নাট্যকার উৎপল দত্ত নাটক রচনা করতে বসে সংলাপের গুরুত্ব সর্বতোভাবেই স্বীকার করেছেন, তাঁর নাটক প্রচারের হাতিয়ার। এই প্রচার মার্কসবাদী পথে সমাজ পরিবর্তনের, শোষণ—মুক্তির। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর নাটকের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দৃশ্য অঙ্কিত হয়। শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব ও পরিণতি আঁকতে গেলে, চাই উপযুক্ত সংলাপ। সংলাপ তাই উৎপল দত্তের নাটকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁর নাটকের সংলাপে ফুটে ওঠে মালিক, শোষক, শাসক ও ক্ষমতাশালীর উদ্ধত অনমনীয় মানসিকতা। আবার তারই পাশাপাশি শোষিত, নির্যাতিত দুর্বলের প্রাণপণ টিকে থাকার সংগ্রামের উচ্চারিত মনোভাব ও সংলাপে ব্যক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত এই মনোভাবই জয়ী হয় নাটকে। আর সেই মনোভাবের উপযুক্ত ভাষ্যসংলাপ রচনা করেন নাট্যকার।

‘টিনের তলোয়ার’-এর প্রধান চরিত্র বেণীমাধব চাটুজ্যে। সে গ্রেট বেঙ্গল অপেরা কোম্পানির কাখেন এবং প্রধান অভিনেতা। তার লেখাপড়া বেশিদূর নয়। সে ইংরেজি জানে না। কিন্তু অভিনয়ে ইংরেজি সংলাপ আওড়াবার জন্য সে সাহেবের কাছে গিয়ে ইংরেজি উচ্চারণ শিখে নেয়। নাট্যাভিনয়ের প্রতি তার নিষ্ঠার অভাব নেই। সে তার থিয়েটারের মালিকের কাছে দায়বদ্ধ। সে এমন বই অভিনয় করে যাতে সরকারের কোপ দৃষ্টিতে না পড়তে হয়। সেইসঙ্গে সে নজর রাখে টিকিট বিক্রির প্রতি। দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় এমন নাটক মঞ্চস্থ হবে যাতে দর্শকদের ঢল নামে। তার মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দা বেণীর প্রতি আস্থাশীল। বেণীও মালিকের কাছে সবসময় করজোড়ে থাকে। একদিন বীরেন্দ্র থিয়েটারের মহলা কক্ষে এসে হাজির। তাঁকে দেখেই বেণী বলে ওঠে—’একি কর্তামশায় স্বয়ং ডেকে না পাঠিয়ে এই অভাগাদের কুঠিরে পদধূলি দিলেন? বেণীর এই উক্তিতে মালিকের কাছে তার আনুগত্যের প্রমাণ মেলে। কিন্তু বেণী নিজে লেখাপড়া বেশিদূর করতে না পারলেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মুর্খতা নিয়ে মসকরা করতে সে দ্বিধা করে না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বেণীকে ‘ভালো নাটক ধরুন’ বললে অমনি বেণী নির্বিকার কণ্ঠে বলে— ‘কী ধরবো ? দীনবন্ধুই লিখতে জানে না আর কে লিখবে? এবার হুজুর নিজে যদি কলম ধরেন তবে নাট্যশালা অলীক কুনাট্যে মজে থাকবে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়। বেণী খুব ভালো করেই জানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নাটক লেখা দূরে থাক লেখাপড়াই জানে না। তবু তাকে বেণী নাটক লেখার অনুরোধ জানায়। বেশ বোঝা যায় মালিকের কাছে জেনে বুঝে সে মোসাহেবি করেছে। বেণীর এই কথায় ধরা পড়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রতি বেণীর কত গভীর ঘৃণা।

