প্রশ্নঃ টমাস হব্সকে কেন একজন সর্বাত্মকবাদী দার্শনিক বলা হয়? বর্ণনা কর।
অথবা, টমাস হবস একই সাথে কর্তৃত্ববাদী ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী। তুমি কী এ উক্তির সাথে একমত? যুক্তি দাও।
ভূমিকাঃ বৃটেনের যে সকল দার্শনিক তাদের উন্নত চিন্তাধারার সোনালী ফসলে চিন্তা ক্ষেত্রের গোলা ভরেছেন তাদের মধ্যে টমাস হবস্ এক অনন্য প্রতিভা। তার মত সূক্ষ্মজ্ঞান, যুক্তিপূর্ণ বিচার বুদ্ধি ও বাস্তব চিন্তা ধারা অতি অল্পসংখ্যক চিন্তানায়কের মধ্যেই মেলে। ষোড়শ শতাব্দীতে তার ক্ষুরধার চিন্তাধারা চিন্তার ক্ষেত্রে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে যা রাজনৈতিক চিন্তাধারার কর্মবিকাশের পথ প্রশস্ত করে।
সর্বাত্মবাদঃ সর্বাত্মকবাদ হলো এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে মানুষের জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয়, কৃষ্টিগত, শিল্প-বাণিজ্য, আত্মিক ও বৈষয়িক সবকিছুই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। অর্থাৎ সর্বাত্মকবাদ বলতে বোঝায় এমন এক শাসনব্যবস্থা-
(১) যেখানে আইনের ভূমিকা নেই অর্থাৎ আইনের শাসন নেই।
(২) শাসকগণ তার কর্ম-অপকর্মের জন্য কারো নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।
(৩) সর্বাত্মকবাদে সমস্ত শাসনক্ষমতা এমন একাধিক ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে, যেখানে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হয়।
(৪) শাসন পরিচালনায় যেখানে জনগণের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
টমাস হবস সর্বাত্মকবাদী ছিলেন কিনাঃ টমাস হবস সর্বাত্মকবাদী ছিলেন কি না সে বিষয়ে কোন বক্তব্য পরিবেশন প্রয়োজন হলে সবার আগে তার মত, পথ ও অবদান সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। অতঃপর সর্বাত্মকবাদের মানদন্ডে তাকে যাচাই করে মন্তব্য করা বাঞ্চনীয়। টমাস হবসকে আমরা একজন সমাজ বিজ্ঞানী হিসাবে অবহিত করতে পারি। কেননা তিনি সামাজিক জীব মানুষকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে তার প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য ও সুখ শান্তির বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছেন।
(১) কার্যকারণ সম্পর্কের নিয়মাধীনঃ তিনি মানুষকে একটি জড় পদার্থ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক জড়বস্তুর ন্যায় কার্যকারণ সম্পর্কে রীতির নিয়মাধীন বলে আখ্যায়িত করেন। মানুষের কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। মানুষ বিমূর্ত প্রতীক। তার সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুসারে, মানুষ চুক্তির মাধ্যমে তাদের সমস্ত ক্ষমতা সার্বভৌমের হাতে ন্যস্ত করে বলে সার্বভৌমের ইচ্ছাই জনগণের ইচ্ছা। সুতরাং সার্বভৌম অন্যায় করলেও মানুষকে জড় পদার্থের মত তা সহ্য করতে হবে। এটা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(২) আবেগ অনুভূতি প্রভৃতি সহজাত প্রবৃত্তিঃ মানুষের একদিকে যেমন রয়েছে আবেগ, অনুভূতি, আকর্ষণ-আশা আকাঙ্খা এবং অপরদিকে রয়েছে ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, বেদনা ও যন্ত্রণা এগুলি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষের আবেগ সম্পর্কিত যে মতবাদটি ছিল অন্যান্যদের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি এই বিষয়কে অত্যন্ত সূক্ষভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
(৪) মানুষের মধ্যে সমতাঃ হবসের মতে, মানুষ এই অর্থে পরস্পর সমান যে, কারো হয়তো দৈহিক বল কম আছে, কিন্তু তার মনের বল বেশী, আবার কেউ হয়তো মনের দিক দিয়ে দুর্বল কিন্তু দৈহিক শক্তিতে সবল। সুতরাং দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতার কথা সার্বিকভাবে বিচার করলে যথার্থই মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো অসমতা থাকে না।
(৫) রাষ্ট্রই সর্বেসর্বাঃ সর্বাত্মকবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল- সবকিছুই রাষ্ট্রের জন্য, কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় এবং কোনোকিছুই রাষ্ট্রের বাইরে নয়। হবস্ রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নির্দেশ করেননি। সর্বাত্মকবাদের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যটি তার সরকারে সম্পূর্ণভাবে বিদ্যমান। কাজেই হবসকে সর্বাত্মকবাদী বলা ভুল হবে না।
