জীবনের নিষ্ঠুর দুঃখময় উপলব্ধি থেকেই ট্র্যাজেডির জন্ম। কেউই সুখী নয়। এই চিরন্তন উপলব্ধি থেকেই ট্র্যাজিক উপলব্ধির সৃষ্টি। সফোক্লিসের নাটকে এই সত্য প্রকাশিত যে, ‘কবরে যাওয়া না পর্যন্ত কারুর শাস্তি নেই। ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবনের’। মৃত্যুতে সত্যের দারুণ মূল্য পাবার জন্যেই যে মানুষ চিরজীবন দেনা শোধ করে চলেছে, এই সত্য রবীন্দ্রনাথেরও শেষ অভিজ্ঞতা। ট্র্যাজেডি এই নিদারুণ মূল্য দেবার নাট্যরূপ। মহাজীবনের এই চিরস্তন রহস্যকে বোঝাবার জন্যেই মানুষের শিল্প সাধনা। ট্র্যাজেডি সেই সাধনারই শিল্পরূপ।

ট্র্যাজেডি নাটকের সংজ্ঞা :

অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়োটিকস গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ট্র্যাজেডির যে সংজ্ঞ দিয়েছেন, তা হল— “Tragedy then is an imitation of an action that is serious. complete and of certain magnitude, in language embelished with each kind of artistic oritament the several kinds being found in separate parts of the play: in the form of action not of narrative, through pity and fear effecting proper pargation of these emotions.” সংজ্ঞাটিকে এইভাবে সাজানো যেতে পারে—

  • (ক) ট্র্যাজেডি দৃশ্য কাব্য, শ্রব্য কাব্য নয়। (মহাকাব্য থেকে এইজন্য পৃথক)
  • (খ) ট্র্যাজেডিতে ‘সিরিয়াস বিষয়বস্তু উপস্থাপিত। (কমেডির সঙ্গে এইখানেই তার পার্থক্য) 
  • (গ) ট্র্যাজেডিতে pity and fear উপস্থাপিত বলেই ট্র্যাজেডি ভয়ানক মিশ্রিত করুণ রসের নাটক।
  • (ঘ) গীত ও ছন্দোবদ্ধ সংলাপের সাহায্যে ট্র্যাজেডিতে অনুকরণ সম্পন্ন হয়।

এককথায় বলতে গেলে বলা যায় যে, ট্র্যাজেডি জীবনের ভয়ানক ও করুণ ঘটনা অবলম্বনে রচিত, ভয়ানক মিশ্র করুণ রসাত্মক দৃশ্যকাব্য। ট্র্যাজেডিও তাঁদেরই কাহিনি–“Those who have done, or suffered something terrible.”

ট্র্যাজেডি নাটকের উপাদান :

অ্যারিস্টটলের হিসাবে ট্র্যাজেডির উপাদান ছয়টি, যথা— ১। বৃত্ত (plot) ২। চরিত্র (character) ৩। ভনিতি (diction) ৪। মনন (thought) ৫। দৃশ (spectacale) ৬। গীত (songs)। প্রত্যেক নাটকেই এই সমস্ত উপাদান থাকে এবং এদের সুষ্ঠু প্রযোজনার ওপরেই রচনার সাফল্য নির্ভর করে। শুধু তাই নয় এদের প্রকৃতির মধ্যে বিশেষ বিশেষ রচনার স্বাতন্ত্র্য নিহিত থাকে। যে শিল্পী যতো সুষ্ঠুভাবে এদের যোজনা করতে পারেন অর্থাৎ যিনি যত পরিপাটি করে বৃত্ত, যত গভীর ও নির্দোষ করে চরিত্র, যত চিত্তাকর্ষক করে ভর্নিতি, যত সূক্ষ্ম করে মনন, যত সুসমঞ্জস করে দৃশ্য এবং যত মধুর ও ভাবগর্ভ করে গীতি রচনা করতে পারেন তিনি তত বড়ো শিল্পী হন।

ট্র্যাজেডি নাটকের গঠন :

ধর্মীয় বা সামাজিক যে-কোনো কারণই থাক, গঠনের দিক থেকে ট্র্যাজেডির উপযুক্ত বিশ্লেষণ অ্যারিস্টটলই প্রথম করেছেন। তাঁর মতে—

