জ্ঞানদাসের কাব্যের একটি মূলধর্ম রোমান্টিকতা, রহস্যময়তা যাঁর কাব্যের মূল সম্পদ, অন্যান্য বৈক্ষ্ণব পদকর্তার কবিধর্মের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য-সহজেই অনুমানযোগ্য। জ্ঞানদাস জানতেন শিল্প নৈপুণ্য কাকে বলে। জানতেন কিভাবে পাঠকের হৃদয়কে ভাবাকুল করে তোলা যায়। যেমন পূর্বরাগের একটি পদে তিনি লিখেছেন—

“আলো মুঞি জানো না সই জানো না।”

রাধা আকুলভাবে পরম অনুয়ের সুরে প্রকাশ করছেন তাঁর মর্মবেদনা। কৃষ্ণ কদম্বতলে দাঁড়িয়ে আছেন, রাধিকা বলছেন, তা জানলে ঐ স্থানে যেতাম না। শুধুমাত্র এই টুকু বলার জন্য কি এমন সুরময়বাণী, ঝংকৃত হয়েছে? না, এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে রহস্যময় ব্যাকুলতা।

রোমান্টিক মনোভাবের একটি স্বতঃসিদ্ধ গতি বিষাদের দিকে। জ্ঞানদাসের কাব্যে প্রায়ই সেই একটি রোমান্টিক বিষাদের সুরকে বেজে উঠতে দেখা যায়। কবি উপলব্ধি করেন যে, যে আনন্দ বা উল্লাসকে পরম সত্য বলে গ্রহণ করা হচ্ছে তা অবিমিশ্র আনন্দময় নয়। বেদনার ম্লান ছায়া তারমধ্যে নিহিত। এই উপলব্ধি কবি জীবনে ঘটে, কিন্তু পরিণাম ভেদ আছে। রোমান্টিক কবিদের ক্ষেত্রে এই হতাশা বা আর্তিটুকু প্রবল। প্রায় সকল শ্রেষ্ঠ পদকারের মধ্যে ওই অনুভূতির প্রকাশ দেখা গেলেও জ্ঞানদাসেই তার উজ্জ্বল প্রকাশ—

রূপলাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। 

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ পুতলি লাগি থির নাহি বান্ধে।।

এত গম্ভীর রোমান্টিক ভাবানুভূতি বৈব সাহিত্যে আর নেই। অতৃপ্ত বাসনার মর্মস্পর্শী হাহাকার মাত্র চার ছত্রের মধ্যে যেভাবে ধরা পড়েছে, তা তুলনারহিত।

রোমান্টিকতার সঙ্গে স্বপ্নের একটা নিগূঢ় যোগ অনুভূত হয়। যা কিছু অনির্দিষ্ট তার প্রতি রোমান্টিক মনের আকর্ষণ। স্বপ্নে বাস্তব বলে কিছু নেই, অথচ বাস্তবের ছায়াটি তাতে প্রবল, সুতরাং সব রোমান্টিক কবি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। জ্ঞানদাসের স্বপ্নের প্রতি আকর্ষণ আছে। একটি স্বপ্ন দর্শনকে তিনি যে কাব্যরূপ দিয়েছেন বহু ব্যাখ্যাতেও তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়।

মনের মরম কথা     তোমারে কহিয়ে হেথা

শুনশুন পরাণের সই।

স্বপনে দেখিনু যে     শ্যামল বরণ দে

তাহা বিনু আর কারো নই।।

এমন এক আশ্চর্য রূপচিত্র, এমন ভাষা সুর ছন্দের অনিবার্য মায়াবিস্তার শক্তি— অন্য কবির কাব্যে একান্ত দুর্লভ। কোন এক বর্ষাকালে শত কবিতা থাকতে জ্ঞানদাসের নিমোক্ত পদটি রবীন্দ্রনাথের কল্পনাকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল—

রজনী শাঙন ঘন    ঘন দেয়া গরজন

রিমি ঝিমি শবদে বরিষে।

পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে    বিগলিত চীর অঙ্গে 

নিন্দ যাই মনের হরিষে।।

সমালোচকের ভাষায়—“সেদিন রাধিকার ছবির পিছনে কবির চোখের কাছে কোন একটি মেয়ে ছিল। ভালোবাসার কুঁড়ি ধরা তার মন, মুখচোরা সেই মেয়ে, চোখে কাজল পরা, ঘাট থেকে নীল শাড়ী নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলা। সে মেয়ে আজ নেই, আছে শাঙন বন; আছে সেই স্বপ্ন, আজো সমানই।”

রোমান্টিক রহস্যপ্রিয়তার মধ্যে মাধুর্য্য হল অন্যতম লক্ষণ। জ্ঞানদাসে সমস্ত বাংলা পদকে মূলত মধুর বলে নির্দেশ করা যেতে পারে। এই মাধুর্য গুণ সাধারণ ভাবে তাঁর কাব্যের বর্ণনা ভঙ্গি, সংযত প্রকাশ ভঙ্গি শব্দ ব্যবহারের মধ্যে এবং স্থান বিশেষে পরিবেশ ও ঘটনা সংস্থান-কৌশলের গুণে চমৎকারভাবে ফুটেছে। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—রাধার জননী রাধাকে প্রশ্ন করছেন—প্রাণনন্দিনী রাধা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তোমাকে আমি সর্বত্রই খুঁজে ফিরছি, তোমার এমন অপরূপ বেশবাসা কোথায় কেমন করে নষ্ট হল। এর উত্তরে রাধা যা বললেন তা অপরূপ মাধুর্যমণ্ডিত—

মাগো গেনু খেলাবার তরে। 

পথে লাগি পেয়ে    এক গোয়ালিনী

লৈয়া গেল মোরে ঘরে।।

গোপ রাজরানী    নন্দের গৃহিণী

যশোদা তাহার নাম।

তাহার বেটার    রূপের ছটায়

জুড়ায়ল মোর প্রাণ।।

এইভাবে বর্ণনা ভঙ্গির মধ্য দিয়ে জ্ঞানদাসের কাব্যে মাধুর্য গুণ প্রকট হয়ে উঠেছে।

সর্বোপরি বলতে হয়, রোমান্টিসিজমের একদিকে আছে প্রেমানুভূতি অন্যদিকে আছে, সর্ববস্তুতে নিজেকে বিকিরিত করার বাসনা এবং জড়ের মধ্যে প্রাণের অনুভব। এই সকল অংশকে আধ্যাত্মিক ভাবব্যাকুলতার প্রকাশ বললে ভুল হবে। জ্ঞানদাস যে প্রেমের কবি সে প্রেমের মূল মর্মবাণী রোমান্টিকতা। এই প্রেম বর্ণনার মধ্যেই জ্ঞানদাসের কবিত্ব সার্থকতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।