি যে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে, তার সপক্ষে একটি মাত্র যুক্তি রয়েছে—অধিকাংশ লোক হিন্দি চায়, অধিকাংশ লোকের ইচ্ছাই চূড়ান্ত মর্যাদা পেল। ভারতের স্বাধীনতার পর সংবিধান রচনার সময় রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বিভক্ত—একদল হিন্দিকে চাইছেন অপর দল ইংরেজিকে। সদস্যের সংখ্যা প্রায় সমান সমান, একটি মাত্র ভোটের ব্যবধানে হিন্দিভাষীরা জয়ী হওয়ায় হিন্দিই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেল, অর্ধেক সদস্যের অর্থাৎ অর্ধভারতের প্রতিনিধিদের মতবাদ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হল। সংবিধান রচয়িতাগণ পরিষদ খুবই সুবিবেচনার পরিচয় দিতেন, যদি তখনই হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা গ্রহণ করা হত। তাহলে অধিকাংশের নয়, সর্বসম্মত ভাবেই রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি পেত। ধর্মের ক্ষেত্রে যেমন, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনি গণতন্ত্রের মর্যাদা পরিপূর্ণভাবে রক্ষিত হত।
হিন্দির সপক্ষে এবং ইংরেজির বিপক্ষে আর একটা যুক্তি (কুযুক্তি) দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয় যে ইংরেজি বিদেশি ভাষা বলেই পরিত্যাজ্য, অতএব বিকল্প বহুজন্মের ভাষা হিন্দি। আমরা ইংরেজের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি, সেই দোহাই দিয়ে কি ইংরেজি তথা তাবৎ বিদেশি বস্তুকেই তাড়াতে চাই? আমাদের শাসনব্যবস্থা, বিদেশি সংবিধান, আইন-আদালত, স্কুল-কলেজ, সিনেমা-থিয়েটার, ট্রেন-বাস, সবই তো বিদেশি। এসবও তাড়াবো? আসলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। যুগোপযোগী চিন্তা ও ভাবের অনুকূল করে জাতীয় স্তরে আমাদের চিন্তা করতে হবে। ভারতের মতো বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় দেশে ভাষার সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
তাই জাতীয়তা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার খাতিরে হিন্দিকেও রাষ্ট্র ভাষা করা হোক। কিন্তু তার সঙ্গে অপর কোনো ভাষা নয় কেন? এবং উচ্চ শিক্ষা ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে শুধু সেই অপর ভাষা-ভাষীরই ন্যায়-নীতিবোধ পীড়িত হয় না, কাউকে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয় না। কিন্তু এটি হচ্ছে না সম্ভবত এই কারণে যে, এ জাতীয় ব্যবস্থার তামিল বাঙালি বা অপর ভিন্ন ভাষীরাই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে হিন্দিভাষীরা পিছিয়ে থাকবে এমন হয়তো আর যদি ইংরেজির ব্যাপারে কোনো উন্নাসিকতা থাকেই, তবে প্রত্যেককে তার নিজস্ব মাতৃভাষার পরীক্ষাদানের সুযোগ এবং অধিকার দিতে হবে, যেমনটি পাচ্ছে হিন্দিভাষীরা।
ইংরেজিকে যদি বিদায় করে দেওয়া হয়, তাহলে হিন্দি একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়ে যাবে, এবং অপরের ওপর অধিকার বিস্তারের প্রয়াস দেখা যাবে। কিন্তু অপর ভাষাভাষারী অবশ্যই নতমস্তকে সেই অধীনতা স্বীকার করে নেবেনা। তামিল ভাষার ভিত্তিতে স্বতন্ত্রতার যে আন্দোলন দেখা দিয়েছে, তেমন আন্দোলন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়বে এবং তার ফল দেশের পক্ষে ভয়াবহ আকার দেখা দিতে পারে। ১৯৬২ সালে লিখিত এই প্রবন্ধ পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা রূপে একক ভাবে উর্দুর পরিণতি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে এটা তারা কোনোকালেই মেনে নেবে না …উর্দু ভাষীরা যদি মানতে নারাজ হয়, তবে রাষ্ট্র দুভাষা হয়ে যাবে।” এর দশ বৎসরের মধ্যেই ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান দুভাগ হল, স্বাধীন বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি হল। আশঙ্কা হয়, জোর করে একটি মাত্র হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষার আসনে বসালে ভারতেরও অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
আর হিন্দিকে ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা বলে নিঃসন্দেহে স্বীকার করে নেওয়া চলে। সেদিক থেকে তার গুরুত্ব অবশ্য স্বীকার্য। ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলে হিন্দিভাষা মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হয় না, সেই সমস্ত অঞ্চলেও হিন্দির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হবার যে যোগ্যতা, তা তো হিন্দির নেই। হিন্দিতে শিক্ষণীয় বিষয় কিছু নেই, তার লোভে কেউ হিন্দি শিখতে চাইবে। এছাড়া হিন্দি ব্যাকরণও যথেষ্ট জটিল। বলা হয় ‘মহাত্মা গান্ধি কী জয়’—এখানে ‘কা’ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হিন্দি ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে ‘জয়’ স্ত্রীলিঙ্গ বলেই তার বিশেষণ এবং ক্রিয়াকেও স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ‘জয়’ স্ত্রীলিঙ্গ কেন ? কারণ এর প্রতি শব্দ ফার্সি ভাষার ‘ফতে’ স্ত্রীলিঙ্গ বলে। কী মুক্তিহীন নিয়ম । হিন্দির উন্নতি বিধান প্রয়োজন, হিন্দি যদি দেবনাগরীর মোহ কাটিয়ে, রোমান, বাংলা প্রভৃতি লিপিতে হয়, যদি সে উর্দুকে আত্মসাৎ করে নিতে পারে এবং যদি তার ব্যাকরণের জটিলতা কমিয়ে আনতে পারে, তখনই হয়তো হিন্দি সকলের আগ্রহ সঞ্চার করতে পারবে, আর হয়তো এক পুরুষের মধ্যেই অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারবে।
তাই প্রাবন্ধিক অন্নদাশংকর স্পষ্টভাবে তাঁর অতিমত প্রকাশ না করলেও তিনি ভাষা সমস্যার সমাধানের কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর মতে ইংরেজির বদলে এমন একটি ভাষাকে হিন্দির সঙ্গে বন্ধনীভূক্ত করা যে ভাষা আমাদের ন্যায়বোধকে পীড়া দেবে না। যে ভাষাটি কোনো ভাষা, অহিন্দিভাষীদের দ্বারাই সেটি স্থির হোক। তাছাড়া তিনি সংস্কৃতকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চান, সংস্কৃত ভাষাকে সর্বোপযোগী করে সর্ব সাধারণের ব্যবহারের উপযোগী করে তার ব্যাকরণ প্রভৃতিকে সরলীকরণের মাধ্যমে গ্রহণ করা যেতে পারে। এ সে হিন্দিভাষী ও অহিন্দিভাষী কারুরই ঘোরতর আপত্তির কারণ থাকতে পারে না।
Leave a comment