প্রিয়নাথের সংলাপে প্রকাশ পেয়েছে বাংলা থিয়েটারে বস্তা পচা নাটকের অভিনয়ের প্রতি তীব্র ক্ষোভ এবং (সইসঙ্গে জাতীয়তাবোধের স্বীকৃতি। সে একাই বর্তমান থিয়েটারের পরিবেশ পালটে দিতে চায়। সে গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে—“(ভগ্নস্বরে) ভেবেছিলাম আপনাদের রিফরমেশনের আলোকে টেনে আনবো। ভেবেছিলাম ভারতের স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষা দেব। (সজোরে) এবং আমিই পারবো। মাইকেল চলে গেছেন দীনবন্ধু গত হয়েছেন—” এই সংলাপ এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেশ-সচেতন নাট্যকারের অন্তরঙ্গ পরিচয় উদ্ঘাটন করে। প্রিয়নাথ একজন ইংরাজি জানা নবশিক্ষিত যবুক। কথায় কথায় সে ইংরেজি শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে। তার ইংরেজি বুলিতে ভয় পেয়েছিল বাচস্পতি ও তার সঙ্গীরা। দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার মহলা কক্ষে নাকি মদ ও নারী নিয়ে বেলেল্লাপনা হয়। বাচস্পতিরা এই বেলেল্লাপনা বরদাস্ত করবেন না। তারা মহলা কক্ষে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকলে প্রিয়নাথ হঠাৎ চিৎকার করে বলে—’আই স্যাল টেক ইউ কোর্ট ফর দিস! ট্রেসপাসার ! ব্যাণ্ডিট ; আই স্যাল ব্রিং এন অ্যাকশন অফ ব্যাটারি এগেনস্ট ইউ । প্রিয়নাথের মুখে ইংরেজি বুলি শুনে ঘাবড়ে যায় বাচস্পতির দল। তারা সঙ্গে সঙ্গে মহলা কক্ষ পরিত্যাগ করে। প্রিয়নাথের এই উত্তিতে ইংরেজি জ্ঞান প্রকাশ পেলেও এক প্রবল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর যুবকের প্রতিমূর্তিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে থিয়েটারের মহলা কক্ষে পবিত্রতা রক্ষার মনোভাবও ব্যক্ত হয়েছে।

ময়না যে কতখানি অমার্জিত তা তার ভাষার দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়। সে রেগে গেলে শালা বেল্লিক বলতে দ্বিধা করে না। তাঁর ঠোঁঠে থিয়েটার উচ্চারিত হয় ‘থেটার’। ময়নার ‘শ’ ‘স’ উচ্চারণ যথাযথ নয়। তাকে ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলে যদু বলেছিল—’ফড়িং প্রজাপতি হয়েছে। ময়না সঙ্গে সঙ্গে বলে বসে ‘তোর বাপ ফড়িং ছিল’। ময়নার এভাষা তীব্র ক্রোধের ও ঘৃণার। তার মুখে এ ভাষা অস্বাভাবিক নয়। ময়না থিয়েটারে অভিনয় করে নাম করেছে। তার এখন স্বচ্ছল অবস্থা। কিন্তু থিয়েটারের স্বার্থে ময়নার ভাগ্য বদল হতে চলেছে। থিয়েটারের মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নজর পড়েছে তার প্রতি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাকে রক্ষিতা রাখতে চায়। তার এই আশা পূরণ না হলে, সে আর থিয়েটার চালাবে না। তখন থিয়েটার চালু রাখার স্বার্থে বেণীমাধব ময়নাকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হাতে তুলে দিতে রাজি হল। কারোর বারণ সে শুনল না। ময়না নিম রাজি হল শেষ পর্যন্ত। সে বিমর্ষ কণ্ঠে বলেছে ‘ভিখিরি যখন ছিলাম তখন তরকারি বেচে পেট চালাতাম। এখন এমন ভদ্রমহিলা বানিয়েছে বাবু যে বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া আর পথ নেই। কেন তুলে এনেছিল রাস্তা থেকে। জবাব দাও। কেন রাস্তা থেকে তুলে এনে আমায় এই অপমান করলে। ময়না স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করত তরকারি বেচে। থিয়েটারে নায়িকা হয়েও সে স্বাধীন জীবিকার সন্ধান পেয়ে আনন্দ পেয়েছিল, কিন্তু এই থিয়েটারেই তাকে ঠেলে দিল অপমানের জীবনে। শেষ পর্যন্ত থিয়েটারের জন্য তাকে হতে হল রক্ষিতা।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ উনিশ শতকের বাংলা থিয়েটারের মালিকের যথার্থ প্রতিনিধি। সে ব্যবসাদার। পাটের ব্যবসার সঙ্গে মুৎসুদ্ধি গিরি করে তার প্রভূত অর্থাগম হয়। নাট্যসরস্বতী সাধনার নিমিত্ত সে থিয়েটার খোলেনি। তার থিয়েটার খোলার একমাত্র উদ্দেশ্য থিয়েটারের অভিনেত্রীদের আপন শয়নকক্ষে রক্ষিতার বেশে তুলে আনা। রক্ষিতা তার অনেকগুলি আছে। কিন্তু অল্পবয়স্কা রূপসী নায়িকার প্রতি তার টান অপরিসীম। যেদিন সে ময়নাকে দেখেছে সেই দিনই সে স্থির করেছে, ময়না তার শয্যাসঙ্গিনী হবেই। শেষ পর্যন্ত হল তাই। ময়নাকে সে শংকর বলে। শংকরীকে দেখিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বেণীকে বলে ‘ওই শংকরী পাখা মেলে উড়ছে যার তার সঙ্গে ওকে আমি— ইয়ে—রাখবো, সে ব্যাপারটা করে দিতে হবে। বীরেন্দ্রকৃষ্মের এই উক্তিতে কে নো সংকোচ নেই। সে তার মনের গোপন বাসনা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে, কারণ সে থিয়েটারের মালিক। তার কথা রাখা না হলে থিয়েটার উঠে যাবে। অতএব থিয়েটারের কাপ্তেনের পক্ষে সম্ভব নয় মালিকের কথার নড়চড় করা। বীরেন্দ্রকৃষ্মের ব্যবসা ইংরেজদের সঙ্গে। কোনোক্রমে। সেই ইংরেজদের চটানো চলবে না। থিয়েটারে এমন নাটক অভিনয় করা চলবে না যাতে ইংরেজ বিরোধী বিষয় উপস্থাপিত হবে। আর তাছাড়া বীরেন্দ্রকৃষ্ণ খবর রাখতো, গ্রেট ন্যাশন্যাল থিয়েটারে ইংরেজ বিরোধী নাটকের অভিনয় করা নিয়ে সরকার পক্ষ চটেছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেদিন জানাল তার থিয়েটারে প্রিয়নাথের তিতুমীর নাটক হতে চলেছে, সে সেদিন বলেছে—‘সে নাটক হচ্ছে না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কথায় সবাই হেসে উঠলেও তিতুমীর নাটক করার হিম্মত কেউ দেখাতে পারেনি। অবশ্য বেণীমাধব প্রতিবাদ করতে গেলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছেন—’এ নাটক হতে পারছে না বেণীবাবু, হচ্ছে না। এ নাটকে সাহেবদের গালি দিয়েছে। যে সাহেবরা অশেষ কষ্ট সহ্য করে এদেশে এসে সতীদাহ নামক কুপ্রথা নিবারণ করে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে আমাদের সভ্য করলেন, এ নাটক সেই সাহেবদের গাল দিয়েছে’। এই উক্তিতে ধরা পড়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ইংরেজ আনুগত্য।

