অথবা, টমাস হবস কীভাবে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ ব্যাখ্যা করেছেন তা আলোচনা কর।

অথবা, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ সম্পর্কে টমাস হবসের ধারণা বিশ্লেষণ কর।


ভূমিকাঃ টমাস হব্‌স ছিলেন সমগ্র পাশ্চাত্যে তীক্ষ্ণ ধীশক্তি সম্পন্ন একজন চিন্তাবিদ। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তিনি ১৫৮৮ সালে উইল্টসায়রের অন্তর্গত মেসবেরী নামক স্থানে এক যাজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার সম্পর্কে অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, ‘সপ্তদশ শতাব্দীতে তার ক্ষুরধার যুক্তিধারা চিন্তার ক্ষেত্রে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু তার শ্রেষ্ঠত্বের মূলে ছিল তার বিশ্লেষণ পদ্ধতি যা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ (Scientific materialism) নামে পরিচিত।

বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদঃ বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্ব টমাস হবসের রাষ্ট্রনৈতিক দর্শনের একটি বিশেষ দিক। হবসের পূর্বে কোন দার্শনিক তাদের মতবাদকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেননি। টমাস হবস জ্যামিতিক ও গাণিতিক পদ্ধতির ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক তত্ত্বকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন; তা-ই বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্ব নামে খ্যাত।

মৌলিক দিকসমূহঃ টমাস হবস বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্বের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। হবসের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্বটির দিকসমূহ নিম্নে বর্ণিত হলোঃ

(১) জ্যামিতিক পদ্ধতিঃ টমাস হব্‌সের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্বটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জ্যামিতিক পদ্ধতি। তিনি জ্যামিতিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে এই তত্ত্বটিকে ব্যাখ্যা করেন। তার এই জ্যামিতিক পদ্ধতি রাজনৈতিক আলোচনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

(২) গাণিতিক পদ্ধতিঃ জ্যামিতিক পদ্ধতি টমাস হবসের এই তত্ত্বটির বিশেষ দিক। তিনি তার বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনায় জ্যামিতিক পদ্ধতির পাশাপাশি গাণিতিক পদ্ধতিরও প্রয়োগ করেছেন। তিনি তার রাজনৈতিক আলোচনায় এর সাহায্য নিয়েছেন।

(৩) গতিশীলতাঃ গতিতত্ত্ব টমাস হবসের বস্তুবাদ তত্ত্বটির একটি বিশেষ দিক। তিনি জগতের গতিতত্ত্বকে মানব সমাজে প্রয়োগ করেছেন। তিনি মনস্তত্ত্ব ও রাজনীতিকে গতির সাথে সুসমন্বিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন।

(৪) ধর্মনিরপেক্ষতাঃ আধুনিক যুগের ধীশক্তি সম্পন্ন দার্শনিক টমাস হবসের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনায় ধর্ম নিরপেক্ষতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি হলেন একজন বস্তুবাদী দার্শনিক। তিনি বাস্তব ছাড়া অবাস্তবের পেছনে ছুটেননি। ধর্মের ন্যায় অপার্থিব বস্তুতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করেন, ধর্ম যেহেতু প্রকাশ্যে হয়ে থাকে তাই তা আইনের আওতাধীন।


(৫) বস্তুর প্রাধান্যঃ বস্তুর প্রাধান্য টমাস হবসের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্বটির ব্যাখ্যায় বিশেষ স্থান পেয়েছে। তার মতে, পৃথিবীতে বস্তু ছাড়া অন্যকোনো কিছুই অবাস্তব। যা পদার্থ নয় তা বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোনো অংশ নয়।

(৬) ক্ষমতা লাভের আকাঙ্খাঃ ক্ষমতা লাভের আকাঙ্খা টমাস হবসের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। তার মতে, মানুষ আপন কল্যাণে ব্যস্ত। সে কল্যাণকে চিরস্থায়ী করতে চায়৷ তিনি তার বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের মধ্যে এই দিকটাকে দেখিয়েছেন।


(৭) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগঃ হবস বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন। তার মতে, বিজ্ঞান যেমন নির্দিষ্ট পথে ও যুক্তিসহকারে সমস্যা সমাধানে অগ্রসর হয়, একই নিয়ম সমাজের ক্ষেত্রেও অবলম্বন প্রয়োজন।


(৮) পরীক্ষা নিরীক্ষাঃ হবসের মতে, বিজ্ঞানের পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া কোনো মতবাদেরই সত্যতা স্বীকার করে নেয়া যায় না। তাই পান্ডিত্যবাদীদের অধিবিদ্যাকে নিস্ফল বাকচাতুর্য বলে প্রত্যাখ্যান করে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত তত্ত্বের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন।

(৯) রাষ্ট্র দর্শন ও গতিতত্ত্বঃ রাষ্ট্রদর্শন ও গতিতত্ত্ব টমাস হব্‌সের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি রাষ্ট্রতত্ত্বে গতিতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রদর্শন বৈজ্ঞানিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মতে, কেবল রাষ্ট্রদর্শন নয়, সব ঘটনাই গতিসম্পন্ন, গতিময়তা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে কোনো বস্তুর কার্যক্রম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা সম্ভবপর নয়৷

(১০) ব্যক্তির আচরণ ও সমাজঃ মানুষের আচরণ, চিন্তা, অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা ইত্যাদি গতির প্রকাশভঙ্গি। হবস্ তার গতিতত্ত্বকে শুধু জড়জগতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং মানবসমাজের ব্যাখ্যাদানেও সমভাবে সম্প্রসারণ করেছেন। তার মতে, বিলিয়ার্ড টেবিলের উপর ঘূর্ণায়মান একটি বল যেমন অন্যান্য বলের গতিবিধিকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি সমাজের একজন মানুষ অপর মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে। তাই হবস তার রাষ্ট্র দর্শনে সমাজ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

বস্তুবাদের প্রভাবঃ বস্তুবাদের প্রভাব হসের রাষ্ট্রদর্শনে বিশেষভাবে অনুভূত হয়। নিম্নে হসের বস্তুবাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

(১) হবস বস্তুবাদের তত্ত্বের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, মানুষ আপন কল্যাণ লাভে ব্যস্ত এবং সে কল্যাণকে স্থায়িরূপে ভোগ করতে চায়।

(২) হবস জ্যামিতিক পদ্ধতিতে কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেন। এসব স্বতঃসিদ্ধের সাহায্যে জটিল সমস্যার সমাধান করা যায় বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

(৩) হবসের মতে, মানুষের মধ্যে সমতার স্পৃহা বিদ্যমান। মানুষে মানুষে বড় ধরনের কোনো পার্থক্য নেই।

(৪) মানুষ সদাসর্বদা আত্মসংরক্ষণের তাড়নায় ব্যস্ত। বাঁচার সংগ্রামে সে বিব্রত, ক্ষমতা লাভের আশায় সে উদ্বিগ্ন। মৃত্যুতেই এসবের সমাপ্তি ঘটে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমালোচনা সত্ত্বেও হবসের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তত্ত্বের গুরুত্বকে অবহেলা করা চলে না। বিভিন্ন সমালোচক এর সমালোচনা করলেও হসের প্রতি ন্যায়বিচার করার জন্য আমাদের এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, হবস ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ এবং তৎকালীন জ্যামিতিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমেতিনি এই তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত করেন।