উত্তরঃ টর্ট হচ্ছে একটি দেওয়ানী প্রকৃতির অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তি যা মানুষের আইনগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করে এবং অনির্ধারিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ হচ্ছে মূখ্য প্রতিকার। অতএব টর্ট সংঘটনের জন্য আবশ্যকীয় উপাদানগুলি নিম্নরূপঃ
(১) অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তি
(২) ‘মেনস রিয়া’ (Mens rea) বা মানসিক সায়,
(৩) আইনগত ক্ষতি,
(৪) প্রত্যক্ষ ফল, ও
(৫) বৈধ সমাধান।
(১) অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তি (Wrongful act or Omission): টর্ট হচ্ছে আইনে সমর্থন করে না এরূপ কাজ বা নিবৃত্তি। কথায় বা কাজে কারো ক্ষতি না করাই হচ্ছে টর্টের মূল নীতি। অতএব যে কার্যের দ্বারা অন্যের ক্ষতি সাধিত হয় সেটা অন্যায় বা আইনে সমর্থনযোগ্য নয়। যেখানে কোন কাজ করা কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে, সেখানে সে কাজ করা হতে বিরত থেকে কারো ক্ষতি করাও অন্যায়। এরূপ অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তি দেওয়ানী প্রকৃতির হতে হবে অর্থাৎ শাস্তিযোগ্য বা দণ্ডনীয় অপরাধ টর্টের পর্যায়ে পড়ে না। এ ছাড়াও এরূপ দেওয়ানী প্রকৃতির অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তি অন্যান্য দেওয়ানী প্রকৃতির অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তি; যেমন— চুক্তিভঙ্গ, ট্রাস্টভঙ্গ ইত্যাদি হতে স্বতন্ত্র হতে হবে। এক ব্যক্তির অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তির জন্য অন্য ব্যক্তিও দায়ী হতে পারে যদি উভয় ব্যক্তির মধ্যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, যেমন মনিব কর্মচারী। একে পরার্থ দায় বলে।
(২) মেনরিয়া (Mensrea) বা মানসিক সায়ঃ মানসিক সায় হচ্ছে টর্টের জন্যে দ্বিতীয় উপাদান। কাজটি শুধু অন্যায় হলেই টর্টের জন্য দায়ী করা যায় না- ইচ্ছাকৃতভাবে বা অসতর্কতার জন্য সংঘটিত হয়েছে কিনা তাও বিবেচ্য বিষয়। তাই যেরূপ দুর্ঘটনা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় অর্থাৎ অনিবার্য দুর্ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। কিন্তু কোন কাজের গুরুত্ব বোঝার অক্ষমতার ফলে কারো ক্ষতি হলে এরূপ অক্ষমতার জন্য অব্যাহতি দেয়া যায় না, কেননা প্রত্যেক ব্যক্তিই তার কার্যের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে জ্ঞাত বলে ধরা হয় ৷ Actus non facit reum risi ment sit rea— এই প্রবাদটির অর্থ হচ্ছে— দোষযুক্ত মনের অবর্তমানে শুধু কাজের জন্য দোষ দেয়া যায় না। ক্রাইম বা দণ্ডনীয় ‘অপরাধের ক্ষেত্রে মেন্সরিয়া বা দোষমুক্ত মন যে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয় টর্টের ক্ষেত্রে সেরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয় না। যথার্থ কারণ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে বা অসতর্কতার জন্য কাজটি সংঘটিত হয়েছে অর্থাৎ বিবাদীর মানসিক সায় ছিল তা প্রমাণ করতে হবে।
