প্রশ্নঃ (ক) উইনফিল্ডের মতে, আইনে নির্ধারিত কর্তব্যসমূহ লংঘন করলে টর্টের দায় সৃষ্টি হয়, এই কর্তব্য ব্যক্তি সাধারণের প্রতি এবং এই কর্তব্য লংঘন অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে প্রতিকারযোগ্য।—ব্যাখ্যা কর।
অথবা, উইনফিল্ডের মতে, “টর্টের দায়-দায়িত্ব যে কর্তব্য ভঙ্গের ফলে সৃষ্ট হয় তা প্রাথমিকভাবে আইন দ্বারা নির্ধারিতঃ এই কর্তব্য ব্যক্তি সাধারণের প্রতি এবং এর ভঙ্গ অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণের মামলার মাধ্যমে প্রতিকারযোগ্য”।—ব্যাখ্যা কর।
(খ) টর্ট ও ফৌজদারী অপরাধের মধ্যে পার্থক্য দেখাও ৷
(গ) এমন একটি অপরাধের উদাহরণ দিতে পার কি যা এক সাথে টর্ট, ফৌজদারী অপরাধ ও চুক্তিভঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে।
অথবা, তুমি স্থানীয় বাজারে গিয়ে কিছু মিষ্টান্ন ক্রয় করে একটি কুলির হাতে দিলে সেটা তোমার বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। পথিমধ্যে কুলিটি সমগ্র মিষ্টান্ন খেয়ে পালিয়ে গেল। এতে কি টর্ট বা চুক্তিভঙ্গ বা ফৌজদারী অপরাধ বা সকল অপরাধ সংঘটিত করলো?
উত্তরঃ (ক) সাম্প্রতিককালে উইনফিল্ড টর্টের যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা সর্বাপেক্ষা উন্নত মনে হয়। তিনি বলেন, যে কর্তব্য ভঙ্গের ফলে টর্টের দায়-দায়িত্ব সৃষ্টি হয় তা প্রাথমিকভাবে আইনের দ্বারা নির্ধারিত এবং এই কর্তব্য ব্যক্তি সাধারণের প্রতি, যার ফলশ্রুতি হিসেবে অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণের জন্য মামলার মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া যায়।
উইনফিল্ডের বিবেচনায় তিনটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলি হচ্ছেঃ
১। প্রাথমিকভাবে আইনের দ্বারা নির্ধারিত কর্তব্যঃ যে কর্তব্য ভংগের ফলে টর্টের জন্য দায়ী হতে হয় তা কোন প্রকার পারস্পরিক সম্মতির দ্বারা সৃষ্টি হয় না। অতএব সম্মতির দ্বারা এর পরিসমাপ্তিও ঘটে না। তাই ‘ক’ কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানহানিকর উক্তি করতে পারে না কারণ আইন তাকে নিষেধ করেছে—সে কোন ব্যক্তি বিশেষের সাথে এই মর্মে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ নয় যে তার বিরুদ্ধে মানহানিকর উক্তি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। চুক্তিভূত দায়-দায়িত্ব ও টর্টের দায়-দায়িত্বের মধ্যে এখানেই মৌলিক পার্থক্য।
২। ব্যাক্তি সাধারণের প্রতি কর্তব্যঃ টর্ট আইনের কর্তব্য কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি নয়— ব্যক্তি সাধারণের প্রতি। চুক্তি আইনে কর্তব্য হচ্ছে চুক্তিভুক্ত পক্ষগণের প্রতি। কিন্তু টর্ট আইনে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির প্রতি এরূপ কর্তব্য সীমাবদ্ধ নয়। যদিও ব্যক্তি সাধারণের প্রকৃত ব্যাখ্যা সম্ভবপর নয় তবুও এ উপাদানটি টর্টের সংজ্ঞায় সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।
৩। অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণের জন্য মামলার মাধ্যমে প্রতিকার যোগ্যঃ অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণ হচ্ছে টর্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য। চুক্তি ভঙ্গের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পক্ষগণ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে যা কোন ক্রমেই বর্ধিত করা যায় না যদিও ক্ষেত্র বিশেষে আদালত এর পরিমাণ কমাতে পারে। কিন্তু টর্টের ক্ষেত্রে বাদী ইচ্ছামত ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারে এবং আদালত প্রয়োজন মত বৃদ্ধি বা হ্রাস করতে পারে। এটা অবশ্য স্মরণ রাখতে হবে যে, অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণই টর্টের একমাত্র প্রতিকার নয়। ক্ষতিপূরণ ছাড়াও নিষেধাজ্ঞা, অপসারণ ইত্যাদি প্রতিকার আছে কিন্তু অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণই মূখ্য।
উত্তরঃ (খ) টর্ট ও ফৌজদারী অপরাধের মধ্যে পার্থক্য (Distinction between tort and crime): টর্ট ও ফৌজদারী অপরাধ উভয়ই আইনের দৃষ্টিতে অন্যায় ও প্রতিকারযোগ্য। পুরাকালে এদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো না কিন্তু অধুনা অন্যায়ের প্রকৃতি, মাত্রা, মামলার পদ্ধতি ও প্রতিকার এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নির্দেশ করে। এগুলি নিম্নরূপঃ
(১) টর্ট হচ্ছে দেওয়ানী প্রকৃতির ব্যক্তিগত অপকার যা শুধু ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ফৌজদারী অপরাধ সামাজিক ও ক্ষতিকর অন্যায় এবং এর প্রভাব সমগ্র সমাজের উপর বিস্তার করে।
(২) টর্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় ৷ ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষতি হলেও এতে সামাজিক শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট করে এবং রাষ্ট্র তথা জনগণের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে।
