সম্পন্ন ঘরের সন্তান প্রিয়নাথ। তার বাবা জমিদার, জাতিতে স্বর্ণবণিক হলেও তার বাবার লোহার ব্যবসা এবং কলকাতায় তাদের গদি আছে। তবে প্রিয়নাথ তার বাবাকে পছন্দ করে না। বাবা তার সামনেই উপ-পত্নীদের সঙ্গে যেভাবে নির্লজ্জের মতো আচরণ করে এবং তার মাকে মারে তা দেখে বাবাকে শ্রদ্ধা করা প্রিয়নাথের পক্ষে সম্ভব নয়। বাবার অর্থ ও সম্পদের ওপুর তার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। দারিদ্র্যকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়ে সে বাবার সংস্পর্শের বাইরে অবস্থান করে। প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি প্রিয়নাথের এই প্রতিবাদ স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। তার মানসিকতা মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি চরিত্রের সঙ্গে একান্তভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ।
ইংরাজি নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে প্রিয়নাথের এখন একটাই অভিলাষ—সে নাট্যকার হতে চায়। নাটক লেখার ব্যাপারে সে অত্যন্ত পরিশ্রমী। প্রভূত ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থ ঘেঁটে সে নাটক লেখে। ‘পলাশীর যুদ্ধ’ ও ‘তিতুমীর’ তার প্রমাণ। মাইকেল ও দীনবন্ধুর পরবর্তী নাট্যকার হিসেবে প্রিয়নাথ নিজের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলিই রচনা করতে চায়। তার নাট্যভাষা দীনবন্ধু-মাইকেল মধুসূদনের থেকে কিঞ্চিৎ ভিন্ন। প্রিয়নাথ ‘পলাশীর যুদ্ধ’ ও ‘তিতুমীর’ নাটকে ব্রিটিশ শাসকদের তীব্র কশাঘাত করেছে। প্রিয়নাথ নাটক শিখেছে হিন্দু কলেজের ক্যাপ্টেন পেভেল বেরির কাছে। প্রিয়নাথ ডিরোজিও’র ভাবনায় প্রভাবিত ও উদ্বুদ্ধ। সে নাস্তিক। উপনিবেশিক ব্রিটিশ বিরোধিতাই প্রিয়নাথের নাটকের মূল উপজীব্য।
গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় যখন প্রিয়নাথের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নাটকটির পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যায় তখন—প্রিয়নাথ হতাশার সুরে ভগ্ন হৃদয়ে বলে ওঠে—’আই অ্যাম রুইণ্ড’। হরনাথ মৃদুম্বরে তার বঙ্গানুবাদ করে–“আমি ধ্বংস প্রাপ্ত”। আপন সমাজ, কাঙ্ক্ষিত সমাজ, যে সমাজে সে মিশতে চায়, তার স্বপ্নের জীবন সব কিছু থেকেই প্রিয়নাথ বঞ্ছিত। কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও সময় পরিস্থিতির চাপে। কেন প্রিয়নাথের এই বিচ্ছিন্নতা, কেন প্রিয়নাথ ঊনিশ শতকের বাবু সমাজে একজন—’এনিমি’, পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়ার পর কেন প্রিয়নাথ ভাবে সে ‘রুইণ্ড’? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজলে প্রিয়নাথের চরিত্রের একটা স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।
প্রিয়নাথ ব্যবসায়ী জমিদার তো নয়। কিন্তু পিতার ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবন তাকে পীড়িত করে। বাবার উচ্ছৃঙ্খল জীবন, এবং ব্যক্তি হিসেবে অত্যাচারী, নারী বিদ্বেষী বাবাকে প্রিয়নাথ ঘৃণা করে। তাই সৃষ্টি উন্মুখ প্রিয়নাথ নাট্যসৃজনের মধ্যেই পারিবারিক কারণে জমে ওঠা নিজের বিক্ষোভকে প্রশমিত করতে চায়; কিন্তু সেখানেও তার আশা মেটে না। নাট্যসমাজের কাছেও সে অপাংক্তেয়। ইংরেজি নাট্যশিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং নাট্যচর্চায় একান্তভাবে নিষ্ঠ প্রিয়নাথ চেয়েছিল—নাট্য সমাজকে ‘রিফরমড’ করতে। কিন্তু তার স্বপ্ন সফল হয় না। আসলে কলকাতার বাবুসমাজের একজন বলে প্রিয়নাথকে প্রত্যাখ্যান করতে চায় থিয়েটারের লোকেরা, অথচ প্রিয়নাথ বাবু নয়।