(ক) অভিপ্ৰায় (Intention): অভিপ্রায় বলতে একট বিশেষ ফল কামনা করা হয়েছিল বোঝায়। ইচ্ছাকৃত অন্যায় কাজের জন্য দায় অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু অনিচ্ছাকৃত কাজের জন্যও দায়-দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাওয়া যায় না। কেউ যদি অপরের একটি কুকুরকে ভয় দেখানোর জন্য বন্দুক দেখায় এবং কোনক্রমে একটা গুলি ছুটে গিয়ে তাকে আঘাত করে তবে সে দায়ী হবে, যদিও কুকুরটিকে আঘাত করার অভিপ্রায় তার ছিল না।
(খ) অসতর্কতা (Negligence): টর্ট আইনে অসতর্কতা দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্ৰথম অর্থে-ইহা এক প্রকার মানসিক অবস্থা এবং দ্বিতীয় অর্থে ইহা আচরণ, যা একটা সুনির্দিষ্ট টর্ট। মানসিক অবস্থা হচ্ছে কার্যের প্রতি বা এর পরিণতির প্রতি বিবাদীর ঔদাসীন্য। অভিপ্রায়ের সহিত অসতর্কতার পার্থক্য হচ্ছে এই যে প্রথম ক্ষেত্রে কার্যের পরিণতি বিবাদীর কাম্য কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা কাম্য নয় যদিও এর প্রতি বিবাদী উদাসীন ছিল। যথাযথ জ্ঞান বা দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা অসতর্কতার সামিল। যদিও অসতর্কতা একটা মানসিক অবস্থা তবুও বিবাদীর মনের সাথে এর যথার্থ কোন সম্পর্ক নেই। প্রকৃত আচরণ দ্বারা তা নিরূপিত হয়। বিবাদী যদি যথাযথ সাবধানতার সাথে কাজ না করে এবং এর ফলে কারো ক্ষতি সাধিত হয় তবে সে অসতর্কতার জন্য দায়ী। অবশ্য ‘যথাযথ’ শব্দটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন, কেননা তা ঘটনার উপর নির্ভরশীল।
(গ) মনোভাব ও বিদ্বেষ (Motive and malice): ‘মোটিভ’ বা মনোভাব হচ্ছে কোন কার্য সম্পাদনের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং বিদ্বেষ বলতে হিংসা বা ক্ষতি করার ইচ্ছাকে বুঝায়। ‘মনোভাব’ শব্দটি ‘বিদ্বেষ’ শব্দের সাথে ক্রমান্বয়ে জড়িত হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ অর্থে অসৎ মনোভাবকেই বিদ্বেষ বলা হয়।
আইনের দৃষ্টিতে বিদ্বেষ দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়—
প্রথমতঃ একটা অন্যায় কাজ যথার্থ কারণ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে করা।
দ্বিতীয়তঃ এমন উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা যা আইনে সমর্থনীয় নয়। বিদ্বেষ দুই রকমের হতে পারে— বাস্তবে বিদ্বেষ (malice-in-fact) এবং আইনে বিদ্বেষ (malice-in-law)। বাস্তবে বিদ্বেষকে প্রকাশ্য বা প্রকৃত বিদ্বেষ বলে’ এবং আইনে বিদ্বেষকে সুপ্ত বিদ্বেষ বলে। যথার্থ কারণ ছাড়া কোন অন্যায় কাজ করাই হচ্ছে আইনে বিদ্বেষ। আইনে বিদ্বেষ সর্বদা প্রতিকারযোগ্য কিন্তু কতিপয় ক্ষেত্র ছাড়া প্রকৃত বিদ্বেষ প্রতিকারযোগ্য নয়। কেননা খারাপ মোটিভের জন্য একটা বিধিসম্মত কাজ অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। পক্ষান্তরে, একটা অন্যায় কাজ করলে ভাল ‘মোটিভ’ দিয়ে রেহাই পাওয়া যায় না৷