১। ট্র্যাজেডি হবে কোনো ঘটনার অনুকরণ। 

২। জীবনের কোনো গুরুতর ঘটনাই হবে ট্র্যাজেডির বিষয়।

৩। ট্র্যাজেডির ঘটনাটি হবে স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং তার একটি পরিমিতি থাকবে। 

৪। ট্র্যাজেডির রচনারীতিতে থাকবে আনন্দজনক উপাদান। এই আনন্দজনক উপাদান তিনি ছন্দ ও সংগীতকেই বুঝিয়েছেন। 

৫। ট্র্যাজেডিতে থাকবে নাটকীয়তা, তা বিকৃতমূলক নয়।

৬। ট্র্যাজেডি সহানুভূতি ও ভয় উদ্রেক করে ওই অনুভূতিগুলি থেকে মানুষের চিত্তকে বিমুক্ত করে।

ট্র্যাজেডির নায়ক : ট্র্যাজেডির নায়ক কী ধরনের চরিত্র হতে পারে এবং তার চরিত্রের কোনো কোনো বৈশিষ্ট্য ট্র্যাজিক সংবেদন ঘটাবার কাজে সাহায্য করতে পারে অ্যারিস্টটল তাও নির্দেশ করেছেন—

১। ট্র্যাজেডির নায়ক হবে মহিমা সম্পন্ন। 

২। ট্র্যাজেডির নায়ককে হতে হবে বিখ্যাত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

৩। অতি ভালো মানুষ বা অতি ধার্মিক ব্যক্তি কখনও ট্র্যাজেডির নায়ক হতে পারেন না, কারণ তাঁদের দুর্ভাগ্যের কাহিনি আমাদের মনে করুণা ও দুঃখ জাগায় না।

৪। অতি মন্দলোকও ট্র্যাজেডির নায়ক হতে পারে না, কারণ তার পতন আমাদের মনে কোনো সহানুভূতি জাগায় না। 

৫। ট্র্যাজেডির নায়কের শোচনীয় ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবার জন্য বাহ্যিক কারণ আবশ্যক অর্থাৎ নায়কের প্রবল আত্মবিশ্বাসের জন্য তিনি এতো অতিরিক্ত গর্বিত যে দেবতার সাবধান বাণীকেও গ্রাহ্য না করে নিজের পতন ডেকে আনেন। এটাই তাঁর দুর্বলতা।

বাংলা সাহিত্যে ট্র্যাজেডি : বাংলা সাহিত্যে প্রথম ট্র্যাজেডির নিদর্শন জে. সি. গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’। রচনা অমার্জিত এবং বিশৃঙ্খল হলেও নাটক রচনার প্রথম প্রচেষ্টা বলে এ নাটকের ঐতিহাসিক মূল্য অবশ্য স্বীকার্য। তবে বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক হল—মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’। এছাড়া দীনবন্ধু মিত্রের—‘নীল দর্পণ’ গিরিশ ঘোষের ‘প্রফুল্ল’, ‘বলিদান’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘শাজাহান’, ‘নূরজাহান’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’, ‘মালিনী’, ‘রাজারানী’, তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ প্রভৃতি নাটক বাংলা সাহিত্যে চিরন্তন ট্র্যাজেডি নাটকের আসন অলংকৃত করে আছে।

একটি বাংলা ট্র্যাজেডি নাটক :

বাংলা নাট্য-সাহিত্যের স্বীকৃত প্রতিভা গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘জনা’ নাটক এই সার্থকতায়্ বিভূষিত। মহাভারতের বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছেন এবং দ্বিগ্বিজয় করার উদ্দেশ্যে সেই অশ্ব নিয়ে বিভিন্ন রাজ্য পরিক্রমায় বার হয়েছেন অর্জুন ও কৃষ্ণ। তাঁরা নীলধ্বজের রাজ্যে উপস্থিত হয়েছেন। এই খবর জানিয়ে অগ্নিদেব রাজাকে অনুরোধ করেন শ্রীকৃষ্ণকে পূজোপচারে বরণ করে নেবার জন্য। রাজ্যের সকলেই এই প্রস্তাবে একমত, শুধু জনা একথা মানতে পারেন না। তিনি বলেন, শ্রীকৃষ্ণ যদি পূজা পাবার জন্যেই তাঁদের কাছে আসতেন, তাহলে তাঁকে বরণ করে নিতে তাঁর কিছুমাত্র আপত্তি ছিল না, কারণ তিনি নিজেই হরিভক্ত। কিন্তু হীনতা স্বীকার করে কৃষ্ণকে পূজা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব, যেহেতু শ্রীকৃষ্ম ঈশ্বর হিসাবে এখানে আসেননি, ‘অরিরূপে নারায়ণ আসিয়াছে ঘরে। সুতরাং তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে আহ্বান না জানানো হলে ক্ষত্রিয় ধর্মের অসম্মান ঘটে। জয় পরাজয় মানুষের হাতে নয়, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের এই রণের আহ্বান উপেক্ষা করা কোনো ক্ষত্রিয় বীরেরই উচিত নয়।

