ছোটোগল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের পটভূমি বাংলাদেশের মাঠঘাট, দিগন্ত থেকে শুরু করে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চল, চা বাগান, ডুয়ার্স তরাই-এর গভীর ও হিংস্র অঞ্চল পর্যন্ত বহুদূর বিস্তৃত। কখনও মানুষের মনের বিশেষ ভাব, কখনও কোনো চরিত্রের সবিশেষ পরিচিতি। কখনও কোনো বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপন করার জন্যে তিনি রচনা করেছেন তাঁর গল্পের জগৎ। আলোচ্য ছোটোগল্পটিও সেই রকমই এক সৃষ্টি যেখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে আপাত সম্ভ্রান্ত বদান্য মুখোশের আড়ালে লুকানো মানবচরিত্রের দুঃসহ হিংস্রতা। সে হিংস্রতায় মানুষের কাছে পশুও পরাজিত।

আলোচ্য গল্পের মধ্যে দেখা যায়, রামগঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরীর বদান্যতা ও দাক্ষিণ্য তুলনারহিত। সেই মহানুভবতায় তিনি গল্পকথক তথা লেখককে আকৃষ্ট করেছিলেন, তাঁকে শিকারের সঙ্গী হতে বলেছিলেন। লেখক তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাঁর শিকারের সঙ্গী হতে এসেছিলেন তরাই-এর অরণ্যে রাজাবাহাদুরের শিকার বাংলোয়। সেখানে রাজকীয় সম্মানে তাঁক সযত্নে রেখেছিলেন রাজাবাহাদুর। সারাদিন খেয়ে ঘুমিয়ে আলস্যে সময় কাটিয়ে রাত্রে গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে শিকারের খোঁজে যেতেন তাঁরা। এই অরণ্যে বাঘ-ভালুক-অজগর প্রভৃতি ভয়ঙ্কর হিংস্র জন্তুর অভাব নেই। তবে শিকারে গিয়ে তিন রাত্রি তাঁরা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পেলেন না। রাজাবাহাদুর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি হায়নাকেই মারলেন। কিন্তু নিজের বীরত্বের অভিমানে সে শিকারকে সেখানেই ফেলে রেখে এলেন।

এই ঘটনার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, এমনকি এর মধ্যে অমূলকতাও চোখে পড়ে না। রাজাবাহাদুরের লাউখেও অস্ত্রশালার দেওয়ালে সজ্জিত বাঘ ভালুক কিংবা দাঁতাল হাতির মাথাও শিকার-বীর রাজাবাহাদুরের বীরত্বের নিদর্শন রূপেই প্রতিভাত হয়। এই বাস্তবতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সার্থক ছোটোগল্পের প্রাথমিক শর্ত। এখানে তা পূর্ণ হয়েছে। সেই সঙ্গে লেখক তাঁর রচনার নৈপুণ্যে পাঠক চিত্তকেও ধীরে ধীরে রাজাবাহাদুরের শিকারের কাহিনির অত্যুজ্জ্বল ঘটনার শীর্ষবিন্দুর দিকে সকৌতূহলে নিয়ে গেছেন। উদ্দীপন বিভাবের বর্ণনায় কোথাও কোথাও অরণ্যের নিশুতি ভয়ঙ্কর রাতের আবহে পাঠকচিত্ত আচ্ছন্ন হয়, কোথাও কোথাও সাধারণ কালযাপক বর্ণনায় নির্বেদী হয়। তার মধ্যে দিয়েই কাহিনি এগিয়ে চলে পরিণামের দিকে একমাত্র শীর্ষবিন্দুর দিকে গল্পের গতির একমুখীনতায়।

সেই গতিতে রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে চলতে চলতে পাঠক লেখকের সঙ্গে এসে দাঁড়ায় চারশো ফুট গভীর খাদের ধারে, যেখানে কাঠের রেলিং দেওয়া সাঁকো তৈরি করেছিলেন রাজাবাহাদুর তাঁর সাধের মাছ শিকারের জন্যে। রাজাবাহাদুর নিজেই বলেছিলেন মাছের জন্যে ভালো টোপ না হলে তাঁর পছন্দ হয় না। তাঁর পছন্দের টোপটি কপিকলের সাহায্যে আড়াইশো ফুট নীচে নামিয়ে দেওয়ার পর, নিস্তব্ধ রাত্রে পলকহীন মুহূর্ত কাটছিল সাদা পুটুলির মতো অল্পনড়া টোপটার দিকে তাকিয়ে কখন মাছ আসবে সেই টোপের লোভে-গর্জে উঠবে রাজাবাহাদুরের বন্দুক। ঘন ঘন মদ্যপান করে রাজাবাহাদুর নিজের স্নায়ুকে উত্তেজিত রাখছিলেন। হঠাৎ গর্জে উঠেছিল তাঁর বন্দুক। টর্চের আলোয় দেখা গেল টোপের সন্ধানে এসে রাজাবাহাদুরের অব্যর্থ লক্ষ্যে মৃত্যু হয়েছে প্রকাণ্ড একটি বাঘের। লেখক এই শিকারের জন্যে রাজাবাহাদুরকে অভিনন্দিত করতে যাবেন, এমন সময় ঘটে গেল ক্লাইমেক্স। বাঘ শিকারটা নয় প্রধান হয়ে উঠলো টোপটা। টোপটা নিজেই জানালো তার পরিচয়—সে একটা শিশু—বাংলোর কীপারের বেওয়ারিশ সামগ্রী। এরপর প্রকাশ পেয়েছে লেখকের মন্তব্যে রাজাবাহাদুরের হিংস্রতা—কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর–লোককে ডেকে দেখানোর মতো।-এখানে এসে গল্পের ক্লাইমেক্সের অবসান বীভৎস ও ভয়ানক রসে সিক্ত হয় পাঠকের মন। করুণ রসের প্লাবনে ঘটে রস-নিষ্পত্তি। ছোটগল্পের অন্যতম শর্ত—‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ পূর্ণতা পায় রাজাবাহাদুরের প্রতি পাঠকের আক্রোশে আক্ষেপে। তাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আলোচ্য গল্পটি তাঁর প্রথম শ্রেণির গল্প হিসেবে বিবেচিত না হলেও ছোটোগল্পের লক্ষণ ও শর্তাদি সাপেক্ষে সব দিক থেকে বিচার করে গল্পটি যে ছোটোগল্প হিসেবে। সার্থকতা লাভ করেছে সে কথা অনায়াসে বলতে পারা যায়।