‘টিনের তলোয়ার’ শুধু মুক্তি সংগ্রামের নাটক নয় পরিবেশনের গুণেই হয়ে উঠেছে হাস্যরসাত্মক । নাটকের প্রথম দৃশ্যে এক মেথরকে দেখা যায়। সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে— “আমি কলতলার তলায় থাকি।” সে লেখাপড়া জানে না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত পড়েনি। ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার নাম তার জানা নেই। কিন্তু সে ঘৃণা করে বামুন আর বাবুদের। বেণীমাধবকে যখন সে জানতে পারে বামুন, তখন কলতলার তলা থেকে ময়লা তুলে বেণীর পায়ের কাছে ফেলে। বেণীর গায়ে ময়লা লাগে। ময়লা অবশ্য লাগে না লাগানো হয়। মেথর বিনা দ্বিধায় বলে—“বামুন বলে আর একটু দিলাম।” তার এই থেকে প্রমাণ হয়—সে বামুনদের ওপর চটা। তার এ উক্তি যে হাস্যরসের সৃষ্টি করে তা নির্মম ব্যঙ্গ। ইংরেজিতে থাকে বলে স্যাটায়ার।

নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার মহলা কক্ষের ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শিত হয়েছে। সেখানে বেণীমাধব অনেকক্ষণ সকাল হয়ে গেলেও নিদ্রাভিভূত। অকস্মাৎ আগমন ঘটে ময়নার, যাকে রাস্তায় পেয়ে বেণী বলেছিল, থিয়েটারে তাকে নায়িকা করা হবে। তাই ময়না থিয়েটারে এসে হাজির। ময়নার এই আগমনে থিয়েটারের নটনটীদের কৌতূহল জাগায়। তারই হাস্যকরভাবে বহিঃপ্রকাশ হল—“ডাকাত পড়েছে। ডাকাতের ফিমেল সংস্করণ। ময়নাকে থিয়েটারে গ্রহণ করার পর বেণী তাকে স্নান করে আসার কথা বললে ময়না বলে—“অন্য লোকে আমায় স্নান করালে আমার লজ্জা করবে।” ময়নার শারীরিক লজ্জার প্রকাশে হাসির উদ্রেক করে।

প্রিয়নাথের সঙ্গে পরিচিত হবার পর বেণী তার জাত জিজ্ঞেস করলে প্রিয় যখন জানায় সে স্বর্ণ বণিক, তখন বেণী বলে,—“নুদুর নাদুর খচ্চরটি এ দলের মালিক। সে শালাও স্বর্ণবণিক।” বেণী তার দলের মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর কথা উচ্চারণ করতে চেয়েছে। এই মালিকের প্রতি ক্রোধের সীমা নেই। তার উক্তি হাসির উদ্রেক করলেও সে হাসি প্রবল ক্রোধের প্রকাশ ঘটায়।

