‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে লেখকের দৃষ্টিতে চন্দ্রশেখরই আদর্শ চরিত্র। তাই বোধ হয়, কাহিনির প্রধানতমা চরিত্র শৈবালিনী কিংবা প্রধানতম পুরুষ চরিত্র প্রতাপের নামাংকে লেখক গ্রন্থটির নামকরণ করেননি। আদর্শ চরিত্র চন্দ্রশেখরের নামেই উপন্যাসের নামকরণ করা হয়েছে। চন্দ্রশেখর উদার মহৎ চরিত্রের অধিকারী। গীতায় যে নিষ্কাম কর্মসাধনার আদর্শ প্রকাশ পেয়েছে– চন্দ্রশেখর চরিত্রকল্পনায় তারই উপস্থাপনা। অবশ্য সুস্পষ্টভাবে নয় আভাস ব্যঞ্ছনার মধ্য দিয়ে শৈবালিনী কিংবা প্রতাপের মতো কর্মচাঞ্চল্য হৃদয়তরঙ্গাচ্ছ্বাসের পরিচয় চন্দ্রশেখরের মধ্যে অনুপস্থিত। তবুও এই নম্র-নীরব অচঞ্চল মানুষটির চরিত্রাঙ্কন সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে সংশয় নেই।

ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশে চন্দ্রশেখরের আবির্ভাব। তিনি পারিবারিক পরিবেশের প্রভাবে, আপন স্বভাবধর্মে জ্ঞান-তপস্যাব্রতী। জ্ঞানসমুদ্রের সম্পদ আহরণে একান্ত মগ্ন-মম তিনি। এর ফলেই বেশি বয়স পর্যন্ত তিনি বিবাহ করেননি। তাঁর মন খানিকটা সংসারবিমুখ হয়ে উঠেছে। অধ্যয়নে নিরন্তর ব্যপ্ত থাকার ফলে সংসারের প্রতি, সংসার জীবনের প্রতি তাঁর কোনোরূপ অনুরাগ জন্মেনি। সংসারধর্ম পালনে জ্ঞান তপস্যাব্রত বিঘ্নিত হবে, হয়তো এমন একটি ধারণা তাঁর হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যচন্দ্র তাঁকে ভিন্নপথে পরিচালিত করেছে। প্রায় এক বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটেছে। তিনি মর্মে মর্মে বিবাহ করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলেন। কারণ, তাঁর নিজের রান্না করে খাওয়ার দরুন, পড়াশুনায় বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া, দেবসেবা আছে, ঘরে শালগ্রাম শিলা আছে, এ সকল কাজই তাঁর নিজেকে করতে হয়। এইসমস্ত কাজে তাঁর বিস্তর সময় যায়। দেবতার সেবার শৃঙ্খলা ঘটে না বটে—গৃহধর্মের শৃঙ্খলা ঘটে। এমনকি, কোনো কোনো দিন তার আহারের ব্যবস্থা হয়ে ওঠে না, বইপত্র হারিয়ে যায়, খুঁজে পান না। সঞ্চিত অর্থ কোথায় রাখেন, কাকে দেন, মনে থাকে না। খরচ নেই অথচ অর্থে কুলায় না। তিনি ভাবলেন বিবাহ করলে বোধ এর একটা বিহিত হতে পারে। কিন্তু তিনি স্থির করলেন, বিবাহ যদি করতে হয়, তবে সুন্দরী মেয়ে কিছুতেই নয়। কেননা সুন্দরীর দ্বারা মনমুগ্ধ হবার সম্ভাবনা, সংসার বন্ধনে মুগ্ধ হওয়া তাঁর পক্ষে অনুচিত। চন্দ্রশেখর যখন এমন জটিল চিন্তায় মগ্ন তখন, প্রতাপ ও শৈবালিনী নদীবক্ষে আত্মোৎসর্জনের সংকল্পে নদীতে ডুবতে গিয়ে প্রতাপ ডুবলেন। কিন্তু শৈবালিনী ডুবতে পারেননি। আকস্মিকভাবে চন্দ্রশেখর সেই পরিবেশে এসে উপস্থিত হন নৌযাত্রী রূপে। তিনি নিমজ্জমান প্রতাপকে উদ্ধার করলেন এবং শৈবালিনীকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হলেন। শৈবালিনীকে দেখে সংযমী চন্দ্রশেখরের সংযমীর বাঁধ ভেঙে গেল। ভেবেচিন্তে কিছু ইতঃস্তত না করে অবশেষে তিনি নিজে থেকেই ঘটক লাগিয়ে শৈবালিনীকে বিবাহ করলেন। “সৌন্দর্যের মোহে কেনা মুগ্ধ হয়?” অর্থাৎ জ্ঞান তাপস চন্দ্রশেখর শৈবালিনীকে দেখার পর থেকে হয়ে উঠলেন প্রেমিক চন্দ্রশেখর।

রূপমুগ্ধতাবশতঃ শৈবালিনীকে চন্দ্রশেখর বিবাহ করলেন বটে কিন্তু সহজ দাম্পত্য জীবন তাঁর ভাগ্যে ঘটল না। তার জন্য দায়ী কিছুটা তাঁর অদৃষ্ট ও কিছুটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এমন এক নারীকে তিনি স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলেন যিনি অন্নপূর্ণা। অন্য পূর্ণ নারীকেও তিনি আপস করে নিতে পারতেন যদি তিনি দাম্পত্য জীবনের কর্তব্য পালনে পরান্মুখ না হতেন। প্রতিনিয়ত জ্ঞানচর্চার মধ্যে ডুবে থাকার জন্য তিনি নবযৌবনা স্ত্রীর প্রতি যথাকর্তব্য পালন করেননি। এ কারণে স্বামীর সংসারে তাঁর মনে ভরল না।

