প্রশ্নঃ ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবােধ, আইন-কানুন ইত্যাদি সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যা অর্জন করে তাই হলাে সংস্কৃতি’ (ই বি টেইলর)- উক্তিটি পর্যালােচনা কর।
অথবা, ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবােধ, আইন-কানুন ইত্যাদি সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যা অর্জন করে তাই হলাে সংস্কৃতি।’ (ই বি টেইলর)- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ Culture বা সংস্কৃতি হলাে ব্যক্তি বা সমাজজীবনের দর্পণ। জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন উপায়ে মানুষ স্বীয় সমাজের প্রচলিত আচার-বিধিগুলাে আয়ত্ত করে সামাজিক হওয়ার দীক্ষা পায়। অন্যান্য জীবের তুলনায়, মানুষের এই স্বতন্ত্রতা ও ভিন্নতাই হলাে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি একটি আপেক্ষিক শব্দ ও জটিল প্রপঞ্চ, যার চর্চা শুরু হয়েছে বহুকাল পূর্বে জার্মানিতে। এ কারণে বহুমুখী চিন্তাস্রোতের স্রষ্টা Culture বা সংস্কৃতির পরিচয় নিয়ে ব্যাপক মতান্তর পরিদৃষ্ট হয়।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ই.বি টেইলরের উক্তির বিশ্লেষণঃ “জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবােধ, আইন-কানুন, সে সমাজের কালচার বা সংস্কৃতি”- এই উক্তিটির গ্রহণযােগ্যতা নিরূপণ করতে হলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে Culture সম্পর্কিত আলােচনা বিশ্লেষণ করার প্রয়ােজন রয়েছে। কেননা অন্যান্য তাত্ত্বিকদের মতামত বিশ্লেষণের মাধ্যমেই ই.বি. টেইলরের উক্তির যথার্থতা খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর।
সাহিত্যে যা কিছু সুন্দর যা কিছু ভালাে তার অনুশীলনই সংস্কৃতি (Mathew Arnold)। রবিঠাকুরের ভাষায়, হীরক খণ্ডটি হলাে সভ্যতা। আর এ থেকে বিচ্ছুরিত দ্যুতিটি হলাে সংস্কৃতি। তবে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীরা দু’টো অর্থে Culture কে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন-(১) ব্যাপক অর্থে Culture হলাে Whole Way of life (২) বিপরীতে সংর্কীণ অর্থে সংস্কৃতি হলাে- মার্জিত রুচি ও অভ্যাসগত উৎকর্ষ।
অন্যদিকে স্পেনসার ও ক্রোবারের মতে, সংস্কৃতি হলাে অধিজৈব (Super organic)। স্পেনসারের মতে, জীবজগতে পরিবর্তন হয়েছে এভাবে- অজৈব থেকে জৈব এবং জৈব থেকে অধিজৈব। মানবশিশু জন্মের আগে অজৈব সত্তায় থাকে। অর্থাৎ জীব হিসেবে তার অস্তিত্ব তখনাে স্পষ্ট নয়। ক্রমে মাতৃগর্ভে সে জীবসত্তা অর্জন করে।
এ অবস্থায় সে সামাজিক কোনাে আচরণ দেখায় না। তাই জীবদেহ অধিজৈব বা সামাজিক সাংস্কৃতিক জীব হওয়ার প্রমাণ দেয় যখন শিশু তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিবেশ বিশেষ করে মাতাপিতা বা নিকটস্থ কোনাে ব্যক্তি বা আপনজনের প্রতি কোনাে প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে। ক্রমশ সে অর্থপূর্ণ সাড়া দিতে শিখে, তার হাসি-কানা ও হাত-পা নাড়াচাড়ার মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়। ক্রমে ভাষাও আয়ত্ত করে। বস্তুত ভাষা আয়ত্ত করার আগেই শিশুর মধ্যে চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার তথা অধিজৈব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
এ পর্যায়েই বলা যায় যে সে সাংস্কতিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। অর্থাৎ তার সংস্কৃতি রয়েছে। তাই বলা হয় যে, সংস্কৃতি হলাে অধিজৈব বা জৈবসত্তার অতিরিক্ত। মনুষ্য জীবদেহে যখনই এই অতিরিক্ত সত্তা বা ধ্যান-ধারণা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির উন্মেষ ঘটে তখনই সে হয় সংস্কৃতিসম্পন্ন জাব।
মার্কসীয় ধারণায় সংস্কৃতি হলাে অধিকাঠামাে বা ওপরিকাঠামাে। মৌল বা অবকাঠামাের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আধকাঠামাে আর অধিকাঠামােই হলাে মার্কসীয় দৃষ্টিতে সংস্কৃতি। