দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ঠান্ডা লড়াই। ঠান্ডা লড়াইয়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল一

[1] কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মহাশক্তিধর (Super-Power) রাষ্ট্ররূপে আবির্ভাব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের। তাই ঠান্ডা লড়াই বলতে বােঝায় মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সারা বিশ্বে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে।

[2] বিভিন্ন দেশের সমর্থন লাভের দ্বন্দ্ব: উভয় রাষ্ট্রই বিশ্বের অন্যান্য‌ রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ও তাদের সাহায্য ও সহযােগিতা লাভ করতে তৎপর ছিল। বিভিন্ন দেশের সমর্থন লাভের দ্বন্দ্বকে ঘিরে উদ্ভব ঘটে দ্বিমেরু রাজনীতি (Bipolar Politics)-র।

[3] রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা ও সাম্যবাদের পক্ষে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এর পরিণতি হিসেবে ঠান্ডা লড়াই নামে রাজনৈতিক মতবাদের লড়াই শুরু হয়।

[4] সামরিক বলবৃদ্ধি: কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে কেন্দ্র করে দুই শক্তিজোট ভিতরে ভিতরে জোর সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে। প্রবল থেকে প্রবলতর শক্তিসম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরি ও সেগুলির পরীক্ষার নামে যুদ্ধ মহড়া শুরু হয় দুই শিবিরে। এইভাবে উভয়পক্ষই প্রবল সামরিক বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। বিশ্বে আতঙ্কজনক বাতাবরণ গড়ে ওঠে, যা ঠান্ডা লড়াই নামে অভিহিত হয়।

[5] আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা: দুপক্ষেরই অনুগত কোনাে রাষ্ট্র কোনাে অঞ্চলে যুদ্ধরত হলে ওই যুদ্ধকে ওই অঞলেই সীমাবদ্ধ রাখতে উভয়েই তৎপর হয়ে ওঠে।

[6] ছায়া যুদ্ধ: আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষের সামরিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কোনাে পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অংশ নেয়নি। কেবল যুদ্ধের আবহ বজায় রেখেছিল।

[1] ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে জড়িয়ে পড়া: দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলেই ঠান্ডা লড়াই পরিবেশের উৎপত্তি। কিন্তু ওই দুই শক্তি কখনােই নিজেদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পক্ষে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্ত থেকে দূরে সরে থাকা কিন্তু সম্ভব হয়নি।

[2] আমেরিকা ও রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে জাপান, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের আধিপত্য বিলুপ্ত হয়েছিল। এর ফলে এশিয়া মহাদেশের এক বিশাল অংশে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণের লক্ষ্যে এগিয়েছিল ধনতান্ত্রিক আমেরিকা বা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া উভয় দেশই। ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের যে সূত্রপাত ইউরােপে হয়েছিল, তা ওই দুই মহাশক্তির হস্তক্ষেপে এবার এশিয়া মহাদেশেও। ছড়িয়ে পড়ল। তৃতীয় বিশ্বও তা থেকে রক্ষা পেল না। দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ, সুয়েজ সংকট, আরব-ইজরায়েল বিরােধ, ভিয়েতনাম সংকট, ইরাক ইরান যুদ্ধ, ইরাক-কুয়েত লড়াই, পাক-ভারত যুদ্ধ ইত্যাদি হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

[3] শক্তিজোট গুলির প্রভাব: নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বৃহৎ শক্তিবর্গের গড়ে তােলা একাধিক শক্তিজোট তৃতীয় বিশ্বের ওপর ঠান্ডা লড়াইকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে কমিউনিস্ট চিনকে প্রতিরােধ ও ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট আগ্রাসন রােধ করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO)। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তােলা হয় মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা (MEDO) (১৯৫৫ খ্রি.)। পরবর্তীকালে এই সংস্থারই নাম হয় বাগদাদ চুক্তি বা সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (CENTO)। মধ্যপ্রাচ্যে রুশ আধিপত্য রােধ ও সেখানকার খনিজ তেল সম্পদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপনই ছিল এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য।