ডায়েরি বিভিন্ন ধরনের মানুষ লিখে থাকেন, তবে ডায়েরি মাত্রই সাহিত্য বলে স্বীকৃত হয় না। বিশেষ কোনো ডায়েরি সাহিত্য হয়ে ওঠে কিংবা কিছু কিছু ডায়েরিতে মহৎ সাহিত্যের বীজ লুকিয়ে থাকে—স্পষ্ট অর্থে সাহিত্য রচনার প্রাথমিক ছক অনেক ক্ষেত্রে ডায়রিতে আঁকা থাকে। যে যে গুণে ডায়েরি সাহিত্য হয়ে ওঠে সেগুলিকে নিম্নরূপে ধরা যায় :—

(১) ডায়েরির সাহিত্যিক মর্যাদা লাভের প্রথম শর্ত হল ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে বিশ্বজনীন করে তোলা অর্থাৎ ব্যক্তি জীবনের আনন্দ-নিরানন্দ, আশা-হতাশা, প্রয়োজন কিংবা অভিজ্ঞতাকে দেশ-কাল সমাজের আভাসে সমৃদ্ধ করে তোলার মধ্য দিয়ে ডায়েরি সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে ওঠে।

(২) ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা অন্তরঙ্গ একক স্বরের মধ্য দিয়ে যখন বিশেষ রসমূল্যে উত্তরিত হয় তখন ডায়েরি সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে।

(৩) সাহিত্য হল যে-কোনো রসময় উপস্থাপন। দিনলিপির বস্তুগত উপাদান যখন ব্যক্তি জীবনের রসময় অভিব্যক্তির আভাসে মুখর হয়ে ওঠে, তখন তা সাহিত্য পদবাচ্য হয়। এই রসময়তা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মনৈতিক কিংবা সাহিত্যিক বিষয়ে হতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে রচয়িতার দৃষ্টি শুধুমাত্র বস্তুনিষ্ঠ না হয়ে কল্পনা প্রবণ মনন সম্পৃক্ত হতে পারে।

অর্থাৎ ডায়েরিকে সচেতন প্রচেষ্টায় সাহিত্য করে তুলতে হয়। তেমন ক্ষেত্রে ডায়েরি ব্যক্তিগত রচনার নির্মোক সরিয়ে সাহিত্য মূল্যে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে।

যে রচনায় কোনো ব্যক্তি জীবনের দৈনন্দিনের বা প্রাত্যহিকের কোনো ঘটনা লিপিবদ্ধ থাকে, সে রচনায় ব্যক্তিক জীবনের অজস্র ঘটনার মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় বস্তুগত ঘটনাগুলি লিপিকৃত হয় সাধারণত সেই জাতীয় রচনাকে দিনলিপি বা ডায়েরি বলা হয়। সারার্থে রোজকার লিখে রাখা ব্যক্তি জীবনের ধারা বিবরণীই হল দিনলিপি। এই ব্যক্তিক রোজনামচা বিশেষ বিশেষ গুণে সমন্বিত হয়ে সার্বজনীনতা লাভ করে। ডায়েরি সার্বজনীন হয়ে ওঠে দুরকম ধারায়। যথা—

(১) যখন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন পেশার বিচিত্র মতামতের মানুষ ডায়েরি লেখে তখন ডায়েরি বিশেষ কোনো শিক্ষিত বা পণ্ডিত ব্যক্তির রচনা বিষয় না হয়ে সার্বজনীন হয়। এক্ষেত্রে নানা মানুষের ব্যক্তি অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যই ডায়েরিকে সার্বজনীন করে তোলে। 

(২) ডায়েরি যখন ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সীমাকে অতিক্রম করে বিশেষ সমাজ মূল্যে ও সাহিত্য মূল্যে বিশ্বজনীনত্ব প্রাপ্ত হয় তখন তা সার্বজনীনতা লাভ করে।

অর্থাৎ ব্যক্তিকতার সীমা অতিক্রম করেই ডায়েরি সার্বজনীন হয়। এই অতিক্রম কখনও সমাজের স্তর থেকে স্তরান্তরে বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়ে সাহিত্য মূল্যে উত্তরিত হয়।

বিচিত্র মানসিকতার দিনলিপি ও সর্বজনীনত্ব : ডায়েরি লেখার অধিকার শুধু কোনো বিশেষ শ্রেণির কিংবা পেশার মানুষের নয়। সমাজের সমস্ত স্তরের সমস্ত ধরনের মানুষের মধ্যে সে অধিকার আছে। ডায়েরি রচনার ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পুরোহিত, আইনজীবী, সাংসদ, সাহিত্যিক, রাজনীতিক থেকে শুরু করে বিচিত্র [Ch’een bourgeois deparis নামক ডায়েরি আইনজীবী পেপিসের ডায়েরি, ঔপন্যাসিক ফানি বার্নের ‘Madamed’ নামক ডায়েরির কথা উল্লেখ করতে হয়] পেশার মানুষ রচিত এইসব ডায়েরিতে বিচিত্র বিষয়ও লিপিকৃত, যা ডায়েরির সর্বজনীনত্বেরই প্রকাশ। এসব ক্ষেত্রে কোথাও ষষ্ঠ ও সপ্তম চার্লসের রাজত্বকাল, কোথাও ১৬৬০-১৬৬৯ পর্যন্ত লন্ডন শহরের অকপট জীবন চিত্র, আদালত, রঙ্গালয়, গৃহজীবন ও অফিসের বিবরণ বিধৃত।

ডায়েরির বিশ্বজনীনত্ব ও সাহিত্যমূল্য প্রাপ্তি এবং সর্বজনীনতা : অনেক সময় ডায়েরি ব্যক্তিকতার সীমা অতিক্রম বিশ্বজনীনত্ব লাভের মধ্য দিয়েও সাহিত্যিক রস প্রতীতি অর্জনের মধ্য দিয়ে সার্বজনীন হয়ে ওঠে। দিনলিপি জাতীয় রচনা অনেক ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধ গণ্ডিকে অতিক্রম করে সাহিত্যের স্তরে উন্নীত হয়। এসব ক্ষেত্রে সামান্য ও তুচ্ছ বিষয়ও দিনলিপি রচনার নিপুণতায় রসময় হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ডায়েরি এ ধারার উৎকৃষ্ঠ নিদর্শন। তাই রবীন্দ্রনাথ তার ডায়েরি লেখা প্রসঙ্গে এক স্থানে লিখেছেন—

“কথায় কথা বেড়ে যায়। বলতে যাচ্ছিলুম ডায়েরি লেখাটা আমার স্বভাব সঙ্গত নয়। আমি ভোলানাথের চেলা; ঝুলি বোঝাই করে তথ্য সংগ্রহ করিনে। আমার জলাশয়ের যে জলটাকে অন্যমনস্ক হয়ে উঠে যেতে দিই সেইটেই অবশ্য শূন্য পথে মেঘ হয়ে আকাশে জমে, নইলে আমার বর্ষণ বন্ধ।” (পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরি)

ডায়েরির এই অংশটিকে একটি নিটোল গতি কবিতা বলে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। শিল্পীমন কত তুচ্ছ ও সাধারণ বিষয়কে কল্পনার বর্ণালী সমারোহে অসাধারণ করে তুলতে পারেন, এই অংশটিতে তার পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।