টিনের তলোয়ার নাটকের বসুন্ধরা চরিত্রটি সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো। অন্যভাবে বলা যায়, সমাজ-সংসারে এমন এমন রমণী থাকেন, যিনি শুধু নিজের নয়, গোটা সংসারের দায়ভার নিজের মাথায় নিয়ে বয়ে বেড়ান। আপন সুখ দুঃখের কথা না ভেবে, অন্যদের কটূক্তি উপেক্ষা করে সমস্ত দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে চলেন, অনেক সময় অন্যের জন্য নির্দিষ্ট কাজও হাসিমুখে নিজেই করেন। অন্যের আঘাতকে নিজের বুকে টেনে নেন। নিজের যন্ত্রণার কথা কখনও মুখ ফুটে বলেন না। এ নাটকে বসুন্ধরা এমনই এক নারী চরিত্র।

গ্রেট বেঙ্গল অপেরার দায়িত্বশীলা একজন অভিনেত্রী বসুন্ধরা। অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিয়ে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার যে নাট্যসংসার, বসুন্ধরা সেই সংসারের মূলকর্ত্রী। অভিনেতা অভিনেত্রীদের খাওয়া-দাওয়া, রান্না-বান্না, হেঁসেল সব কিছুর দায়িত্বে বসুন্ধরা। এমনকি কে বাজারে যাবে, সকালের জলখাবার কী হবে—সবই বসুন্ধরাকে ঠিক করতে হবে। একই সঙ্গে থিয়েটার সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি ব্যাপারও তাকে লক্ষ্য রাখতে হয়। মহলা তদারকি, জিরে রসুন দিয়ে তৈরি কাথ যা কিনা গানের গলা ভালো রাখে তা তৈরি করে দলের গায়ক যদুগোপালকে খাওয়ানো, কার ঘুমের ওষুধ দরকার, কাকে ডাকতে হবে, এসব কিছুই বসুন্ধরার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এমনকি পাওনাদার মুদি যখন দেনা শোধ করতে না পারার কারণে এসে গালিগালাজ করে, অ-কথা কু-কথা বলে তখনও তাকে বুঝিয়ে, তার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নগদ দামের পরিবর্তে নাটকে ব্যবহৃত সেজবাতি দিয়ে দলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব সব তাঁকেই পালন করতে হয়।

গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় ময়না আসার পর থেকে বসুন্ধরা তাকে মায়ের স্নেহে আগলে রেখেছেন। আত্মকথনের সুরে ময়নাকে তিনি জানিয়েছেন, যখন পঞ্চদশী কিশোরী তখন এক রাজা তাঁকে অপহরণ করে। আপন সখ মিটে যাবার পর শুকনো ফুলের মতো সেই রাজা যখন বসুন্ধরাকে ত্যাগ করে তখন নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের কারণে দেহ ব্যবসায় নামা ছাড়া বসুন্ধরার আর কোনো পথ থাকে না। এরপর তিনি গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে অভিনেত্রী হিসাবে যোগদান করেন, এবং অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফীর কাছে নাট্য শিক্ষা করেন। গ্রেট ন্যাশানাল থেকে বেণীমাধব বসুন্ধরাকে ফুঁসলে নিয়ে আসেন। অভিনেত্রী গোলাপ সুন্দরী ছিলেন বসুন্ধরার আদর্শ। তার স্বামী সন্তান সংসার হয়েছে। কিন্তু বসুন্ধরার ভাগ্যে সংসার জোটেনি। তাই ময়নাকে পেয়ে ময়নার মধ্যে নিজের সমস্ত মাতৃস্নেহ উজাড় করে দেন বসুন্ধরা।