চন্দ্রশেখর ছিলেন আত্মসমালোচক। রূপসী তরুণীর প্রতি কর্তব্যে অবহেলা ঘটছে দেখে, তিনি মাঝে মাঝে মানসিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েন। সুপ্তা শৈবালিনীর দিকে চেয়ে তিনি স্বগত ভাষণের মধ্যে দিয়ে নিজের মানসিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটান– “আমার গ্রন্থগুলি তুলিয়া পাড়িয়া এমন নব যুবতীর কী সুখ, আমি নিতান্তই আত্মসুখপরায়ণ, সেজন্য ইহাকে বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। এক্ষণে আমি কী করিব? এই ক্লেশ সঞ্চিত পুস্তররাশি জলে ফেলিয়া দিয়া আসিয়া রমণী সুখপদ কী এ জন্মের সরাভূত করিব? ছি ছি তাহা পারিব না।” অর্থাৎ তিনি যথার্থভাবে আত্মগ্লানিতে নিমগ্ন।

কিন্তু চন্দ্রশেখর শৈবালিনীকে ভালোবাসতেন। সচেতন মনে সংসার মায়ার হাতে ধরা দিতে চাইলেও নিজের অজ্ঞাতসারে মায়ার পারবশ্য তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে। শৈবালিনী কখন যে তাঁর মনের কোণে বড়ো একটা স্থান করে নিয়েছে তা তিনি জানতে পারেননি। যেদিন স্পষ্টত জানতে পারলেন সেইদিন শৈবালিনী তাঁর গৃহের অবরোধ কাটিয়ে নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়েছে। মুর্শিদাবাদ থেকে নিজের বাড়ি ফেরার কালে পথিমধ্যে এ হেন উৎকণ্ঠা স্ত্রীর প্রতি তাঁর প্রেমাকর্ষণের নির্ভূল পরিচয় বহন করে।

শৈবালিনী অপহূতা হওয়ার পর বেদনার কঠিন আঘাতে চন্দ্রশেখরের প্রেমিক সত্তাটি গোপনতার আবরণ সরিয়ে বাইরে নিজেকে প্রকাশিত করলো। তাঁর হৃদয়যন্ত্রণা দুঃসহ। কিন্তু প্রকাশ অতি সংযত। এতকালের সযত্নে সংগৃহীত গ্রন্থগুলি তিনি অগ্নিশিখায় নিক্ষেপ করলেন। গ্রন্থসব ভস্মীভূত হলে গৃহত্যাগ করলেন। গৃহত্যাগের কারণ, ‘গৃহিণী নাই, তাই গৃহত্যাগ।’ কিন্তু গ্রন্থগুলি দগ্ধ করার কারণ হল– এইসব গ্রন্থই শৈবালিনীও তাঁর মাঝখানে ব্যবধানের প্রাচীর তুলে দিয়েছিল– গ্রন্থপ্রীতির জন্যই শৈবালিনীকে তিনি পাননি। শৈবালিনী যদি গেল তবে গ্রন্থগুলি রেখে কী লাভ। গ্রন্থগুলি পুড়িয়ে তিনি দাম্পত্য জীবনে কর্মবিচ্যুতির প্রায়শ্চিত্য করলেন।

রমানন্দ স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর চন্দ্রশেখর স্নেহকোমল ভাবগম্ভীরে চরিত্রের ওপর সমাজনীতিবোধের একটা আবরণ নেমে এসেছে। তাছাড়া স্বামীজীর সংসর্গে এসে তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক স্ফুরণ যেন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর কর্মধারার নিসারক হয়ে উঠেছে রমানন্দ স্বামী। চন্দ্রশেখর শৈবালিনীকে অনুসরণ করেছেন, তাঁর অর্ধমূর্ছিত দেহ পর্বতগুহায় রেখে এসেছেন, উন্মাদগ্রস্ত হয়ে তিনি শৈবালিনীর শুশ্রুষা করেছেন, তাঁকে নিয়ে বেদগ্রামে ফিরেছেন, যৌগিক প্রক্রিয়ায় তাঁর চিকিৎসা করেছেন। তিনি এ সমস্তই গুরু রমানন্দের নির্দেশে করেছেন। এখানে চন্দ্রশেখরের ব্যক্তিত্ব অপ্রকট থেকে গেছে।

তবে গৃহত্যাগিনী শৈবালিনীকে পূনর্বার গ্রহণ করতে তিনি অন্তরে অন্তরে ব্যাকুল ছিলেন। পাপের কলুষ শৈবালিনীকে স্পর্শ করেছে, সে নিঃসন্দেহে দ্বিচারিণী। তথাপি অপরাধিনী স্ত্রীকে তিনি গৃহের আশ্রয়ে ফিরিয়ে এনেছেন, নিজের স্নেহযুক্ত ভালোবাসার পক্ষপুটে তার নির্ভয় স্থান করে দিয়েছেন। হৃদয়ের এই ঔদার্য, এই ক্ষমা চন্দ্রশেখর চরিত্রকে মহত্ত্বে দীপ্যমান করে তুলেছে। ক্ষমা ও তিতিক্ষার প্রকাশে চন্দ্রশেখর আদর্শ স্বামীর গৌরব অর্জন করেছেন– স্ত্রীর স্খলনপতন ত্রুটিকে তিনি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। দাম্পত্যধর্মকে এইভাবে কল্যাণের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, বঙ্কিমচন্দ্র এটাই যেন চন্দ্রশেখর চরিত্রের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন। তাই সবমিলিয়ে মন্তব্য করতে হয়– চন্দ্রশেখর যেমন উচ্চ আদর্শের প্রতিরূপ, তেমনি তিনি মানবিক মহিমায় দীপ্ত।