অথবা, টমাস একুইনাস কে ছিলেন? তাকে মধ্যযুগের এরিস্টটল বলার কারণ কী?
ভূমিকাঃ সেন্ট টমাস একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম। অধিকাংশ রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে, সেন্ট টমাস একুইনাস ত্রয়ােদশ শতাব্দীর তথা সমগ্র মধ্যযুগের রাষ্ট্র চিন্তার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সফল দার্শনিক। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক Dunnang বলেন ‘He is the greatest of the Later Scholastics and perhaps of all scholastics.’ তিনি ১২২৭ খ্রীষ্টাব্দে নেপলস শহরের উপকণ্ঠে রোক্কাসিকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেন। তিনি পার্থিব ও অপার্থিব রাষ্ট্রের মধ্যেও সমন্বয়সাধন করেন।
টমাস একুইনাসকে মধ্যযুগের এরিস্টটল বলার কারণঃ একথা সর্বজনবিদিত যে, রাষ্ট্র দর্শনের ইতিহাসে সেন্ট টমাস একুইনাস সর্বাপেক্ষা যুক্তিবাদী দার্শনিক। মধ্যযুগের রাষ্ট্র দার্শনিক একুইনাসকে মধ্যযুগের এরিস্টটল বলার কারণগুলাে নিম্নরূপ-
(১) রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতিঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত ধারণায় একুইনাস এরিস্টটলের ধারণায় অনুপ্রাণিত হন। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে একুইনাস এরিস্টটলের মত অনুসরণ করে বলেন, রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিখুঁত সংগঠন। এর উৎপত্তির মূলে রয়েছে মানুষের সহজাত ও সামাজিক প্রবৃত্তি। আদর্শ ও উন্নত জীবনের জন্য পরস্পর সেবার ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠিত।
(২) ধর্ম ও দর্শনঃ ধর্ম ও দার্শনিক মতবাদের দৃষ্টিতে একুইনাসকে মধ্যযুগের এরিস্টটল বলা চলে। এরিস্টটল যেখানে দর্শন ও যুক্তিকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন একুইনাস আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, দর্শনই সব কিছুর শেষ নয়, এর বাইরে আরও একটি স্তর আছে এবং সেটি হলাে ধর্মতত্ত্ব।
(৩) আইনঃ আইন সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় এরিস্টটলের সাথে একুইনাসের সাদৃশ্য রয়েছে। একুইনাস এরিস্টটলের আইন তত্ত্বের ভিত্তিতে তার আইন তত্ত্ব দাঁড় করেন। এরিস্টটল আইন প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তি ও ইচ্ছা উভয়ই আইনের উৎস। একুইনাসও এর দৃঢ় সমর্থক।
(৪) মানবতত্ত্বঃ মানব তত্ত্বেও একুইনাসের ধারণায় এরিস্টটলের শ্লোগান প্রতিধ্বনি হতে দেখা যায়। তিনি এরিস্টটলের মানব দর্শনে প্রভাবিত হয়ে তারই কথার প্রতিধ্বনি করেন, ‘Man is by nature a social and political being and who does not live in society he is either a beast or God.’
(৫) দাসতত্ত্বঃ একুইনাস প্রাচীন যুগের দার্শনিক এরিস্টটলের দাসতত্ত্ব দ্বারাও যথেষ্ট প্রভাবিত হন। উভয়ই মনে করেন যে, রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য দাসপ্রথা ন্যায়সঙ্গত। তিনি এরিস্টটলের ধারণায় প্রভাবিত হয়ে বলেন, মানুষে মানুষে অসমতা থাকায় দাসের আবির্ভাব আর সৈনিকরা যুদ্ধে অসমর্থ হলে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হয়।
(৬) শাসনব্যবস্থাঃ এরিস্টটলকে শাসনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার জনক বলা হয়। তার মতে, শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা উত্তম সরকারব্যবস্থা। এ ব্যাপারে একুইনাসও একমত পােষণ করেন। কারণ তিনিও আইনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার পক্ষপাতি।
(৭) সরকারের শ্রেণী বিন্যাসঃ একুইনাস সরকারের শ্রেণীবিন্যাসের ব্যাপারে এরিস্টটলের মূলনীতি অনুসরণ করেন। সকলের মঙ্গল ও শুধু শাসকের মঙ্গল এই দুই লক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি সরকারকে ১. ন্যায় পরায়ণ, ২. বিকৃত সরকার- এই দুভাগে বিভক্ত করেছেন। তিনি এরিস্টটলের দৃষ্টিতে বলেন, ‘Monarchy is the best form of Government.’
(৮) নগর রাষ্ট্রঃ নগর রাষ্ট্র সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় একুইনাসের চিন্তাধারায় এরিস্টটলের অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। এরিস্টটল বলেন, নগর রাষ্ট্র একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিখুঁত সংগঠন। আর একুইনাস বলেন, নগররাষ্ট্র একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিখুঁত সংগঠন কিন্তু আদর্শভিত্তিক নয়।
(৯) শ্রমবিভাগঃ একুইনাস শ্ৰেণীতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে শ্রম বিভাগ ব্যাখ্যা করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি যথাযথভাবে এরিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেন। উভয়ই যাতে সমাজের কল্যাণ ও স্বার্থ অটুট থাকে, এ ব্যাপারে শ্রমিককে কাজ করতে বলেছেন।
(১০) সমাজ ব্যবস্থাঃ একুইনাসের সমাজব্যবস্থায় এরিস্টটলের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে তিনি এরিস্টটলকে অনুসরণ করে বলেন, ‘Like all nature society is a system of ends and purposes in which the lower serves the higher and the higher directs and guides the lower’
(১১) বিশ্বাস ও যুক্তিঃ বিশ্বাস ও যুক্তির ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। একুইনাস এরিস্টটলের যুক্তিবাদকে গ্রহণ সাপেক্ষে যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে সমন্বয়সাধন করার প্রয়াস পেয়েছেন। তার মতে বিশ্বাস ও যুক্তি পরস্পর বিরােধী নয় বরং বিশ্বাস যুক্তিকে পূর্ণতা দান করে।
(১২) কার্যকারণ তত্ত্বঃ টমাস একুইনাস এরিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি এরিস্টটলের চূড়ান্ত কার্যকারণ তত্ত্বকে গ্রহণ করেন। তিনি তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন যে, প্রকৃতিতে কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় সবার চরম বিকাশের জন্য কর্মরত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তিবাদ মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ।
(১৩) প্রাকৃতিক তত্ত্বঃ প্রাকৃতিক তত্ত্ব সম্পর্কে একুইনাস এরিস্টটলের মতবাদকে গ্রহণ করেন। কিন্তু একুইনাস বলেন যে, এই বিশ্ব প্রকৃতিই শেষ নয়, বিশ্ব প্রকৃতির উর্ধ্বে একটি জগত আছে। সেটি হচ্ছে ঐশী জগত বা স্বর্গরাজ্য। তা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক তত্ত্বে উভয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শনের মধ্যে এরিস্টটলের চিন্তাধারার অবাধ বিচরণ প্রতিফলিত হয়েছে। সেন্ট টমাস একুইনাস দক্ষতার সাথে এরিস্টটলের দর্শনকে গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি বরং একে রােমান ক্যাথলিক দর্শনের ভিত্তি প্রস্তরে পরিণত করেন। সুতরাং এখন একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগীয় এরিস্টটল।
Leave a comment