(৩) আইনগত ক্ষতি (legal damage): টর্টের জন্য তৃতীয় উপাদান হচ্ছে বাদীর ক্ষতি। অবশ্য এই ক্ষতি আইনের দৃষ্টিতে ক্ষতি হতে হবে। কারো আইনগত অধিকারে অযথা হস্তক্ষেপ করলে তার আইনগত ক্ষতি হয় এবং যে অধিকার বা স্বার্থ আইন দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত তাকেই আইনগত অধিকার বলে। এই উপাদানটি প্রচলিত দু’টি ম্যাক্সিম দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এগুলি হচ্ছে, (ক) Damnum sine injuria is not actionable, এবং (খ) Injuria sine damno is actionable. অর্থাৎ আইনগত ক্ষতি ব্যতীত প্রকৃত ক্ষতি প্রতিকারযোগ্য -নয় এবং প্রকৃত ক্ষতি ব্যতীত আইনগত ক্ষতি প্রতিকারযোগ্য৷
(ক) ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া অর্থাৎ আইনগত ক্ষতি ব্যতীত প্রকৃত ক্ষতিঃ ১৪১০ সালে ইংল্যাণ্ডে বিখ্যাত গ্লসেষ্টার গ্রামার স্কুল মামলায় একটি নীতি প্রতিষ্ঠিত হয় যে, যেক্ষেত্রে বাদীর প্রকৃত ক্ষতি সাধন করা হয়, কিন্তু আইনগত ক্ষতি সাধিত হয় নাই অর্থাৎ তার বৈধ অধিকারে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করা হয় নাই সেক্ষেত্রে তা প্রতিকারযোগ্য অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয় না। এই নীতিটি পরবর্তীকালে অনেক মামলায় প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এখনো চালু আছে। উক্ত মামলার ঘটনায় প্রকাশ, এক স্কুল শিক্ষক প্রতিন্দ্বী গ্রামার স্কুলের সম্মুখে আর একটি স্কুল স্থাপন করেন এবং কম বেতনে ছাত্র ভর্তি করেন। ফলে বাদীর স্কুল হতে ছাত্ররা বিবাদীর স্কুলে চলে যেতে থাকে। এতে বাদীর স্কুলে ছাত্র সংখ্যা কমে যায় এবং যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হয়। কিন্তু বিবাদী আইনসম্মতভাবে একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য তার বৈধ অধিকার প্রয়োগ করেছে বিধায় তার বিরুদ্ধে মামলাটি টিকে নাই।
(খ) ইনজুরিয়া সাইন ড্যামনো অর্থাৎ প্রকৃত ক্ষতি ব্যতীত আইনগত ক্ষতিঃ ১৭০৩ সালে আ্যসভি বনাম হোয়াইট মামলায় বিপরীত ধর্মী একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিটি অপকার বা অন্যায় কাজ আইনগত ক্ষতির কারণ ঘটায় যদিও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের এক কপর্দকও খরচ না হয়ে থাকে। উক্ত মামলার বিবাদী ছিলেন একজন রিটার্নিং অফিসার। বাদীর ভোট দানের বৈধ অধিকার তিনি অস্বীকার করেছিলেন। বাদী যার স্বপক্ষে ভোট দিতে গিয়েছিলেন তিনি বাদীর ভোট ছাড়াই জয়লাভ করেছিলেন। অতএব এই ভোট অস্বীকার করার ফলে কোন প্রকৃত ক্ষতি হয় নাই। কিন্তু আদালতের রায় বাদীর অনুকূলে ছিল । যেহেতু তার আইনগত অধিকার যথার্থ কারণ ছাড়া ক্ষুণ্ণ করা হয়েছিল।
উপরোক্ত দুই নীতি প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই উপাদানটির ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা নিম্নরূপঃ
(i) যে ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু আইনগত ক্ষতি হয় নাই সেক্ষেত্রে টর্ট সংঘটিত হয় নাই।
(ii) যে ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতি হয় নাই কিন্তু আইনগত ক্ষতি হয়েছে সে ক্ষেত্রে টর্ট সংঘটিত হয়েছে।
(iii) যে ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতি হয়েছে এবং আইনগত ক্ষতিও হয়েছে সেক্ষেত্রে টর্ট সংঘটিত হয়েছে।
(iv) যে ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতি হয় নাই এবং আইনগত ক্ষতিও হয় নাই সেক্ষেত্রে টর্ট সংঘটিত হয় নাই।
