জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতার উপাত্ত পঙক্তিটি হল—“তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?” এই উপাত্ত পঙক্তিটির মধ্য দিয়ে কবিতার অন্তর্গত আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্রটির প্রচ্ছন্ন বেদনার তীব্রতাটি প্রকাশিত হয়েছে।
‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ প্রকৃতপক্ষে একটি আখ্যানমূলক কবিতা। এটি একটি সাধারণ কালো মেয়ের প্রেমবঞ্চিত জীবনের আত্মকথন।
মালতীবালা স্কুলে নবম শ্রেণিতে পাঠকালেই কবিতার ষোলো বছরের কিশোরী মেয়েটির মনে অঙ্কুরিত হয়েছিল ভালোবাসার পল্লব। বয়ঃসন্ধিকালের স্বাভাবিক প্ররোচনাতেই তার মনে জেগেছিল প্রেমাকাঙ্ক্ষা। স্কুলের ক্লাসঘরের বাইরে ‘দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর’-এর ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি তার প্রেমপিপাসাকে হয়তো ইন্ধন দিয়েছিল।
এরপর শহর থেকে বেণীমাধব নামের এক মেধাবী তরুণ গ্রামে বেড়াতে এলে কালো সাধারণ মেয়েটি তাকে ভালোবেসে ফেলে। তারুণ্যের সহজাত আবেগে তরুণটিরও এই ভালোবাসায় কিছু প্ররোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু একটি বাস্তব-সচেতন দ্বিধা মেয়েটির মধ্যে তখন থেকেই আমরা লক্ষ করি। কেননা প্রথমত, বেণীমাধব মেধাবী ছাত্র— “বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো। ফলে তার মতো সাধারণ মেয়ে বেণীমাধবের সঙ্গিনী হবার উপযুক্ত নয়, তা বুঝেছিল মেয়েটি। দ্বিতীয়ত, মেয়েটি তার পারিবারিক আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিষয়েও তখন থেকেই সচেতন ছিল—“বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে।” তবু তরুণ বয়সের উদ্দীপনা সেদিন কোনো বাধাই স্বীকার করেনি। যৌবনের কুঞ্জবনে দারিদ্র্যের ও সাধারণত্বের কুটিল নিষেধ সত্ত্বেও প্রেমের অলি সেদিন গুঞ্জরিত হয়েছিল উভয়ের মনেই। প্রেমের মঞ্জরি বিকশিত হয়েছিল সামাজিক ও মেধাগত দূরত্বকে লঙ্ঘন করেই। সুলেখাদের বাড়ি পরিচয়ের সূত্র ধরে সেই প্রেম ঘনীভূত হয়েছিল ব্রিজের ধারে নিভৃত দেখা করার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু বাস্তব বড়ো নির্মম। এই অসম প্রেমের ভবিতব্য যা, সময়াপ্তরে তা ফলবতী হয়েছিল। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলমে’র দুষ্মন্তের মতো, কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’র নরেশের মতো বেণীমাধব ও একদিন মালতীবালা স্কুলের এই কিশোরী মেয়েটিকে ভুলে তার জীবনের উপযুক্ত সঙ্গিনীকে খুঁজে নিয়েছিল। দূর থেকে তাদের দেখে আপ্তরিকভাবেই স্বীকার করেছিল মেয়েটি যে, বেণীমাধবের নতুন সঙ্গিনী রূপে-গুণে বেণীমাধবের উপযুক্ত—“দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো।” উজ্জ্বল আলোর নীচে বেণীমাধবের সেই সঙ্গিনীর রূপের প্রশংসা না করে পারেনি কালো মেয়েটি—”আলোর নীচে অপূর্ব সে আলো।” নিজের রূপ, গুণ ও আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের দুর্ভাগ্যকে অসামান্য সূৈর্যে শিরোধার্য করে নিয়ে এক নির্লিপ্ত ঔদার্যে মেয়েটি প্রার্থনা করেছিল তাদের মঙ্গল—“বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।”
কবিতার আখ্যান-বিবৃতির এ পর্যন্ত পাঠে মনে হতে পারে, কালো মেয়েটির হৃদয় সন্ন্যাসিনীর মতো নির্মোহ, অসুয়াশূন্য। প্রেমবঞ্চনার বেদনাকে ক্ষমা ও ঔদার্য্যের নির্মল বারিসিঞ্চনে সে নিঃশেষে ধৌত করে দিয়ে সে তাই অনায়াসে তাদের মঙ্গল কামনা করেছে।