ময়নাকে নাটকের অভিনয় শিখিয়েছে বেণীমাধব, কিন্তু মঞ্চের আদব-কায়দা, প্রথা প্রকরণ এমনকি প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের উন্মত্ত উল্লাসে ভীতা ময়নাকে সাহস জুগিয়ে বসুন্ধরা সত্য সত্যই ময়নার মা হয়ে উঠেছেন। মা যেমন মেয়ের মধ্যে নিজের পূর্ণতা খুঁজে পায় তেমনি বসুন্ধরা নিজের থেকেও ময়নাকে বড়ো অভিনেত্রী করে গড়ে তুলতে চান। ময়নার প্রতি দর্শকদের অভিনন্দনকে বসুন্ধরা সহৃদয় চিত্তে গ্রহণ করেন। থিয়েটারের অনেক অভিনেত্রীদের মতো বসুন্ধরা কখনও ময়নাকে ঈর্ষা করেনি, বরং নিজের অপূর্ণতাকে ময়নার মধ্যে পূর্ণ দেখতে চেয়েছেন। বেণীমাধব থিয়েটারের স্বার্থে ময়নাকে যখন বীরেন্দ্রকৃষ্মের রক্ষিতা করতে রাজি হয়ে যায় তখন দুঃখ বেদনায় বসুন্ধরার অস্তর বুঝি বা বিদীর্ণ হয়। সেই বিদীর্ণ হৃদয়ের প্রশ্ন— “মেয়েটাকে বেচে দিলে বাবু ?” ময়নাকে ক্লেদাত্তময় জীবন থেকে উদ্ধার করতে বলেন—“ময়না তুই চলে যা এই দল ছেড়ে।” যে বসুন্ধরা নিজে পতিতার জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে উঠে এসেছেন থিয়েটারে, তিনি কী করে চাইতে পারেন ময়না অভিনেত্রী থেকে পতিতার জীবনে চলে যাক। তবে ময়নাকে বাঁচাতে পারেন না বসুন্ধরা, তার বুকে গুমরে ওঠে কান্না, কিন্তু চোখের জল মুছে হাসি মুখে আবার তিনি নাটকের পার্ট বলতে থাকেন, তিনি যে অভিনেত্রী।

বসুন্ধরা থিয়েটার ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তিনি বেণীমাধবের মতোই বুঝতেন প্রিয়নাথের নাটকের গুরুত্ব। তিনিও তিতুমীরের নাটক, পলাশির যুদ্ধ নিয়ে নাটক প্রভৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, প্রিয়নাথের নাটক বন্ধ করে দিতে চাইলে মহলা কক্ষে যাঁরা প্রতিবাদের ঝড় তোলেন বসুন্ধরা তাদের মধ্যে একজন। তিনি অকপটেই জানান,— “আমরা কোন পালা গাইব না গাইব সেটা আর বাবুর হাতে নেই, এটা বাবু ভুলে যাচ্ছেন।” কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণের শাসানিকে ভয় পেয়ে বেণীমাধব তিতুমীর নাটকটি বন্ধ করলে বসুন্ধরা মনে মনে বড়ো আঘাত পান ৷ সখা, সচিব, গুরু, নাট্য সঙ্গী বেণীমাধবকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁর হাতের মদের প্রসাদ নিতে অস্বীকার করেন—“তোমাকে আর পুজোও করব না কোনোদিন। শুধু খোরাকির জন্য তোমাকে সহ্য করে এ দলে থাকবো।” এ শুধু অভিনেত্রীর অভিমানী অভিব্যক্তি নয়, সামাজিক অন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে এ এক নিরুচ্চার প্রতিবাদ।

বসুন্ধরার মধ্যে ছিল একটা সুপ্ত অথচ মহান দেশ প্রেমের আদর্শবোধ। নাটকের সপ্তম দৃশ্যে তার পরিচয় মেলে। সধবার একাদশীর নিমচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করতে বেণীমাধব যখন অকস্মাৎ দর্শকাসনে ল্যাম্বার্টকে দেখে তিতুমীরের সংলাপ আওড়াতে থাকেন তা দেখে সমস্ত কুশীলব হতবাক উদ্ভ্রান্ত হলেও বসুন্ধরাই একমাত্র বেণীমাধবের এই রূপান্তরের স্বরূপ বুঝতে পারেন। নিজের বেশ পরিবর্তন করতে করতে বসুন্ধরা মঞে প্রবেশ করে ছুঁড়ে দেন জলদের টুপী আর কোট। প্রেক্ষাগৃহের জনতা উল্লাসধ্বনিতে স্বাগত জানায় বসুন্ধরাকে। অর্থাৎ এথেকে এটুকুই প্রমাণিত হয়। সমগ্র জীবনে সামাজিক মর্যাদাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবসময় পেছনের সারিতে থাকা এই মহিলা নাট্যকর্মীর এই আচরণ দ্বারা নাট্যকার উৎপল দত্ত বসুন্ধরার মতো জীবন নাট্যে অবহেলিত নারীর হাতে বিপ্লবের ধ্বজা তুলে দিয়েছেন নাটকের শেষ দৃশ্যে তাই বসুন্ধরা হয়ে উঠেছেন মহীয়সী—যিনি টিনের তলোয়ারকে বিপ্লবের খোলা তলোয়ারে পরিণত করার অধীর আগ্রহে নাট্য মঞ্চের নাট্যকর্মীদের দিকে রয়েছেন তাকিয়ে। হয়ত সুদূর ভবিষ্যতে তাঁর স্বপ্ন সার্থক হবে।