(৪) প্রত্যক্ষ ফল (Direct consequences): টর্টের চতুর্থ উপাদান হচ্ছে এই যে, বাদীর আইনগত ক্ষতিটি হতে হবে বিবাদীর কার্যের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে, অতি দূরবর্তী ফল নয়। (It is not too remote consequence of the defendant’s conduct.)। একটি কার্যের পরিণতি বা ফলাফল অসীম কিন্তু যে পরিণতির জন্য বিবাদীর কর্ম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, সে পরিণতির জন্য বিবাদী দায়ী। অতি দূরবর্তী বা পরোক্ষ ক্ষতি সম্পর্কে দু’টি পরস্পর বিরোধী মতামত প্রচলিত আছে। একটি হচ্ছে- ওয়াগন মাউণ্ড নীতি এবং অপরটি হচ্ছে রিপলেমিস নীতি। প্রথম নীতি অনুযায়ী যে পরিণতি একজন স্বাভাবিক বিবেকসম্পন্ন ও যুক্তিযুক্ত মানুষ পূর্বে অনুমান করতে পারে না, তা অতি দূরবর্তী প্রত্যক্ষ ফল নয় । অপর নীতি অনুযায়ী কোন এক ক্ষতি যদি একজন স্বাভাবিক বিবেকসম্পন্ন ও যুক্তিযুক্ত মানুষ কর্তৃক অনুমিত হয়ে থাকে তবে ঐ ক্ষতির প্রত্যক্ষ পরিণতির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দায়ী যদিও একজন যুক্তিযুক্ত বিবেক সম্পন্ন মানুষ উক্ত পরিণতি অনুমান করতে পারে না।
এই নীতিগুলি বিভিন্ন মামলায় প্রয়োগ করা হয়েছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নিম্নলিখিত পরিণতি বিবাদীর কার্যের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বিবেচিত হয়েছেঃ
(ক) অভিপ্রেত পরিণতি (Intended consequences): কোন বিশেষ পরিণতির অভিপ্রায়ে বিবাদী যদি কোন অন্যায় কার্য করে তবে সে পরিণতি হবে বিবাদীর কার্যের প্রত্যক্ষ ফল। যেমন, মানুষের সংবেদনশীল অঙ্গে আঘাত করলে মানুষের মৃত্যু হয় জেনেও যদি বিবাদী ইচ্ছাকৃতভাবে সে সকল স্থানে আঘাত করে তবে মৃত্যু তার আঘাতের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে গণ্য হবে।
(খ) বিবাদীর কার্যের স্বাভাবিক এবং সম্ভাব্য পরিণতি হচ্ছে এর প্রত্যক্ষ ফল। বিবাদী কাঁটাযুক্ত তারের বেড়া সড়কে রেখেছিল। একজন পথচারী সে পথে যাবার সময় ওটা সরায়ে ফুটপাথে রেখে দেয়৷ অন্ধকার রাতে সে পথ দিয়ে চলার সময় বাদী সেই তারের জন্য আহত হয়। এ পরিণতি বিবাদীর কার্যের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে গণ্য করা হয়।
(গ) স্বাভাবিক ও সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে অনুধাবন করতে না পারলেও যদি তা বিবাদীর কার্যের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংযোজিত এবং কোন স্বাধীন তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ হয় নাই এরূপ ক্ষেত্রে ক্ষতি প্রত্যক্ষ ফল।
(৫) বৈধ সমাধান (legal remedy): Alterum non laedere’ অর্থাৎ কথায় বা কাজে কারো ক্ষতি না করা-আইন দ্বারা নির্ধারিত এ কর্তব্য ভঙ্গ করলে আইনতঃ দায়ী হতে হয়। এরূপ অন্যায় কাজের জন্য অবশ্য বৈধ সমাধান থাকতে হবে কেননা ubi jus ibi remedium অর্থাৎ কোন অন্যায়ই প্রতিকার বিহীন নয়। আর্থিক ক্ষতিপূরণেই এই অন্যায়ের মুখ্য প্রতিকার। তাই বাদীর ক্ষতি অনিরূপিত বা অনির্ধারিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দ্বারা প্রতিকারযোগ্য হতে হবে।
Leave a comment