উত্তরঃ বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের শতকরা আশি ভাগ লোক কৃষিকাজের সাথে জড়িত। আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলোকে বাংলাদেশ সামান্য আলোকিত হলেও প্রাচীনকালে এদেশে বিজ্ঞানের আলো পৌঁছেনি। ফলে প্রাচীনকালে এদেশের মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। আধুনিক জীবনাচরণ, চাষ বাস ও কৃষিকাজে বিজ্ঞানের কোন সাহায্য পায়নি, তখন খনার বচন ও ডাক চাষাবাদের অভিজ্ঞতা-নির্ভর প্রণালী প্রদান করে সহযোগিতা করেছে, কৃষককে দেখিয়েছে সঠিক পথ। ডাক ও খনার বচনের জ্ঞানই ছিল প্রাচীন যুগের বাঙালিদের সর্বোচ্চ নির্দেশক। ডাক ও খনার বচন বাংলার কৃষককুলকে জানিয়ে দিয়েছে ফসল বপনের সময়, রীতিনীতি ইত্যাদি। অর্থাৎ কখন কোন কাজটি করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, কী করলে কী হবে। ফলে কৃষিনির্ভর বাংলার মানুষের জীবনযাত্রার সাথে ডাক ও খনার বচনের সুনিবিড় বন্ধন অনস্বীকার্য। লোকসাহিত্য হিসেবে এসবের সাহিত্যমূল্য যাই থাকুক না কেন, সমাজ জীবনে ডাক ও খনার বচনের প্রায়োগিক মূল্য অপরিসীম।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ সমাজের মর্মমূল থেকে উৎসারিত চিরন্তন জ্ঞান বাণীই ডাক ও খনার বচন। এদেশের মানুষের শিক্ষার হার কম, ফলে ধর্মীয় ও লোকবিশ্বাসের সাথে আমাদের নাড়ীর যোগ রয়েছে। সংস্কার ও প্রথা পালনের সাথে সাথে ডাক ও খনার বচনে বাঙালির বিশ্বাস চিরন্তন। ডাক ও খনার বচনে এদেশের কৃষিকাজের ও দৈনন্দিন জীবনের অতি প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো ছন্দাকারে রচিত হয়েছে, যা কার্ল থেকে কালে, যুগ থেকে যুগে, মুখ থেকে মুখে প্রবহমান।
বাংলাদেশের প্রাচীনকালের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, প্রাচীনকাল থেকে প্রায় মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত, বিশেষত মুসলিম শাসনামলে এদেশের পণ্ডিতেরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের জ্যোতিষশাস্ত্র এবং ডাক ও খনার বচন শিক্ষা দিতেন।
এদেশের টোলে টোলে ছাত্ররা ডাক ও খনার বচন ভাল করে শিক্ষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তেন এবং অর্থের বিনিময়ে দেশের কৃষকদের এ শাস্ত্র শিক্ষা দিতেন। ডাক ও খনার বচন শিক্ষা প্রদান করা অনেকে পেশা ও জীবিকার উপায় হিসেবে বিবেচনা করতেন। সেকালে বাংলার জমিদারদের নির্দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র সহকারে ডাক ও খনার বচন গীত আকারে পরিবেশন করে কৃষকদের প্রভাবিত করা হত। বাংলার কৃষকেরা ডাক ও খনার বচনের শিক্ষা অনুসারে কৃষিকার্য সম্পাদন করত। বাংলার ডাক ও খনার বচন কেবল বাঙালি জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল, এমন নয়, বরং উড়িষ্যার কৃষকেরাও বাংলার ডাক ও খনার বচন অনুসরণে কৃষিকার্য সম্পন্ন করত এবং তাদের ভাষাও গড়ে উঠেছিল ডাক ও খনার বচনে।
ডাক ও খনার বচন মূলত কোন একক লোকের সৃষ্টি নয়। এগুলো আবহমান কাল থেকে লোকপরম্পরায় চলে আসছে। এগুলো বাঙালির অলিখিত সাহিত্য। এগুলো মানুষের মুখে মুখে সৃষ্ট এবং মুখে মুখেই প্রচলিত। এগুলো সমগ্র জাতির সৃষ্টি, জাতির আর্থ-সামাজিক মানসেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
