প্রশ্নঃ ডারউনের জৈবিক বিবর্তনবাদ কীভাবে ল্যামার্কের বিবর্তনবাদ থেকে পৃথক আলােচনা কর।

অথবা, ডারউইনের জৈবিক বিবর্তনবাদের সাথে ল্যামার্কের জৈবিক বিবর্তনবাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য তুলে ধর।

ভূমিকাঃ যা সংকুচিত ও অপ্রকাশিত তাকে প্রসারিত ও প্রকাশিত বা সম্প্রসারণ করাই হলাে বিবর্তনের মূল ধর্ম। বিবর্তনবাদের একাধিক রূপ দৃশ্যমান আছে। এগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে ভাইসম্যানের জৈবিক বিবর্তনবাদ। ক্যানিংহাম জৈব বিবর্তনবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “জৈব বিবর্তন হলাে জীবের প্রকাশ, অপেক্ষাকৃত সরল প্রাথমিক অবস্থা থেকে উত্তরােত্তর জটিলতার বিভিন্ন স্তরের ভেতর দিয়ে জীবের আকারের সুশৃঙ্খল বিবর্তন ও পরিবর্তন। ডারউইন, ভাইসম্যান, ল্যামার্ক প্রমুখ মনীষীগণ জীবের বিবর্তন সম্পর্কে যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এদের মতবাদগুলােই জৈব বিবর্তন নামে পরিচিত।

ভাইসম্যানের জৈবিক বিবর্তনবাদঃ জার্মান জীব বিজ্ঞানী ভাইসম্যান জৈবিক বিবর্তনবাদের এক যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেন। ভাইসম্যান সূক্ষ্মভাবে ডারউইন এবং ল্যামার্কের মতবাদের পরীক্ষা করে নিজের সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

তিনি মনে করেন যে, জীবদেহের আকস্মিক অথবা ইচ্ছাজনিত বা প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবজনিত কারণে পরিবর্তন ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে না। কেবল জনন কোষই সংক্রমিত হতে পারে এবং তা অমর। বস্তুত ভাইসম্যানের এ আবিষ্কার জৈবিক বিবর্তনবাদকে দিয়েছে এক নতুন পথের সন্ধান।

ভাইসম্যানের মত অনুযায়ী পরিবর্তন শুধু মাত্র বংশানুক্রমে সংক্রমিত হয় না। প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব অথবা আকস্মিক গঠনে দেহকোষে যে পরিবর্তন ঘটে তা বংশানুক্রমে সংক্রমিত হয় না। তার মতে, “জনন কোষের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনই বংশানুক্রমে সংক্রমিত হতে পারে। কোষ দু’প্রকার। দৈহিক কোষ ও জন্ম কোষ। জনন কোষ অমর আর দৈহিক কোষ জনন কোষ থেকেই সৃষ্টি হয়। ভাইসম্যানের মতে, এ জন্য কোষ অমর। কারণ জনন কোষ বংশানুক্রমে সংক্রমিত হয়। সুতরাং তার কোনাে বিনাশ নেই। বংশানুক্রমে জনন কোষের ধারাবাহিকতা অবিচ্ছিন্নভাবে বর্তমান থাকে।

সমালােচনাঃ ডারউইন ও ল্যামার্কের জৈবিক বিবর্তনবাদের চেয়ে ভাইসম্যানের জৈবিক বিবর্তনবাদ অনেক বেশি আধুনিক ও উন্নতমানের মতবাদ। কিন্তু এ সত্ত্বেও তার মতবাদকে ত্রুটিবিহীন বলা চলে না। কেননা, জৈবিক বিবর্তনবাদের বাহ্যিক ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি যন্ত্রবাদের বিফলতাকেই তার বিবর্তনবাদে টেনে আনেন। তা ছাড়া যুগ প্রবর্তক ভাইসম্যানের তথ্যনির্ভর, সূক্ষ্ম এবং যুক্তিপূর্ণ এ বিবর্তনবাদ বিবর্তন ক্রিয়ার কোনাে উদ্দেশ্যের কথা স্বীকার না করে তাকে অন্ধ প্রকৃতির হাতে তুলে দেয়।