কিন্তু চরিত্রের বাহা আচরণের অন্তরালে থাকে চরিত্রের অন্যতর এক রূপ। মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানুষের সচেতন মন সামাজিক বিধিবিধান ও সামাজিক সম্পর্ক ও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে ব্যক্তির সামাজিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সেই সামাজিকতাকে স্বীকার করতে গিয়ে তার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, বাসনাকে অনেকখানি অবদমিত করতে হয়। এই অবদমিত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা অনেকটাই গিয়ে লুকিয়ে থাকে ব্যক্তির মগ্নচৈতন্যের গভীরে। কোনো দুর্বল মুহূর্তে সেই মগ্নচৈতন্যে নিহিত কামনাগুলি অকস্মাৎ প্রকাশিত হয়ে ওঠে। আমাদের আলোচ্য কবিতার সেই দুই পঙক্তিতে সাধারণ মেয়েটির সেই আড়াল পড়ে যাওয়া বঞ্চনা-ক্ষুব্ধ মনটিই অকস্মাৎ প্রকাশিত হয়েছে।
বাহ্যত, বেণীমাধব ও তার নতুন সঙ্গিনীর কল্যাণকামনা করলেও পাঠক অবশ্য কালো মেয়েটির বঞ্চিত হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন অশ্রু জলটিকে ঠিকই আবিষ্কার করতে পারেন। বাহাত বেণীমাধবের প্রতি কোনো অভিযোগ জানায়নি মেয়েটি, যেমন অভিযোগ পেশ করেছিল রবীন্দ্রনাথের সাধারণ মেয়ে মালতী। সেদিক থেকে মালতীর থেকে জয়ের সাধারণ মেয়েটি অনেক বেশি বাস্তববুদ্ধি ও উদারতার পরিচয় দিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চরিত্রের এই ঔদার্য্য এবং আত্মবঞ্চনাকে শিরোধার্য করে নেবার স্থৈর্য তার বাহ্য আচরণ মাত্র। তার সেই বাহ্য উদাসীনতা ও ঔদার্য্যের গভীরে ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী, প্রতিহিংসাপ্রবণ মনটিকে চিনে নিতে গেলে আমাদের অবশ্যই কবিতার উপাত্ত বা শেষ দুটি পঙ্ক্তির দিকে অভিনিবেশ দিতে হবে।
কিশোর বয়সের সেই মোহগ্রস্ত প্রেমজীবনের অবসানে বঞ্চিতা মেয়েটিকে এখন পাড়ার সেলাই দিদিমণি হয়ে কোনোক্রমে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হয়। প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানিতে জর্জরিত হতে থাকে মেয়েটি। তার ছোটো বোন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই একদিন ‘চোরাপথের বাঁকে হারিয়ে যায়। আর এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত ভালোবাসা-বঞ্চিত দিনযাপনের গ্লানির ভিতর থেকেই বিস্ফোরিত হতে চায় তার বঞ্চনার জ্বালা, ক্ষোভ, বিধ্বংসী কামনা। বাহ্য উদাসীনতা ও তীব্র অবসাদের পাথর ফাটিয়ে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ক্ষোভের ও বঞ্চনার আগুন যে বারে বারে জ্বলে উঠতে চায় মেয়েটির মনে, তারই পরিচয় প্রকাশিত হয় মেয়েটির উচ্চারণে—“তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?”
কিন্তু এ তার অবচেতন যন্ত্রণা ও ক্ষোভের প্রকাশিত হতে চাওয়ার ইচ্ছামাত্র। আসলে বাস্তবতার পাথর সে সরাতে পারে না। সাধারণ মেয়ে মালতী যেমন তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চেয়েছিল শরৎবাবুর গল্পের মধ্যে তার চরিত্রটির জিতে যাবার ছবির মধ্য দিয়ে, কিন্তু বাস্তবে সে-ও জানে তার নিরুপায় অবস্থা। তাই সে নারী জন্মকে বলেছিল—“হায়রে বিধাতার অপব্যয়।” মালতীবালা স্কুলের সেই মেয়ে পরিণত বয়সে পাড়ার সামান্য সেলাই দিদিমণির জীবনের মধ্যে আগুনকে জ্বালিয়ে তুলতে চাইলেও, সেই ক্ষোভের আগুন জ্বলে না। বরং প্রাত্যহিকতার চাপে এক অবসাদের গভীর নীচে চাপা পড়ে যায় সেই প্রেমবঞ্চনা ও যন্ত্রণার জ্বালা।
Leave a comment