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে অর্থাৎ বিভিন্ন অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় বা মৌল কাঠামােয় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অধিকাঠামাে বা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ ধারণার সূত্র ধরে বলা চলে যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ভিত্তি বা সমাজতান্ত্রিক মৌল কাঠামাে সমাজতান্ত্রিক অধিকাঠামাে বা সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। অর্থাৎ এ অবস্থায় বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক জীবনপ্রণালী হলাে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি। মার্কসীয় ব্যাখ্যায় তাই সংস্কৃতির বিভিন্নতার জন্য দায়ী বিভিন্ন ধরনের মৌলকাঠামাে বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কেননা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির উপর নির্ভর করে সে সমাজের সংস্কৃতির স্বরূপ। অতএব বলা যায় যে, অর্থনৈতির সঙ্গে সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান এবং মার্কসের মতে, অর্থনীতিই মূলত সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে থাকে।
তাছাড়া আরাে দুটো দৃষ্টিকোণ থেকে Culture-এর বিশ্লেষণ করা হয়। এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী নৃ-বিজ্ঞানীদের মধ্যে বির্তক রয়েছে। যেমনঃ পশ্চিম দৃষ্টিকোণ থেকে Maclver তার The Modern State গ্রন্থে বলেন- ‘Our culture is what we are.’ অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানী Jons তার Besic Principles of Sociology গ্রন্থে বলেন- ‘Culture is the sum of mans éreation.’ আবার Ross মানুষের যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানের সমন্বয়কে Culture বলেছেন, তবে সমাজবিজ্ঞানী Sameul Keening তার Sociology গ্রন্থে ভিন্ন সুরে culture কে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তিতে culture কে সংজ্ঞায়িত করে বলেন-“Culture may be defined as the sumtotal of mans effort to adjast himself to his environment and to improve his modes of living.” তাহলে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি হলাে way of life.
অন্যদিকে নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃতি হচ্ছে অর্জিত আচরণ। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ সমাজের আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবােধ ইত্যাদি অনুকরণ করে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সমাজের সদস্য হিসেবে নয় সমাজ থেকে যা কিছু অর্জন করে তা তার সংস্কৃতি। এ জন্যই বলা হয় যে, সংস্কৃতি হচ্ছে ব্যক্তির অর্জিত আচরণ। সংস্কৃতি এক পুরুষ থেকে পরবর্তী পুরুষে সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তিয়ে থাকে। অর্থাৎ আমরা পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি সামাজিক পরিমণ্ডলে ধীরে ধীরে উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করি। এই গ্রহণ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক, সচেতন ও অচেতনে সমাধা হয়। সমাজের সদস্য হিসেবে আমরা যা অর্জন করি তা সংস্কৃতি। এ ধারণাটির সংগে সম্পর্কযুক্ত যে সংজ্ঞাটি বহুল আলােচিত সেটা দিয়েছেন ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী টেইলর তার Primitive culture গ্রন্থে।
সংস্কৃতি মানুষকে জীবনের একটি কাঠামাে বা রূপরেখা প্রদান করে যে অভ্যন্তরের জৈবিক ব্যবস্থা প্রাণীকে যা দান করে সমাজজীবনে মানুষকে সংস্কৃতি তাই দান করে। কেননা, প্রাণী চালিত হয় তার জৈবিক ব্যবস্থা ও চাহিদানুযায়ি। প্রাণী চালিত হয় তার জৈবিক ব্যবস্থা ও চাহিদানুযায়ী প্রাণীর কোনাে সংস্কৃতি নেই। মানুষের সামাজিক বা অজৈব সব চাহিদাই সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। শুধু তাই নয়, মানুষের জৈবিক চাহিদা যতটুকু আছে তা আবার সংস্কৃতি দ্বারা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। যেমন তার যৌনাকাঙ্ক্ষা বা খাদ্যগ্রহণ প্রণালি সংস্কৃতি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, সংস্কৃতি হচ্ছে আমাদের সামগ্রিক জীবনের রূপ যা উপযুক্ত আলােচনার মাধ্যমে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। সংস্কৃতি মানুষের জীবনে পূর্ণতা প্রদান করে থাকে। আর এই সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে রয়েছে আচরণ, ধর্ম, চিন্তা চেতনা, কৃষ্টি, শিক্ষা, তথা সমগ্র সত্তা। আর্থ-সামাজিক বা মৌল কাঠামাের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নানা অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান এবং ধ্যান-ধারণা সবই অবকাঠামাে বা সংস্কৃতি। এই মর্মে শিল্পকলা, রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম, দর্শন, প্রথা, আচার সবই সংস্কৃতি।
Leave a comment