(৬) শাসক আইনের উর্ধ্বেঃ হবসের মতে, সার্বভৌম শাসক যেমন ইচ্ছা তেমনি আদেশ প্রদানের মাধ্যমে আইন সৃষ্টি ও বাতিল করতে পারেন। সার্বভৌমের আদেশই আইন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তিনি সবদিক দিয়েই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশক্তিমান। কোনো নিয়মনীতি বা আইন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এমন অসীম অসাধারণ, অকৃত্রিম ও অবিসংবাদিত শাসকের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে হসকে যথার্থই একজন সর্বাত্মকবাদী বলা চলে ।
(৭) শাসক সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্তঃ হবসের মতে, শাসক সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত এবং চরম ক্ষমতাসম্পন্ন, কোন আইনই তার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না। বডিন যখন সার্বভৌমিকতাকে প্রাকৃতিক আইন, ঐশ্বরিক আইন ও রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ করেছেন, হবস তখন তাকে সর্বপ্রকারের বন্ধনমুক্ত করতে চেয়েছেন।
(৮) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদের প্রবক্তাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা রাজার হাতে ন্যস্ত করে তাকে সর্বশক্তিমান করাই ছিল হবসের উদ্দেশ্য। তাই তাকে সার্বভৌমিকতার একত্ববাদের গোড়া সমর্থক বলা হয়। তার মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা অবিভাজ্য ও চূড়ান্ত। তিনি যেহেতু শাসকের একচ্ছত্র ও নিরংকুশ ক্ষমতার পক্ষপাতী ছিলেন, তাই তাকে সর্বাত্মকবাদী বলা হয়।
(৯) সংখ্যালঘুর দমনঃ সার্বভৌম শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত ও সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করা হয় না। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যদি মৌন সম্মতির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্পাদিত চুক্তির শর্ত মেনে নেয়, তাহলে তারা শাসকের বিরোধিতা করতে পারে না। আর যদি তারা ঘোষণা করে যে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের চুক্তি মানে না, তাহলে তাদের নির্মূল করার ক্ষমতা শাসকের রয়েছে।
(১০) রাষ্ট্র ও শাসকের অভিন্ন মতামতঃ হবস রাষ্ট্র ও শাসককে অভিন্ন বলে অভিমত দিয়েছেন। হবস রাষ্ট্রের শাসককে চরম ক্ষমতা দিয়েছেন। হবসের মতে, সার্বভৌম শাসকের সমকক্ষ কেউ নেই। ফলে নাগরিকরা শাসকের সমালোচনা করতে পারে না। কারণ তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ভুক্ত হবে যা শাসককে স্বৈরাচারী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
(১১) আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চরম ক্ষমতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা একদিকে যেমন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যেকোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে। অপরদিকে তেমনি আইন সম্পর্কিত যেকোনো অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিবেচনায় তা মীমাংসার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। অর্থাৎ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চূড়ান্ত দক্ষতা হস ন্যস্ত করেছেন সার্বভৌমের হাতেই।
সমালোচনাঃ এ কারণেই অনেকেই তাকে সবাত্মকবাদী বলে আখ্যায়িত করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষ্যে সর্বাত্মকবাদ বলতে যা বুঝিয়ে থাকে সে অর্থে হবস্কেসবাত্মকবাদী বলা চলেনা। কারণঃ
(১) সর্বাত্মকবাদী স্বৈরতন্ত্রীঃ সাম্প্রতিককালে উদার পন্থীগণের অনেকেই হবসকে আধুনিক সর্বাত্মকবাদী স্বৈরতন্ত্রের অর্থাৎ সাম্যবাদ, নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদের আধ্যাত্মিক গুরু বলে অভিহিত করেছেন।
(২) আধুনিকতার বিরোধীঃ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও সুখবাদ হবসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের দু’টি আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু আধুনিক সর্বাত্মকবাদ সম্পূর্ণভাবে এগুলির বিরোধী।
(৩) দ্বিমতঃ হবসের সার্বভৌম ক্ষমতা একজনের হাতে ও ন্যন্ত হতে পারে আবার একটি পরিষদের হাতেও নাস্ত হতে পারে। কিন্তু একনায়কের নেতৃত্ব হচ্ছে সর্বাত্মকবাদী নাৎসীবাদ ও ফ্যাসীবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
পরিশেষঃ উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা হবসকে একজন স্বৈরাচারী শাসকের উকিল হিসাবে অভিহিত করতে পারি। কিন্তু তাকে পুরাপুরি একজন সার্বত্মকবাদী বলতে পারি না। তিনি বিশৃংখলাময় পরিবেশ থেকে মানব জাতিকে একটি সুশৃংখল পরিবেশ আনয়নের লক্ষ্যে তার সামাজিক চুক্তি মতবাদ গ্রহণ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মানবিকতার পরিপন্থী হলেও তিনি মানবতার কল্যাণেই কাজ করেছেন। এইজন্য তাকে নীতিহীন না বলে নীতি নিরপেক্ষ বলাই শ্রেয়।
Leave a comment