(৩) টর্টের ক্ষেত্রে কেবল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই মামলা করতে পারে ৷ পক্ষান্তরে, ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে রাষ্ট্রের নামে মামলার উদ্ভব হয়ে থাকে, যদিও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ অভিযোগ আনতে পারে।
(৪) টর্টের প্রতিকার পাওয়া যায় দেওয়ানী আদালতে । অপরদিকে ফৌজদারী অপরাধের প্রতিকার পাওয়া যায় ফৌজদারী আদালতে।
(৫) টর্টের মামলা দেওয়ানী মামলা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ফৌজদার অপরাধের মামলা ফৌজদারী মামলা হিসেবে পরিচিত।
(৬) টর্টের ক্ষেত্রে মামলা আনয়নকারী পক্ষকে বলা হয় বাদী (plaintiff) এবং বিরুদ্ধ পক্ষকে বলা হয় বিবাদী বা প্রতিবাদী ( defendant)। ফৌজদারী মামলা আনয়নকারী পক্ষ ফরিয়াদী বা অভিযোগকারী (complainant) এবং বিরুদ্ধ পক্ষ আসামী (accused) হিসেবে পরিচিত।
(৭) টর্টের ক্ষেত্রে বাদীকে প্রমাণ করতে হয় যে, বিবাদী তার আইনগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। পক্ষান্তরে, ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে প্রমাণ করতে হয় যে আসামী তার উপর দণ্ডনীয় অপরাধ করেছে।
(৮) টর্টের প্রতিকার পাওয়া যায় সাধারণতঃ আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে। অপরদিকে, ফৌজদারী অপরাধের জন্য দণ্ডবিধির বিধান মতে অপরাধীর শাস্তি দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ কোন প্রতিকার পায় না।
(৯) টর্টের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও প্রয়োজন বোধে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা হয় কিংবা প্রতিরোধ বা বাধা -নিষেধের সুযোগও দেয়া হয়। পক্ষান্তরে, ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শাস্তি দেয়া হয়, যেমন বেত্রদণ্ড, কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড, যদিও আর্থিক জরিমানাও একটি শাস্তি হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে।
১০। টর্টের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপকর্মকারী দায়ী (liable) হিসেবে চিহ্নিত হয়। ফৌজদারী অপরাধ প্রমাণিত হলে অপকর্মকারী অপরাধী বা দোষী ( accused ) হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
(১১) টর্টের অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিকে সাধারণতঃ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। কিন্তু ফৌজদারী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়।
(১২) টর্টের আওতাভুক্ত অপকর্মগুলি মীমাংসাযোগ্য বিধায় বাদী বিবাদীর মধ্যে সমঝোতা হলে টর্টের মামলা প্রত্যাহার করা যায়। দণ্ডবিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে কোণ ফৌজদারী অপরাধগুলি মীমাংসাযোগ্য ও কোণগুলি নয়। সাধারণতঃ গুরুতর অপরাধগুলি মীমাংসাযোগ্য নয় এবং সামাজিক শৃংখলার স্বার্থেই এ সকল মামলা প্রত্যাহারযোগ্য নয়।
(১৩) তামাদি আইনের প্রয়োগ দ্বারা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ টর্টের প্রতিকার হতে বঞ্চিত হয়। কিন্তু ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে তামাদি আইনের প্রয়োগ চলে ন।
কোন কোন ক্ষেত্রে একই কার্য, টর্ট ও ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে – যেমন, আক্রমণ (assault), আঘাত (battery), মানহানি (defamation), অনধিকার হস্তক্ষেপ (trespass), বিদ্বেষপ্রসূত মামলা (malicious prosecution) ও কৃত্রিম বন্দী (false imprisonment)। এ সকল ক্ষেত্রে দেওয়ানী অথবা ফৌজদারী অথবা উভয় আদালতে একই সাথে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।
কোন কোন কার্য শুধু ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়— যেমন, গণ উৎপাত (public nuisance)। এ ক্ষেত্রে বাদীর বিশেষ ক্ষতি না হলে টর্টের মামলা করা যায় না।
পক্ষান্তরে, কোন কোন কার্য শুধু টর্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে, ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে নয়—যেমন, অনিবার্য ভুলক্রমে অন্যের অঙ্গনে প্রবেশ করা (Trespass to land by inevitable mistake)।
সাধারণতঃ ফৌজদারী অপরাধের বিষয়গুলি টর্টের ক্ষেত্রে বিচার্য নয়, তবে টর্টের জন্য দায়ী হলে তা ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
উত্তরঃ (গ) কোন ব্যক্তি এক কুলির মাথায় একটি পুটুলি দিয়ে তার বাড়িতে পৌছানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু কুলি যদি সে দ্রব্যগুলি গন্তব্য স্থলে না পৌঁছায়ে আত্মসাত করে তবে কুলিটি তিন ধরণের দায়ের সম্মুখীন হবে।
প্রথমতঃ চুক্তিমত পুটুলিটি বাড়িতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হবার জন্য চুক্তিভঙ্গ হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ এরূপ অসৎভাবে আত্মসাৎ করায় দণ্ডবিধি অনুযায়ী ফৌজদারী অপরাধ করেছে।
তৃতীয়তঃ অন্যের দ্রব্য আত্মসাৎ করায় টর্ট আইনে রূপান্তর (conversion) সংঘটিত হয়েছে।
Leave a comment