আলোচ্য নাটকের গুরুত্বপূর্ণ নটীর নাম বসুন্ধরা। সে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফীর শিষ্যা বলে গর্ববোধ করে। গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে সে তার নটীজীবন শুরু করে। তাকে সেখান থেকে বেশি মাইনে দিয়ে দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় আনা হয়েছে। এখন এই থিয়েটারের সঙ্গে সে নিজের জীবন জড়িয়ে নিয়েছে। বেণীকে সে গৃহকর্তার সম্মান দেয়। কোনো নাটকের ভূমিকা নির্দিষ্ট হয়ে গেলে সে তার পার্ট তাড়াতাড়ি মুখস্থ করে ফেলে। সে স্পষ্ট করেই বলে—‘পার্ট পেলেই আগে মুখস্থ করবো না’? তার এই কথায় প্রকাশ পায় সে নিষ্ঠাবতী নটী। থিয়েটারের নতুন নায়িকা ময়নাকে সে তার মেয়ের স্থানে বসিয়েছে। থিয়েটারের রীতি প্রথা প্রভৃতি বসুন্ধরা ময়নাকে শিখিয়ে দেয়। ময়নাকে যখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে চলে যেতে হবে, তখন বসুন্ধরা ব্যথা চেপে রেখেই বলেছিল— ‘ঘর বাঁধো ময়না। আমি ঘর বাঁধতে পারিনি। পনেরো বছর বয়সে এসে এক রাজা বাহাদুর তার নাম বলবো না, আমাকে চুরি করে নিয়ে যান। তাঁর শখ মিটে গেল শিগগিরিই। তারপর দেহ বেচে পেট চালিয়েছি বহু বছর। আর একাকীত্বের একটা দিগ্বিদিকহীন প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি নিরাপত্তা আর আশ্রয়ের খোঁজে। তুমি আমার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন ময়না। তোমার সংসার হোক, কোলে রাঙা ছেলে আসুক, তোমার মধ্যে আমি পূর্ণ হই। বসুন্ধরার স্বপ্ন ও সাধ অপূর্ণ থেকে গেছে। তারজন্যে মনে ক্ষোভ আছে কিন্তু বিক্ষোভ নেই। ময়নাকে আশীর্বাদ করার মধ্যে সেই ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। বসুন্ধরা পাঠকের কাছে সহজেই সহানুভূতি দাবি করতে পারে। বসুন্ধরা নিছক নটী নয়। তার মধ্যে বাস করে একজন দেশপ্রেমিকা।

উৎপল দত্ত নাটকের মূল পরিকল্পনার দিকে লক্ষ্য স্থির রেখে যেমন চরিত্র ও বিষয় পরিবেশন করেছেন, তেমনি তাদের উপযোগী ভাষা প্রয়োগেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত সংলাপের ভাষা যেমন চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি ঊনবিংশ শতকের পরিবেশকে যথাযথভাবে তা প্রকাশ করেছে।