পাশ্চাত্ত্য নাট্যচিন্তায় ট্র্যাজেডির প্রাথমিক ধারণা অ্যারিস্টট্ল নির্দেশিত সংজ্ঞা থেকেই সাহিত্যরসিকেরা লাভ করেছেন। এখনও পর্যন্ত অ্যারিস্টট্‌লের ট্র্যাজেডি-সম্পর্কিত ধ্যানধারণা মোটামুটিভাবে গ্রাহ্য ও স্বীকৃত। অ্যারিস্টট্ল ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন: “Tragedy is an imitation of the action that is serious, complete, and of the certain magnitude; in language embellished with each kind of artistic ornament, the several kinds being found in separate parts of the play; in the form of action, not of narrative; through pity and fear effecting the proper purgation of these emotions.” রঙ্গমঞ্চে একটি প্রধান চরিত্র বা নাট্যবিষয়ের প্রবক্তার (Protagonist) গতিময় জীবনকাহিনীর ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ দৃশ্যাবলীর মাধ্যমে যে নাটক দর্শকদের হৃদয়ে ভীতি ও করুণাকে জাগিয়ে তোলে, তাদের প্রশমিত করে, তার মনে করুণরসের আনন্দকে সৃষ্টি করে, তাকেই ট্র্যাজেডি বলা যায় । অ্যারিস্টলের এই সংজ্ঞা থেকে আমরা ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি সূত্র পাই : এক, ট্র্যাজেডিতে কোন ব্যক্তিজীবন ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে গতিশীলরূপে আভাসিত হয় ; দুই, নাট্যঘটনাবস্তু গভীর ও পূর্ণরূপে ট্র্যাজেডিতে ফুটে ওঠে; তিন, ভাবগৌরব, শব্দসম্পদ ও সংগীতাদি ট্র্যাজেডির বহিরাঙ্গিক সজ্জার অঙ্গ ; চার, ট্র্যাজেডিতে নাটকীয় ঘটনাসমূহে একটি মাত্র পরিণামমুখিনতায় সুসংহত (unity of action) হওয়া চাই ; পাঁচ, ট্র্যাজেডি স্বরূপত ঘটনাত্মক, বর্ণনাত্মক রচনা নয়; হয়, ট্র্যাজেডি দর্শকের মনে করুণা ও ভীতির উদ্রেকের পর তাদের প্রশমন করে তার মানসিক স্বাস্থ্য বিধান করে।

গ্রীসে আনুমানিক খ্ৰীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে গ্রীকদেবতা ডায়োনিসাসের পূজা-সম্পর্কিত উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে ট্র্যাজেডির উদ্ভব হয়। প্রথম থেকেই তার ভিত্তি ছিল গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন। কৃত্য অনুষ্ঠান (ritual), কবিতা ও তার মাধ্যম এবং নৃত্য, সংগীত ও দৃশ্য তার সঙ্গে জড়িত ছিল। বস্তুত গ্রীক ট্র্যাজেডির উৎস তার ধর্মজীবনে। গ্রীক ট্র্যাজেডির সঙ্গে গ্রীকদের ধর্মবিশ্বাস, পুরাণ (myth) ইত্যাদি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। গ্রীক ট্র্যাজেডি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অংশে বিভক্ত : প্রস্তাবনা (Prologue), একটি সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধরূপ দৃশ্যে নাট্যকার নাটকের নাট্যপরিস্থিতির সঙ্গে দর্শকদের পরিচিত করিয়ে দেন। পরবর্তী অংশকে বলা হয় Parodos, এখানে কোরাস আবির্ভূত হয়, কোরাসের মধ্যে জনসাধারণের মতামত বিচার প্রতিফলিত হয়, তারা