‘ডাক’ শব্দটি তিব্বতীয় ভাষার একটি শব্দ, যার অর্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। ড. মোহাম্মদ এনামুল হক ডাককে বৌদ্ধ তান্ত্রিক শ্রেণীর ‘সিদ্ধি’র নাম বলেছেন। ডাকের রচনাকাল সপ্তম শতাব্দী থেকে নবম শতাব্দী ধরা হয়। কিছু কিছু খনার বচনে ‘খনা’ শব্দটি প্রোথিত থাকায় অনেকে ‘খনা’ বলতে বিশেষ ব্যক্তি বুঝে থাকেন। যেমন—
“পৌষে গরমি বৈশাখে জাড়া,
পয়লা আষাঢ়ে ভরবে গাড়া।
খনা বলে শুন হে স্বামী
শাওন ভাদ্রর নাইকো পানি।”
অর্থাৎ পৌষ মাসে যদি গরম পড়ে, বৈশাখে যদি পড়ে শীত, আষাঢ়ে খরা তবে সে বছর ভাদ্র মাসে পানি হয় না।
এই বচনটিতে যেহেতু খনা স্বামীকে বলছে, তাতে অনেকেই খনাকে প্রজ্ঞাসম্পন্না মহিলা জ্ঞান করে। খনা সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী থাকলেও গবেষকদের গবেষণায় ধরা পড়েছে যে, খনা কোন ব্যক্তির নাম নয়।
কৃষিপ্রধান বাংলায় যেহেতু ডাক ও খনার বচনের প্রায়োগিক মূল্য রয়েছে। সুতরাং কৃষিকার্যের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদানভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ডাক ও খনার বচন রয়েছে।
চাষসংক্রান্ত খনার বচনঃ
(ক) কলা রুয়ে না কাট পাত।
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত৷
অর্থাৎ কলাগাছ রোপণ করে পাতা না কাটলে যথেষ্ট কলা ফলে, নতুন কলাগাছের পাতা কাটলে তাতে ভাল ফল দেয় না।
(খ) ষোল চাষে মুলা।
তার আধা তুলা।
তার আধা ধান৷
বিনা চাষে পান।
অর্থাৎ ‘মুলা উৎপন্নের জন্য খুব বেশি (গভীর) চাষ লাগে। তুলার জন্য মূলার চেয়ে কম চাষ লাগে। তুলার চেয়ে ধানের জন্য আরও কম চাষ লাগে। পান চাষের জন্য চাষ সবচেয়ে কম লাগে৷
(গ) গরুর মুখে ঘাস পানি
হাল গৃহস্থ পরে মানি।
অর্থাৎ যে গরু দিয়ে বাংলার কৃষক চাষাবাদ করে সেই গরুকে শক্তিশালী ও সক্রিয় রাখতে গরুকে অনবরত খাবার দিতে হবে। গৃহস্থের সব কাজের ঊর্ধ্বে গরুর যত্ন নিতে হবে, কেননা গরু বাঁচলে কৃষক বাঁচবে।
(ঘ) কার্তিকের ঊন জলে।
খনা বলে দুনো ফলে।
অর্থাৎ কার্তিক মাসে যদি সামান্য বৃষ্টি হয় তবে কৃষকদের রবি শস্যের ফলন ভাল হয়। এটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফল।
(ঙ) সবল গরু গভীর চাষ।
তাতে পুরে মনের আশ।
অর্থাৎ শক্তিসম্পন্ন সবল গরুর সাহায্যে ফসলের জমিতে ভালমত গভীরভাবে চাষ দিলে অবশ্যই ভাল ফসল ফলবে।
(চ) গাই দিয়া বায় হাল।
দুঃখ তার চিরকাল।
অর্থাৎ যে হালচাষের কাজে গাভী ব্যবহার করে তার দুঃখ কোনদিনই ঘোচে না। কেননা গাভীতে ভাল চাষ হয় না। ভাল চাষ না হলে ভাল ফসল ফলে না, ভাল ফসল না ফললে কৃষকের দুঃখ ঘুচবে না।
বৃষ্টিসংক্রান্ত খনার বচনঃ
প্রাচীন যুগে কৃষিকাজের প্রাণ ছিল বৃষ্টি, কেননা তখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পানি সরবরাহের কোন ব্যবস্থা ছিল না। নাবিক যেমন দিগদর্শন যন্ত্র দিয়ে সঠিক দিকটি চিনে
নেয়, কৃষকেরা তখন বৃষ্টিকে কেন্দ্র করে তাদের ফসল বোনার কাজটি যেমন করত, তেমনি বৃষ্টির সময়কাল দেখে বছরের শুভাশুভ নির্ণয় করে নিত। সে দিক বিবেচনা করে বৃষ্টিসংক্রান্ত খনার বচন সবারই জানা ছিল—
(ক) যদি বর্ষে মাঘের শেষ।
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।
অর্থাৎ যে বছর মাঘ মাসে বৃষ্টি হয়, সে বছর দেশে ফসল ভাল হয়। দেশের প্রজা সুখে থাকে। রাজাকে সবাই পুণ্যবান জ্ঞান করে।
(খ) ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন।
শীঘ্র বৃষ্টি হবে যেন।
অর্থাৎ ব্যাঙ ডাকলেই বুঝা যায় যে বৃষ্টি হবে৷
(গ) জ্যৈষ্ঠে শুকো আষাঢ়ে ধারা।
শস্যের ভার না সহে ধরা।
অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসে যদি প্রখর রৌদ্র হয় এবং আষাঢ়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, তবে সে বছর ফসল খুব ভাল হয়।
(ঘ) চৈত্রে দিয়া মাটি
বৈশাখে কর পরিপাটি।
চৈত্র মাসে নতুন মাটি দিয়ে বৈশাখ মাসে মাটিকে সমান করলে অর্থাৎ এক মাস পর মাটি সমান করে তাতে গাছ লাগালে বা ফসল বুনলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
সামাজিক সংস্কারমূলক ডাক ও খনার বচনঃ
(ক) ডাহিনে ফণী, বামে শিয়ালী।
দহিলে দহিলে বলে গোয়ালী।
অর্থাৎ যাত্রাকালে ডাইনে সাপ দেখা, বামে শিয়াল দেখা বা দই বিক্রেতার সাথে দেখা হলে যাত্রা অশুভ হয়। তাই যাত্রা না করা উচিত।
(খ) শূন্য কলসি শুকনা না,
শুকনা ডালে ডাকে কা।
যদি দেখ মাকুন্দ ধোপা
এক পা না যেয়ো বাপা।
অর্থাৎ যাত্রাপথে যদি শূন্য কলস সামনে পড়ে, ডাঙায় উঠানো শুকনো নৌকা, বা ধোপার কাপড় কাচা সামনে পড়ে তবে অমঙ্গল হবার সম্ভাবনা, তাই যাত্রা নিষেধ।
(গ) আগারে দিয়ে দক্ষিণ পা।
যথা ইচ্ছা তথা যা।
অর্থাৎ যে কোন স্থানে রওনা হতে প্রথমে ডান পা বাড়ালে সব অমঙ্গল দূর হয়।
(ঘ) হাঁচি টিকটিকির বাঁধা।
যে না জানে সে গাধা।
অর্থাৎ যে কোন কাজের পূর্বে হাঁচি এলে বা টিকটিকি ডাকলে অশুভ বা অকল্যাণ হয়।
(ঙ) দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ।
কমে না বাড়ে বারো মাস।
অর্থাৎ নারকেল যত কাটা হবে ততই ফলবে, বাঁশ যত না কাটা হবে ততই ফলবে।
(চ) দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা
পূর্ব দুয়ারী তার প্রজা,
পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই
উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।
অর্থাৎ বাড়িতে ঘর করতে হলে দক্ষিণ দিকে মুখ করা ঘরই শ্রেষ্ঠ, অতঃপর পূর্ব দিকে মুখ করা দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ। পশ্চিম বা উত্তর দিক মুখ করা ঘর শান্তি দেয় না।
তাহলে দেখা যায় যে, খনার বচনে মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার সমস্ত বিষয়ের মঙ্গল অমঙ্গল জানিয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়। তেমনি ডাকের মধ্য দিয়েও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে। যেমন-
(ক) মাঘ মাসে বর্ষা হেবা,
রাজা ছাড়ে প্রজার সেবা।
অর্থাৎ মাঘ মাসে বৃষ্টি হলে সুফসল ফলে সুতরাং প্রজা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রজাদেরকে নিয়ে রাজার তেমন ভাবনা থাকে না।
(খ) বর্ষা কলিত বেঙের রাও
হাল গরু লইয়া পাথরক যাও।
অর্থাৎ সারা রাত বৃষ্টি হচ্ছে, সকাল সকালই জমি চাষের জন্য হাল গরু নিয়ে মাঠে নেমে যেতে হবে।
ডাক ও খনার বচনের মধ্যে উদ্দেশ্য ও ব্যবহারগত কোন পার্থক্য নেই। তবে খনার বচনকে ডাকের চেয়ে অধিক শিল্পসম্মত বোধ হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, ডাক ও খনার বচন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক সম্পদ। এগুলো একাধারে সাহিত্য, গীত, ছড়া সদৃশ, দর্শন এবং জনজীবনে এগুলোর প্রায়োগিক মূল্য অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের আলোক যে জনজীবনে পৌঁছে নি, সেই কৃষিনির্ভর সমাজের মানুষের কৃষিজাত ফসল উৎপন্নের গাইড লাইন হিসেবে কাজ করেছে। কৃষকদের চাষপ্রণালি, শস্যের বীজ বপন, রোপণ, কাটা, বৃষ্টি বছরের কথন হলে কি হয়, কী কী করণীয় ইত্যাদি। তদুপরি যে কোন কাজে নামার শুভ অশুভ দিকটিও এতে নির্দেশিত হয়। এগুলো বাঙালির কর্মে অনুপ্রেরণা ও দিক-নির্দেশক হিসেবে অসামান্য গুরুত্ববহ।
Leave a comment