জনার একথা সকলে অগ্রাহ্য করে। করতে পারে না মাতৃভক্ত বীরপুত্র প্রবীর। প্রবীর অর্জুনের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব আটকায় এবং অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে সে তিলমাত্র ভীত হয় না, কারণ মাতৃভক্তি তার অপরিসীম। ‘মাতৃনাম কবচ আমার’ এবং সে জানে, মায়ের যদি আশীর্বাদ থাকে তবে মহা শক্তিধরকেও পরাস্ত করা তার অসাধ্য নয়। কাজেই জনার নির্দেশে অর্জুনের সঙ্গে প্রবীর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু অন্যায়ভাবে ছলনাময় কৃষ্ণ প্রবীরের সমস্ত শক্তি হরণ করে নেন, অর্জুনের হাতে সে নিহত হয়। এবার জনার রোষবহ্নি হতে অর্জুন কেমন করে নিজেকে বাঁচাবে ? সে উপায়ও বলে দেন কৃষ্ণ অর্জুনকে। অসহায় জনা শেষ অবলম্বন হিসাবে ভাইকে অনুরোধ জানান কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে। ভাই অসম্মত হওয়ায় শেষপর্যন্ত জাহুবীর জলে জীবন বিসর্জন করা ছাড়া কোনো উপায় তার থাকে না। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়—জনা প্রসন্নমুখে মাতা জাহুবীর কোলে বসে আছেন।

অ্যারিস্টটল নির্দেশিত ট্র্যাজেডির স্বরূপ বিশ্লেষণ অনুসরণে এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি—

১। জনা নাটকের ঘটনাটি অবশ্যই গুরুগম্ভীর। অন্য সকলে যখন ভক্তির আবেগে প্রবাহিত তখন যুক্তির বলিষ্ঠতায় জনা, নিজের চিন্তা শক্তি অটল রাখতে পেরেছেন। ক্ষত্রিয়ধর্মের সঙ্গে ভক্তি ধর্মের এই সংঘাত যথার্থ ট্র্যাজেডির উপযুক্ত বিষয়।

২। নাটক হিসাবে ‘জনা’ স্বল্পায়তন নয়।

৩। এ নাটকের সুস্পষ্ট আরম্ভ আছে, দ্বন্দ্বময়তায় কাহিনির স্পষ্ট নাট্যদেহ আছে এবং একটি সুনির্দিষ্ট উপসংহারও আছে।

৪। এ নাটকের গঠনশৈলী, ভাষা এবং সংলাপগুলি নির্দিষ্ট ছন্দের দ্বারা সুগ্রথিত, যা ট্র্যাজেডি নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

৫। ট্র্যাজেডি সার্থক করে তুলতে হলে যে বর্ণনামূলক রীতি বর্জন করে নাটকীয় রীতি

অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ঘটনা সংঘটনমূলক রীতির দিকে নজর করতে হয়, জনা নাটকে সর্বত্র তা নাট্যকারের স্মরণ ছিল। 

৬। জনায় যে নাটকীয় ঘটনাগুলি দেখানো হয়েছে তা আমাদের মনে করুণা ও সহানুভূতির সৃষ্টি করে। 

তাই অ্যারিস্টটল নির্দেশিত ট্র্যাজেডির লক্ষণ অনুযায়ী বিচার করলে একথা বলা যায় (এ নাটকের শেষ অঙ্কটি বর্জিত হলে) ‘জনা’ বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য ট্র্যাজেডি।