ঘটনা ও চরিত্রগুলির ক্রিয়াকলাপের ওপর মন্তব্য প্রকাশ করে, নাটকের ভাবগত পরিপ্রেক্ষিতকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরে। কোরাসের প্রথম গান শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় প্রথম অনুকাহিনী (episode), যা আধুনিক নাটকের অঙ্ক অথবা দৃশ্যের সমতুল্য; সাধারণতঃ একটি নাটকে চার বা পাঁচটি অনুকাহিনী থাকে। সবশেষে উপসংহার দৃশ্য (Exodos)। ট্র্যাজেডির এইসব উপাদানকে সুসমঞ্জস রূপ দেওয়া হয়।

গ্রীক ট্র্যাজেডি ভাবগম্ভীর, তার ভাবভাষা সমুন্নত, দেবতা বা দেবতাদের প্রকৃতি, মানুষের সঙ্গে দেবতার সম্বন্ধ অথবা মানুষদের প্রতি দেবতাদের আচরণের প্রকৃতি ইত্যাদি ধর্মীয় মৌলিক সমস্যাগুলি তার উপজীব্য। অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে বলা যায়, গ্রীক ট্র্যাজেডির ছ’টি মৌলিক উপাদান হল — প্লট, চরিত্র, ছন্দ, চিন্তা, দৃশ্য (Spectacle) ও সঙ্গীত। ট্র্যাজেডি তার ক্রিয়ায় (action) জীবনের সর্বজনীন দিকগুলিকে প্রতিবিম্বিত করে, তাকেই তিনি মিমেসিস বা ইমিটেশন (Mimesis or Imitation) বলেছেন। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে ক্রিয়ার ঐক্য (unity of action), স্থান-কালের ঐক্য (unity of place and time) রক্ষা করা হয়। গ্রীক ট্র্যাজেডির শিল্পরূপে সমস্ত উপাদান ঐক্যসূত্রে মিলিত হয়ে সমগ্রতা লাভ করে। গ্রীক ট্র্যাজেডির নায়ক সুবিখ্যাত ও সমৃদ্ধিশালী, কিন্তু অত্যন্ত লক্ষণীয়ভাবে সম্পূর্ণরূপে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ নয়, বিচারের কোনও মারাত্মক ত্রুটি অথবা দুর্বলতার জন্যই তাকে দুর্ভাগ্যের মধ্যে পড়তে হয়। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে দেবতা অথবা ঐশ্বরিক শক্তির প্রভাবও অংশত মানুষের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে। গ্রীক ট্র্যাজেডি তিনটি মূল অঙ্গীকারের (assumptions) ওপর প্রতিষ্ঠিত : প্রথম, মানুষের মর্যাদা, দ্বিতীয়, তার ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং সে যেভাবে তাকে ব্যবহার করে সেই বিষয়ে তার দায়িত্ব এবং তৃতীয়, বিশ্বে দৈবীশক্তির অস্তিত্ব। ট্র্যাজেডিতে নায়ক অশুভের সমস্যায় জর্জরিত হয়। তার জীবন অভিশাপ বহন করে নিজের ত্রুটি বা দুর্বলতা এবং দৈবীশক্তির প্রভাবের জন্যও মৃত্যু বা ধ্বংসকে বরণ করে। কিন্তু ট্র্যাজেডির মুখ্য চরিত্রের (protagonist) সেই মর্মদ্ভদ পরিণামের অর্থ তার পরাজয় নয়, সেই পরিণতির মধ্যেই জীবনের মহিমাপূর্ণ অর্থ ও তার মানবিক মর্যাদা উদ্ভাসিত হয়। সেখানেই আমাদের হৃদয়ের কাছে গ্রীক ট্র্যাজেডির চিরস্থায়ী আবেদন।