বাচস্পতি তার দলবল নিয়ে বেণীমাধবদের মহলা কক্ষে হামলা করতে আসে। বাচস্পতির অভিযোগ বেণীমাধব–“মদ খেয়ে বিকট চিৎকার করে। দিবসে নিদ্রা যায়, দাঁড়াইয়া মুত্র ত্যাগ করে, মদের ঘোরে অন্য ঘরে ঢুকে পড়ে বমি করে।” বেণীমাধব সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নেয়, এসব মদ্যপানের অভ্যাসের প্রকাশ। তাই মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে সে বলে—“এইবার বুঝিলাম ঠাকুর আমার গুরুভাই, উনি খুব টানেন। এই উক্তি প্রত্যুক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও যথার্থ কৌতুককর।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তার নাট্যদলে একজন লেখক নিয়োগ করতে চায়, একথা শুনে হর বলে— ধরুন যদি কবি লর্ড বায়রণকে রাখেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ জানেই না লর্ড বায়রণ কে ? যখন সে শুনল বায়রণ একজন সাহেব তখন সে বলে ওঠে—“আঃ আমি ইংরেজিতে নাটক লিখব না বাংলায় ? বীরকৃষ্ণের মূঢ়তা আরও প্রকাশ পায় যখন সে বলে বঙ্কিমচন্দ্রকে মাইনে করে রাখবে। তখন বেণী সতর্ক করে দিয়ে বলে—–“দেখবেন লোকটা আবার ডেপুটি মেজিষ্ট্রেট তো, গুলিটুলি করে না বসে।” এসকল উক্তি সততই হাস্যরসের সৃষ্টি করে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ময়নার সান্নিধ্য পাবে, এই আশায় বেণীকে থিয়েটারের মালিক করে দেয়। বেণী আনন্দে গদগদ হয়ে বলে—“মেয়ে আমাদের সুপাত্তরেই পড়ল।” ‘সুপাত্তর’ শব্দটি যে তীব্র শ্লেষ, তা বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না। পক্ষান্তরে ময়নার ইজ্জত বেচে দিয়ে থিয়েটারের মালিক হবার স্বার্থান্ধ মনোভাব প্রকাশ করার মধ্যে বেণীর থিয়েটারি ব্যবসায় বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। বেণীর কথায় জানা গেল থিয়েটার গড়ে তোলার মূলধন হল থিয়েটারের নবীনা অভিনেত্রী। নাট্যকার উৎপল দত্ত বেণীর মতো নাট্যকর্মীদের ব্যঙ্গের শূলে বিদ্ধ করেছে।

চতুর্থ দৃশ্যে দেখা যায় ময়না সেজেগুজে সং দেখতে বেরিয়েছে। বৌবাজারে তার সঙ্গে দেখা মেথরের। ময়নার সজ্জিত বেশবাস দেখে মেথর কৌতুক বোধ করে। তৎক্ষণাৎ সে বলে— “তুমি তো মুচির কুকুরের মতো ফুলে উঠেছ দেখছি।” ময়নার চেহারা ও বেশবাসের চাকচিক্যের সঙ্গে মুচির কুকুরের ফুলে ওঠার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে মেথর। একথায় বিশেষ ব্যঙ্গের স্পর্শ পাওয়া যায়।

নাটকের শেষ দৃশ্যে যখন নিমচাঁদেবেশী বেণীমাধব নিমচাঁদের ইংরেজি সংলাপ আওড়াচ্ছে তখন বক্সে বসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে, ‘ব্রেভো’। তাই শুনে বেণী সঙ্গে সঙ্গে বলে—“তুই বেটা বিদ্যে খরচ করিসনে। তোর বাপ ব্যাটা বিষয় করেছে বসে বসে খায়, পাঁচ ইয়ারকে খাওয়া, মজা মার। হেয়ার সাহেবের স্কুলে তোর কোন্ বাপ পড়েছিল ? তুই কোন ক্লাসে পড়েছিস ?” এই উক্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রতি ব্যঙ্গ নিক্ষেপ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও ময়না উচ্চহাস্য করলে বেণী আবার বলতে থাকে—“বড়ো মানুষের বেটারা রমানাথের এঁড়ে সব কেলাস থেকে রমানাথের এঁড়ে বেছে সেই ক্লাসে দিয়েছিল।” বেণীর এই উদ্ভিতে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে বিরাট হাস্যরোল ওঠে। বীরেন্দ্রকৃষ্মকে বেণী তুলনা করে ‘রমানাথের এঁড়ের’ সঙ্গে। মূঢ় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এ তুলনার অর্থ জানে না। সে বোকার হাসি হাসে, নাট্যকার বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে এইভাবে হাস্যরসের চাবুকে ফালা ফালা করেছেন। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিপ্লবী থিয়েটারের নাটকে অতি অবশ্যই থাকবে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। এই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বর্ষিত হয় শোষকের প্রতি, শাসকের প্রতি ‘টিনের তলোয়ারে’ যে হাস্যরস পরিবেশিত হয়েছে, তা কেবলই ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও শ্লেষের তির্যক কটাক্ষ।