আধুনিক কবি বোদলেয়ার জগৎ জুড়ে শুধু সেইসব মানুষকে দেখেছেন—“….and man that greedy tyrant, lewd, merciless and grasping…..the tributary of a sewer” রাজাবাহাদুর যেন খানিকটাই তাই লোভী, মানুষের হত্যাকারী সব মিলিয়ে ‘ভূমিস্থ নর্দমান উপনদী (tributary) এক অনবদ্য সাসপেন্স, থ্রিলারের মধ্য দিয়ে তার অশুভ আত্মা, সামান্য নেশায় শিশুহত্যার পাপ—’টোপ’ গল্পে রক্তাক্ত ও নারকীয় উন্মসিকতায় লিপিবদ্ধ।
রামগঙ্গা এস্টেটের তরাইয়ের জঙ্গলমঙ্গলের মাঝে আর এন, চৌধুরী রাজাবাহাদুরের বাস। তাঁর রাজরক্ত চাটুকার তার তৃপ্ত আকবরের সভাসদ আবদুর রহিমদের মতো মোসাহেবের বন্দনা তাঁকে মোহিত করে। বিলাসিতার ‘গ্র্যান্ড হোটেল’ হিসাবে গড়ে তুলেছেন তাঁর বাংলোকে, বাংলোর সবকিছুকে। একটা গুণীজনের সভায় প্রশংসা পাওয়ার লোভ, অস্ত্রের আর শিকারের নমুনার প্রদর্শনে সমীহ আদায়ের ঐতিহাসিক রাজ-মনোভাব তাঁর মধ্যে বর্তমান। তাই বীরকীর্তির নিদর্শন ‘বাঘের চামড়া বা হাতির মাথা সাজিয়ে রাখেন ‘tipicalking’-দের মতোই। হিংস্রতা আর আদিম প্রবৃত্তি তার চরিত্রেও রক্তে। মৃদু কৌতুকে রাইফেল তাক করে বলেন “হাতে থাকলে বুঝতেন কতবড়ো শক্তিমান আপনি, ইউ ক্যান ইজিলি ফেস অল দা রাস্পেলস্—“পশুরা তার ‘rivals’ পশুতা তাঁর জিন-এ। সে হিংস্র চাউনিতেই হোক বা হিন্দুস্থানী কীপারের ছেলেদের মধ্যে পয়সা বিস্কুট ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যেই হোক। অথবা প্রথম দিনে শিকার না মেলায় নিজেকে ‘Devils Luck’ বলে গালি দেওয়াতেই হোক, বা সামান্য হায়নাকে শুধু স্বভাব বা প্রবৃত্তির নেশায় ‘Dam’ বলে শিকার করাতেই হোক। তার রক্তে ছিল আদিম হিংস্রতা বললেন—মাছের টোপ’। কিন্তু ব্যবহার করতে চলেছেন জ্যান্ত শিশুকে বাঘের টোপ হিসেবে। তবে তার মনেই একটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।—‘লক্ষ্য করেছি আজ সমস্ত দিন বেশি মদ খাচ্ছেন আর ক্রমাগত চুরুট টেনে যাচ্ছেন …ভেতরে ভেতরে কিছু একটা চলেছে তার।” দ্বন্দ্ব-বিবেকের ডাক। মানুষ ভেতরের পশুটাকে বাধা দিতে চাইছে। কিন্তু সামান্য শিকারের বাসনায় শিশুকে বলি দেন।
রাজাও প্রথমে মনুষ্যত্বের ‘ভয়’ করেছিলেন, তারপর ভালোবাসলেন কেবল নিজেকে—নিজের সম্মানকে। বীরকীর্তিতে একটি নতুন পালক বাড়ানোর লোভকে। তাই তিনি হত্যাকারী। নাকি, সামান্য কীপারের ছেলের হত্যায় পাপ নেই। সব মিলিয়ে তার মধ্যে এক অমানবিক নিষ্ঠুর রূপ ফুটে ওঠে।
“টোপ” গল্পের আশ্চর্য দক্ষতার লেখক তরাই অঞ্চলের আরণ্যক ইতিহাস ও প্রকৃতিকে ফুটিয়েছেন- আলোচনার করো।
নারায়ণ বাবুর ‘স্বর্ণসীজ’র নায়ক সোমনাথ জানিয়েছিল “কবিতা আমি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কারো পড়ি না’ দেহে মনে ওই একটি মানুষ। যিনি বাইরের জগতের সাথে মনোজগতের মিল ঘটিয়েছেন।” কথাটি লেখকের মনেরই কথা। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেম আর হাল আমলের ডিটেকটিভ গল্পের গা ছমছমে ভাব দিয়ে তিনি তরাই অঞ্চলের বনজঙ্গলের শোভা ও শিকারের বর্ণনা দিয়েছেন।
“You enter it by the Ancient way,
Through Ivory Gate and Golden” [Gothe] লেখক রামগঙ্গা এস্টেটের তরাই জঙ্গলের রোলস রয়েসে চেপে যেন সেই ‘Ivory Gate and Golden’ এ প্রবেশ করলেন, এলেন প্রাচীন সভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলে। মুগ্ধ চোখ নিয়ে দেখেন—“পথের দুপাশে তখন একটা জগতের ছবি। সবুজ শালবনের আড়ালে আড়ালে চা বাগানের বিস্তার। চকচকে উজ্জ্বল পাতার শান্ত, শ্যামল সমুদ্র ‘দূরে আকাশের গায়ে কালো পাহাড়ের রেখা।” রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন। মনে হয়—“Poetry of the Earth have never dead”-এর সাথে মিশেছে হাড়হিম করা জঙ্গলের বাঘ-ভালুকের ভয়। “তলায় দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল, তার মধ্যে দিয়ে পাহাড়ী নদীর একটা সঙ্কীর্ণ নীলোজ্জ্বল রেখা। যতদূর দেখা যাচ্ছে, বিস্তীর্ণ অরণ্যে চলেছে প্রসারিত হয়ে, তার সীমান্তে নীল পাহাড়ের প্রহরা। চমৎকার কিন্তু এও বাস্তব–“ওটি বড়ো সুবিধের জায়গা নয়। টেরাইয়ের ওয়া ওব দি ফিয়ারনেস্ট ফরেস্টস্। একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব।” প্রথম শিকারে সেই হিংস্র জন্তুও জঙ্গলের বর্ণনা—“এখানে হাতীর পাল ঘুরছে কোনো পাহাড়ের বিপদের সম্ভাবনায় উৎকর্ণ হয়ে আছে হরিণের পাল আর কোনো একটা খাদের ভেতরে জ্বলজ্বল করছে বাঘের চোখ। কালো রাত্রিতে জেগে আছে কালো অরণ্যের প্রাথমিক জীবন।” ভয়ঙ্কর সুন্দর। তারপর সেই বিচিত্র শিকার। `মৃত্যুর শীতলতা’ আর ‘গা ছমছমে’ প্রতিবেশ। এইভাবে গল্পে একটি আরণ্যক পরিবেশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
Leave a comment