ঈস্কাইলাস, ইউরিপিদিস ও সোফোক্লিস শ্রেষ্ঠ গ্রীক ট্র্যাজেডি রচয়িতা। সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রীক নাট্যকার সোফোক্লিসের Oedupus নাটক সম্বন্ধে আলোচনা করলে গ্রীক ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হবে। থীবস-এর রাজা লেইয়াস ও রানী জোকাস্তা দৈববাণীতে জানেন, তাঁদের পুত্র বড় হয়ে পিতাকে হত্যা এবং মাতাকে বিবাহ করবে। তাঁদের শিশুপুত্রকে পাহাড়ের ওপর ফেলে রেখে আসা হয় যাতে তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু একজন রাখাল তাকে পেয়ে তার যত্ন নেয়, আর একজন রাখালকে দেয়, সে তাকে করিন্থ-এ নিয়ে যায় এবং সেখানকার রাজা ও রানী তাকে নিজের পুত্রের মত পালন করেন। অয়দিপাউসও সেই দৈববাণী শোনে এবং তার অদৃষ্টকে এড়াবার জন্য চিরদিনের জন্য করিথ্ ত্যাগ করে। অয়দিপাউসের যাত্রাপথে তার সঙ্গে ভৃত্যদলসহ একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির সাক্ষাৎ হয় এবং তাদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধে, সে বৃদ্ধকে সদলবলে হত্যা করে। অয়দিপাউস থীবসে এসে স্ফিংক্স্-এর ধাঁধার সমাধান করে শহরকে তার হাত থেকে রক্ষা করে। সে তার বিধবা রানী জোকাস্তাকে বিবাহ করে, তাদের কয়েকটি সন্তান হয়। থীবস্-এ যখন প্লেগ ও অনাবৃষ্টির তাণ্ডব চলে, তখন দৈববাণী জানায় যে লেইয়াসের হত্যাকারী দণ্ড পায়নি বলে দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়েছেন। অয়দিপাউস রাজা হিসেবে অপরাধীকে অনুসন্ধান করে এবং অবশেষে আবিষ্কার করে যে সে নিজেই অপরাধী। সে নিজের চোখ নষ্ট করে দেয়, তারপর নির্বাসনে যায়। অবশেষে এথেন্সে তার মৃত্যু হয়। অয়দিপাউসের চরিত্রের দুর্বলতা, আবেগের ঝোঁকে কাজ করার প্রবণতা, আত্মম্ভরিতা ও অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস, তার সঙ্গে নির্মম নিয়তিযুক্ত হয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। অবশ্য গ্রীক ট্র্যাজেডিতে অদৃষ্টবাদেরই কিন্তু প্রাধান্য। চূড়ান্ত সর্বনাশের মধ্যেও অয়দিপাউস তার মর্যাদাকে হারিয়ে ফেলে না।

শেক্‌স্পীয়রের ট্র্যাজেডি গ্রীক ট্র্যাজেডির মত ধর্মবিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নয়। দর্শকদের রুচি ও রসবোধের প্রত্যাশা পূরণের জন্যই তিনি নাটক রচনা করেছিলেন। শেপীয়র গ্রীক নাটকের ভিত্তিতে অ্যারিস্টট্‌লের স্থান-কাল-ঘটনার ঐক্যকে অগ্রাহ্য করেছেন। শেক্‌স্পীয়রীয় ট্র্যাজেডিতে কোরাস, অভিনেতাদের নির্দিষ্ট সংখ্যা, বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিধিনিষেধ ইত্যাদি নেই। তাঁর নাটকে হত্যাসহ হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শিত হয়। শেপীয়রের ট্র্যাজেডি নাটকের এমুন একটি ঐতিহ্য অনুসরণ করেছে যা অংশত রোমান ট্র্যাজেডি রচয়িতা সেনেকার (Seneca) রচনা এবং অংশত মধ্যযুগীয় রহস্য নাটক এর (mystery plays) ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেনেকা থেকেই ইংরেজি ট্র্যাজেডিতে রক্তপাত ও প্রতিশোধের দৃশ্য প্রবর্তিত হয়। শেক্‌স্পীয়রীয় নাটকের পঞ্চাংক বিভাগও সেনেকা থেকেই গৃহীত হয়েছিল। তবে শেক্‌পীয়র এই ঐতিহ্যকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেন নি, নিজের বাস্তব জীবনবোধ ও জীবনাভিজ্ঞতা এবং নাট্যপ্রতিভার ওপরই অধিক পরিমাণে নির্ভর করেছেন। