সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, নামে কি আসে যায়, কেউ বলেন নামেই সব, কেউ বলেন নামের মধ্যেই ফুটে উঠতে হবে গল্পের ব্যঞ্ছনা বা মুখ্য উপজীব্য। আবার কারও কারও মতে, পাঠককে গল্পের বিষয় নির্দেশ করে দেওয়া মতো নামকরণ অনুচিত কেন না, তাতে পাঠক পরিণামের আশা নিয়েই গল্প পাঠ করতে শুরু করবেন। গল্পের রহস্য নিজে অনুসন্ধানের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন। সাধারণত দেখা যায় এই সূত্রানুযায়ী ছোটগল্পের নামকরণ তার নায়ক বা নায়িকার বা প্রধান চরিত্রের নামে করা হয়ে থাকে, কিংবা গল্পের প্রধান বক্তব্য বা প্রধান ঘটনা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আলোচ্য গল্পটির নামকরণ সেই রকম গল্পের মূল ঘটনা কেন্দ্রিক।
আলোচ্য গল্পটির মধ্যে আমরা দেখি গল্পকথক রামগঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরীর কাছ থেকে হঠাৎ একটি বাঘের চামড়ার জুতো উপহার পেয়ে প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলেন। তারপর তাঁর মনে পড়েছিল। মাস আষ্টেক আগের এক আরণ্যক ইতিহাসের কথা। রাজাবাহাদুর তাঁকে শিকারের সঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন তরাইয়ের কোনো এক অরণ্যের গভীরে রাজাবাহাদুরের শিকার বাংলোয়। রাজাসাহেবের বদান্যতা তুলনারহিত। গল্পকথক আসবেন বলে, তাঁর সঙ্গে চা পান করবেন বলে তিনি প্রতীক্ষা করছিলেন। কল্পকথক কবি বলেই তিনি তাঁকে বিশেষ সম্মানের আসন দান করে থাকেন। এমনকি কোনো এক উপলক্ষে সোনার ঘড়িও উপহার দিয়েছিলেন। সেই রাজাবাহাদুরের শিকারের সঙ্গী হয়ে গল্পকথক রাত্রিতে শিকারের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, তাতে বাঘ ভালুক শিকারের ভয়াবহতা ছিল না। ছিল মশার দংশনের জ্বালা। তিন রাত তারা জঙ্গলে জঙ্গলে ফিরেও তেমন কিছু পাননি। বিরক্ত হয়ে একটা হায়নাকেই হত্যা করেছিলেন রাজাবাহাদুর।
তিনটি রাত্রি বৃথা কাটবার পর কথক রাজাবাহাদুরের কাছে বিদায় চাইতে গেলে রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর অস্ত্রশস্ত্র, বীরত্বের নিদর্শন স্বরূপ দেওয়ালে টাঙানো হাতি বাঘ ভালুকের মাথাগুলোকে নিশ্চয়ই তাঁর মান্যবর অতিথি ‘ফার্স’ বলে মনে করছেন। তাই তাঁকে আর এক রাত্রি থাকতে অনুরোধ করলেন। এবং বললেন, যে তিনি মাছ শিকার করবেন। সেই শিকার দেখার পর অতিথিকে আর আতিথ্যে রাখা যাবে না। সে শিকার অত্যন্ত গোপনে করা হবে। তিনি মাছ শিকার করবেন বাংলোর পিছন দিকের চারশো ফুট নীচের খাদ থেকে, যেখান দিয়ে একটি নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। আর চারপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল—প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব।
রাত্রে অতিথিকে তিনি ডেকে নিয়ে চললেন মাছ ধরতে। খাদের ধারে কাঠের রেলিং দেওয়া সাঁকো মতো আছে। তার দুপাশ কপিকলে দড়ি জড়ানো থাকে। সেই দড়িতে করে টোপ নামানো হল আড়াইশো ফুট নীচে। সাঁকোর ওপর দুটো চেয়ারে বসলেন দুজনে। রাজাবাহাদুরের এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে টর্চ। মাঝে মাঝেই টর্চের আলো ফেলে তিনি দেখছেন শিকার টোপের লোভে আসছে কি না। স্নান জ্যোৎস্নালোকে মনে হচ্ছে যেন টোপটা মৃদু মৃদু নড়ছে। কথকের চোখ ঘুমে জড়িয়ে গেছে। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছেন। এমন সময় গর্জে উঠল রাজাবাহাদুরের বন্দুক। নীচে আলো ফেলে দেখা গেল প্রকাণ্ড একটা বাঘ টোপের ওপর একটা থাবা রেখে অন্তিম আক্ষেপে ল্যাজ আছড়াচ্ছে। অব্যর্থ লক্ষ্য রাজাবাহাদুরের। তাঁকে গল্পকথক অভিনন্দিত করতে যাবেন এমন সময় শুনতে পেলেন চারশো ফুট নীচে থেকে উঠে আসছে শিশুর গোঁঙানি। গল্পকথকের শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল রাজাবাহাদুরের মাছ শিকারের টোপ দেখে। তাঁর বাংলোর কীপারের বেওয়ারিশ সম্পত্তি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের থেকে একটার হাত মুখ বেঁধে তিনি টোপ করেছিলেন তাঁর মাছ শিকারের।
বাঘ শিকারের উদ্দেশ্যে রাজাবাহাদুর রাতে বনে গিয়ে হায়না মেরেছেন, সেটা কোনো ঘটনা নয়। নিজের বিলাসিতা ও নামের জন্যে, কৃতিত্বের জন্যে একটা ছোটছেলেকে শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছেন সেই পাশবিকতাই এখানে বড়ো করে দেখানো হয়েছে। বাঘ বা বাঘের চামড়ার জুতো কিংবা অরণ্যে আতিথ্যের চেয়ে শিহরিত করেছে রাজাবাহাদুরের টোপের পরিকল্পনা। সেই নৃশংসতা ব্যাখ্যা করাই লেখকের মূল উদ্দেশ্য ছিল বলেই, শিশুর বিনিময়ে লন্ধ বাঘের চামড়ার জুতো তিনি নরম ও আরামদায়ক বলে জানিয়েছেন। বস্তুত, আলোচ্য গল্পের মধ্যে রাজাবাহাদুরের বীরত্বের নিদর্শন রূপে বাঘ, ভালুক বা দাঁতাল হাতির মুণ্ডুর চেয়ে নৃশংসতার অভিজ্ঞান স্বরূপ মানবশিশুর টোপ অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। তাই আলোচ্য গল্পের ‘টোপ’ নাম যথাযথ হয়েছে বলে মনে করা যায়।
Leave a comment