ডারউইনের জৈবিক বিবর্তনবাদের সাথে ল্যামার্কের জৈবিক বিবর্তনবাদের তুলনাঃ প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডারউইন ও ল্যামার্ক জীবজগতের উৎপত্তিতে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের স্বীকার করেনে। উভয়ের মতে, জগতের বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণি বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত। উভয়ে জাতি বা শ্রেণির সত্যতা স্বীকার করেন। উভয়ের মতে, জগতের বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণি বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত। উভয়ে জাতি বা শ্রেণির সত্যতা স্বীকার করেন না। বরং দুজনের মতে বিবর্তন ক্রিয়ার ফলেই এক শ্রেণির থেকে বর্তমান জগতে বিভিন্ন শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। এ মিল ছাড়াও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। নিম্নে সে পার্থক্যগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(১) ডারউইনের মতে, “জীবকোষের আকস্মিক পরিবর্তনের ফলেই জীবের দেহের গঠনের পরিবর্তন দেখা যায়।” ল্যামার্কের মতে, “বাইরের পরিবেশের প্রভাবই জীবদেহের পরিবর্তন সূচনা করে। তা ছাড়া জীবের ইচ্ছা বা বাসনার ফলেও জীবদেহ পরিবর্তন ঘটে। “কিন্তু ডারউইনের মতে, “জীবকোষের পরিবর্তনের সাথে জীবের ইচ্ছার বা বাসনার কোনাে সম্পর্ক নেই। “

(২) ডারউইনের মতে, “আকস্মিক পরিবর্তন বংশানুক্রমে সঞ্চালিত হয়।“ ল্যামার্কের মতে, “জীবের অর্জিত পরিবর্তনগুলােই সংক্রমিত হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, উভয়ের মতের বেশে মৌলিকতা আছে।”

(৩) ডারউইনের মতে, “আগে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উদ্ভব হয় এবং পরে তারা নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনা করে“যেমন প্রথমে চোখের উদ্ভব, তারপর তার ব্যবহার। অনুরূপে দেহের প্রত্যঙ্গগুলাের উদ্ভব শেষে তাদের ক্রিয়ার প্রয়ােজন হয়। অপরদিকে ল্যামার্ক এর বিপরীত মতবাদ পােষণ করেন। তার মতে, প্রকৃতির প্রভাব ও কর্মের ইচ্ছাই নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয়টিকে সৃষ্টি করে। প্রথমে আসে প্রয়ােজন, পরে আসে অঙ্গপ্রতঙ্গ প্রত্যক্ষণে প্রথমে ক্রিয়া, পরে সম্পাদনের জন্য তাদের সৃষ্টি হয়। যেমন দেখার চেষ্টা বা প্রয়ােজন থেকেই চোখের উদ্ভব হয়।

(৪) ডারউইন কোনাে জৈবিক প্রয়ােজন বা বাসনা এবং অভাববােধকে স্বীকার করেননি; যা জীবদেহে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ল্যামার্ক তা স্বীকার করেছেন। এগুলােই হলাে সংক্ষেপে উভয় মতবাদের পার্থক্য। বস্তু এ পার্থক্যগুলােই উভয় মতবাদের সমান মৌলিকতা দাবির পক্ষে রায় দিচ্ছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, ডারউইনের এবং ল্যামার্কের জৈবিক বিবর্তনবাদের মত ভাইসম্যানের মতবাদও বহু দোষে দুষ্ট। কিন্তু তাই তিনি যে মতবাদ প্রদান করেছেন তা একেবারেই গ্রহণযােগ্য নয় এমন কথাও বলা যায় না। প্রথম আলােচনাতে সূচনা ঘটাতে এ মতবাদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।