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে মানুষ অনেক পরিমাণেই নিয়তির দ্বারা প্রভাবিত, বা ভাগ্যদেবী অদৃষ্ট তাদের কৃতকর্মের জন্য প্রতিশোধ নেয়, তাকেই বলা হয় নেমেসিস (Nemesis)। অয়দিপাউসের অদৃষ্ট সম্পর্কে দৈববাণীতে যা ঘোষিত হয়েছিল, তার থেকে নিজেকে উদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অদৃষ্টের কাছে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। কিন্তু শেক্‌স্পীয়রের ট্র্যাজেডিতে দেখা যায়, নায়কদের জীবনের শোচনীয় পরিণামের জন্য দায়ী তাদের কোনও চরিত্রগত ত্রুটি। তাঁর ট্র্যাজেডির নায়কদের জীবন যেভাবে অন্তদ্বন্দ্ব ও বাইরের সংঘাতে আলোড়িত হয়, তা গ্রীক ট্র্যাজেডিতে দেখা যায় না। তারা নিজেদের চরিত্রগত মারাত্মক ভ্রমের জন্যই জীবনে দুঃখ, যন্ত্রণা এবং অবশেষে মৃত্যুকে বরণ করেছে। Macbeth নাটকের নায়ক ম্যাকবেথের পতনের মূল কারণ তার উচ্চাকাঙ্খা, King Lear নাটকের নায়ক রাজা লিয়ারের অদৃষ্ট বিড়ম্বনার মূলে আছে তাঁর অহংবোধ, Othello নাটকের ওথেলোর ট্র্যাজেডির কারণ তার অহমিকা ও ঈর্ষাপরায়ণতা, Hamlet নাটকের ট্র্যাজেডির কারণ তার চিন্তাশীলতা ও অস্থিরচিত্ততা। সেইজন্যই শেক্‌পীয়রের ট্র্যাজেডিকে বলা হয় Tragedy of Character; তাঁর রচনায় চরিত্রই ভাগ্য – character is destiny।

শেপীয়রের ট্র্যাজেডিতে দৈবীশক্তির প্রভাব, নিয়তিলীলা, আকস্মিক যোগাযোগ প্রভৃতি যে নেই তা নয়। কিন্তু তিনি বহিঃশক্তির ক্রিয়া বা প্রভাবকে চরিত্রগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এমন নিপুণভাবে সমন্বিত করে দিয়েছেন যে তাঁর ট্র্যাজেডির নায়কদের কখনই অদৃষ্টের ক্রীড়নক মনে হয় না, মনে হয় না তাদের পরিণাম দৈবীশক্তির দ্বারা পূর্ব-নির্ধারিত বিধানের ফল; তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আমাদের সামনে সব সময়ই উজ্জ্বল হয়ে থাকে। সোফোক্লিসের Oedupus নাটকের অয়দিপাউসকে শেষ পর্যন্ত অদৃষ্টের অসহায় শিকার বলেই মনে হয়। শেক্‌স্পীয়রের ট্র্যাজেডির নায়করা ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রগুলিকেও গতিশীল ও সজীব বলে মনে হয়। তারা প্রত্যেকেই যেন একটা জীবনরহস্য, প্রতিটি মানুষ বিশেষ পরিস্থিতিতে জীবন্ত, অদ্বিতীয়, যার যা স্বধর্ম সেই নিয়মে নিত্য নবরূপে সে উদ্ঘাটিত। সেইজন্যই শেক্‌স্পীয়রের ট্র্যাজেডির আবেদন বিশ্বজনীন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ও কালের মানুষেরা তাঁর ট্র্যাজেডিগুলিতেই চিরন্তন মানবসত্যকে উদ্ভাসিত হতে দেখেছে, নানা ব্যাখ্যায় চরিত্রগুলির হৃদয়রহস্যকে ধরার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কখনই তার অন্ত পায় নি। ঈশ্বরের সৃষ্টির মতই শেক্‌স্পীয়রের চরিত্রগুলি চিরনবীন, চিররহস্যময়।