ময়নাকে ভালোবেসে প্রিয়নাথ যখন তাকে কাছে পেতে চায়, তখন ময়নাও থিয়েটারের স্বার্থে, থিয়েটারের লাভের জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষ প্রিয়নাথকে ছেড়ে বীরেন্দ্রকৃষ্মের অঙ্কশায়িনী হতে চলে যায়। যুক্তিবাদী প্রিয়নাথ, প্রেমিক প্রিয়নাথ আত্মক্ষয়ের ছায়ার মধ্যে থেকে ময়নাকে বাধা দিলেও কোনো ফল হয় না। নাটক শেষে দেখা যায়, প্রিয়নাথ নাট্যকারের পোশাক ত্যাগ করে ঘোড়ার আস্তাবলে এসে কাজ নিয়েছে। অর্থাৎ প্রিয়নাথের কোনো আশাই পূর্ণ হয়। না। তবে প্রিয়নাথের প্রাপ্য প্রত্যাশা অপূর্ণতার জন্য নিজে দায়ী নয়। দায়ী তার সমাজ পরিবেশ, যার সঙ্গে প্রিয়নাথ কখনোই আপোস করতে পারেনি। তাই প্রিয়নাথের হতাশ মুখে ভাষা ফোটে—’আই অ্যাম রুইণ্ড’।
প্রিয়নাথ উনিশ শতকীয় ইংরেজ বণিকদের শোষণ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। ক্ষুধার্ত গ্রামবাসীদের ওপর পুলিশের লাঠি চালনা দেখে পুলিশ সার্জেন্টের উদ্দেশ্যে ক্রোধে প্রিয়নাথ বলে—“সাইলেনস! ইনসেনসেট! ক্যালাস!” প্রিয়নাথের এ রূপ ময়নার অচেনা লাগে। প্রিয়নাথ ইংরাজ বণিকের রক্তচোষা শাসনের স্বরূপ বুঝতে পেরেছে। তার উপলব্ধ জ্ঞান আমরাও বুঝতে পারি। এখন সে বলে—“অসহ্য ক্রোধে কখনও বা মনে হয় সব চুরমার করি। দেশ ছারখার।… কেন এই দুর্ভিক্ষ।” প্রিয়নাথের এ কথা শুনে মনে হয়, সময়ের থেকে কিছুটা এগিয়ে থেকে নাট্যকারের সাহায্যে সে বোধে-বুদ্ধিতে হয়ে ওঠে একজন সচেতন দেশপ্রেমী নাট্যকার। তাই তার লেখনীতে তিতুমীর গর্জে ওঠে—“যতদিন আমার দেশ পর-পদানত ততদিন কারোর বিশ্রাম নেই।” তাইতো তিতুমীর লড়াই করে চলে ইংরাজদের সঙ্গে বিরামবিহীন ভাবে। প্রিয়নাথেরও কাজ থেমে থাকে না, সে আস্তাবলে এসে কাজ নেয়।
সর্বোপরি, প্রিয়নাথের চরিত্রের মানবিক দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয়নাথ ময়নাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে শংকরীকে। কিন্তু ময়নাকে নিয়ে প্রিয়নাথ চৌধুরিবাবুদের মতো বজারায় চড়ে গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করতে চায় না। সে ময়নাকে বলে— “ময়না চল যাই, বেড়াতে যাই, রক্তমাংসের মানুষের মাঝে বেড়াতে যাই।” মঞ্চের কপট মায়াকাননে ময়না মজেছে। কিন্তু প্রিয়নাথ মঞ্চের মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেই ময়নাকে ভালোবেসেছে। ময়না তার কাছে শিল্পী, মানবী প্রেমিকা তার প্রাণের প্রাণ ময়নাকে হয়ত শারীরিক নৈকট্যে পায় না প্রিয়নাথ, তবে ময়নার মনে প্রিয়নাথের নিত্য আসা যাওয়া। তাইতো দর্শকাসনে বসেও ময়না প্রিয়নাথের লেখা ‘তিতুমীর’ নাটকের গানে কামিনীর সঙ্গে গলা মেলায়। শরীরে নয়, মনে প্রিয়নাথকে তার ভালোবাসার অধীশ্বর করে রেখেছে ময়না। আর এইখানেই প্রিয়নাথের জিত। তাই বোধ হয় প্রিয়নাথ ‘টিনের তলোয়ার’-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথে ভগীরথের কাজ করে।
Leave a comment