‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের কাহিনি সরলরৈখিক। অর্থাৎ জটিলতা মুক্ত। দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নাট্যশিক্ষক, নাট্যনির্দেশক, বেণীমাধব চট্টোপাধ্যায়ের ওরফে কাপ্তেনবাবু থিয়েটারের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ, কিন্তু তাঁর প্রাণের থিয়েটার ক্রমেই সমস্যা সঙ্কুল হয়ে ওঠে। সমস্যার নানা জালে বন্ধ হয় বেণীমাধব ও তাঁর থিয়েটার। বিভিন্ন জায়গায় দেনার দায়ে দল বাঁচানোর সমস্যা দেখা দেয়। থিয়েটারের স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দার মূর্খামি ও খামখেয়ালীর কারণে নাটক মঞ্চস্থ করার সমস্যা এবং সর্বোপরি সময়োপযোগী নাট্যনির্বাচন ও মঞ্চস্থ করবার সমস্যা। এইসব সমস্যার সমাধানের সূত্র নিয়ে বেণীমাধবের কাছে এসে উপস্থিত হয় সবজিওয়ালী ময়না, এবং বাবু প্রিয়নাথ মল্লিক। এইভাবে কাহিনি ধীরে ধীরে সুগ্রথিত হয়ে ক্রমেই পরিণতির দিকে ধাবিত হয়েছে।

এই সরল কাহিনির মধ্যে রয়েছে নাটকের চরিত্রগুলির বহুমাত্রিক মানসিক স্তরের নানাবিধ মাত্রা ৷ বেণীমাধবের চরিত্রের মানসিক গঠনে কখনও স্বার্থপরতা, কখনও উদ রতা, কখনও শিশু সুলভ চপলতা, কখনও তীক্ষ্ণ চতুরতা, কখনও নিয়ম নিষ্ঠ শিক্ষকতা কখনওবা মনোযোগী শ্রোতা প্রভৃতি বিশিষ্টতার মাত্রাগত তারতম্যের এক অসাধারণ সমাহার ঘটেছে। বসুন্ধরা কখনও স্বনাধন্যা মাতৃসমা ব্যক্তিত্ব, কখনও বা নাট্যনির্দেশকের একান্ত সহযোগী নাট্যবান্ধব, কখনও সমসাময়িক থিয়েটারের প্রতিবাদী নারী কর্মী হিসেবে প্রতিভাত। ময়নার অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে তার নাট্যপ্রেম এবং ব্যক্তিগত প্রেমের দ্বন্দ্বের টানা পোড়েনে এবং প্রায় বিংবদন্তী অভিনেত্রী নটী বিনোদিনীর মতো থিয়েটারের স্বার্থে নিজের অস্তিত্বকে বীরেন্দ্রকৃশ্বের কাছে বিকিয়ে দেওয়ায়। প্রিয়নাথ আপন বাবু সমাজের বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার স্পৃহায়, নাট্যাদর্শের প্রতি সুগভীর আগ্রহে, ময়নার প্রতি তীব্র প্রেমের ঘৃণাবর্তে শেষ অবধি সমাজ- বিচ্ছিন্ন এক চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে সরল নাট্যকাহিনির মধ্যেও কাহিনি-অন্তর্ভুক্ত চরিত্রগুলির এই বহুমাত্রিক মানসিক বিশিষ্টতা, ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের গঠন শৈলীকে এক অনন্যতা দান করেছে।

‘টিনের তলোয়ার’-এর গঠন নির্মিতির অনন্যতার আর একটা দিক হল—‘টিনের তলোয়ার’ আসলে থিয়েটার বা নাটকেরই গল্প। ‘টিনের তলোয়ার’-এ বার বার এক নাটকের মধ্যে থেকে অন্য এক নাটক উঠে এসেছে। বলা যেতে পারে নাটকের মধ্যে নাটক—’A play within a play’ টিনের তলোয়ার প্রসঙ্গে এ মন্তব্য যথাযথ বলেই বিবেচিত হয়। নাটকের মধ্য নাটক তৈরির অভিজ্ঞতা উৎপল দত্ত জীবন থেকে লাভ করেছেন। উৎপল দত্ত-র ছিল জিওফ্রে কেণ্ডালের ভ্রাম্যমান দলের সঙ্গে কাজ করা এবং শেকসপিয়রীয় থিয়েটারের অভিনয় ও প্রযোজনার অভিজ্ঞতা। তাঁর এই অভিজ্ঞতাকে উৎপল দত্ত কাজে লাগিয়েছেন টিনের তলোয়ার নাট্য গঠনের কাজে। হ্যামলেটের মতো ‘টিনের তলোয়ারে’র নাটক অভিনয় করতে করতে রঙ্গমঞ্চের মায়া ছিন্ন করে সমকালের বাস্তব জগতের দ্বন্দ্ব সমস্যাময় জীবনে ফিরে এসেছে মূল নাটকের পাত্র-পাত্রীরা, সাঙ্গ করেছে তাদের পার্থিব কর্তব্য। নাট্য বিষয়বস্তুর সঙ্গে নাট্য নির্মাণ ও নাট্যসৃজনের কাঠামোর এক নির্মাণ বিনির্মাণের খেলায় ‘টিনের তলোয়ার’-এর গঠনকৌশল-প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে অনন্য।

দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর খামখেয়ালির কারণে আপন অস্তিত্বের তথা থিয়েটারের অস্তিত্বের সমস্যা নিয়ে ময়না ও বসুন্ধরার কাছে নিজের দীনতা প্রকাশ হয়ে পড়লে বেণীমাধব নিজে অপমানিতবোধ করেন। ভগ্ন হৃদয় বেণীমাধব হঠাৎ নাটকে এবং থিয়েটারের অন্যান্য অভিনেতা এবং কর্মীদের সঙ্গে অভিনয় করতে করতে জীবনের সত্যকে আবিষ্কার করেন। ১৮৭৬ সালের প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধেই তাই গর্জে ওঠেন বেণীমাধব। দীনবন্ধু রচিত ‘সধবার একাদশী’ নাটকের নিমচাদের সংলাপ উচ্চারণ করতে করতে হঠাৎ প্রিয়নাথ মল্লিক রচিত ‘তিতুমীর’ নাটকের সংলাপ বলতে থাকেন—“যতক্ষণ এক ফিরিঙ্গি শয়তান দেশের পবিত্র বুকে পা রেইখে দাঁড়গে থাকবে, ততক্ষণ এই ওয়াহাবি তিতুমীরের তলোয়ার কোষবদ্ধ হবে না কখনো।” নাট্য সংলাপের এই পরিবর্তন শুধুমাত্র বেণীমাধবের চারিত্রিক পরিবর্তনকেই সূচিত করে না, সমগ্র নাটকের গঠন প্রক্রিয়ায় একধরনের গুণগত পরিবর্তনকেই চিহ্নিত করে। প্রায় এই সঙ্গে নাট্যকার নাট্য আঙ্গিক কাঠামোরও পরিবর্তন ঘটান । এইভাবে নাট্যভাষার হঠাৎ পরিবর্তন–নাট্য আঙ্গিকের চমক প্রভৃতির মধ্য দিয়ে উৎপল দত্ত টিনের তলোয়ার-এর গঠন পদ্ধতির ক্ষেত্রে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে।

বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীকে স্মরণ রেখে নাট্যকার উৎপল দত্ত ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকটি লিখেছেন। শুধু শতবার্ষিকীকে স্মরণ নয়, উৎপল দত্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দোসর সেইসব ঐতিহাসিকদের ইতিহাসবোধকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। ইতিহাস চর্চায় যাঁরা অভিনেতা অভিনেত্রীদের চটুল জীবনও বেপথু জীপন-যাত্রার কাহিনি বর্ণনাকেই একমাত্র বিবেচ্য মনে করেছেন তাঁরা যে বাংলা রঙ্গমঞ্চের গৌরবময় শতবর্ষের সংগ্রামী ঐতিহ্যের অমর্যাদা করেছেন তা বলাই বাহুল্য। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের মধ্য দিয়ে এই সব পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচয়িতাদের ইতিহাস বীক্ষার বিরুদ্ধে উৎপল দত্ত এক সামাজিক রাজনৈতিক দায়বদ্ধ ইতিহাস চর্চার গুরুভাব তুলে নিয়েছেন। ‘টিনের তলোয়ার’-এর গঠনপর্বে হয়ত স্ব-প্রণোদিতভাবেই অ্যারিস্টটলীয় ভাবনার ‘ডাইডেকটিভ’ পদ্ধতির ব্যবহার উৎপল দত্ত করেছেন। কিন্তু নাট্যপাঠে টিনের তলোয়ার-এর গঠন প্রক্রিয়াকে এক অনন্য পদ্ধতি বলেই মনে করা যেতে পারে।