গােবিন্দদাস যেমন বিদ্যাপতির রচনারীতিকে আত্মস্থ করেছিলেন, জ্ঞানদাসের রচনার মধ্যেও তেমনি পূর্ববর্তী কবি চণ্ডীদাসের রচনার অনুসরণ লক্ষ করা যায়।

চণ্ডীদাসের মতাে জ্ঞানদাসের রচনাতেও সরলতা একটি বিশেষ গুণ। জ্ঞানদাসের পদেও প্রবল আন্তরিকতা এবং ভাবগভীরতা লক্ষ করা যায়। রাধার রূপ নির্মাণের ক্ষেত্রেও চণ্ডীদাস এবং জ্ঞানদাসের কবি-স্বভাবে যথেষ্ট সাদৃশ্য বর্তমান। একই বিষয় অবলম্বনে লেখা উভয়ের পদের মধ্যে ভাব, ভাষা ও ছন্দগত মিল অনেকসময় দেখতে পাওয়া যায়। চণ্ডীদাস যেখানে লিখেছেন-

সদাই ধেয়ানে   চাহে মেঘপানে

না চলে নয়নতারা।

বিরতি আহারে   রাঙ্গাবাস পরে

যেমত যােগিনীপারা।

জ্ঞানদাস সেখানে লিখেছেন-

বামকর পরে   ধরিয়া কপােল

মহাযােগিনীর পারা।

ও দুটি নয়ানে   ঝরিছে সঘনে

শ্রাবণ মেঘের ধারা।

চণ্ডীদাসের ‘পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গাে’ পদটির প্রতিধ্বনি শােনা যায় জ্ঞানদাসের কেমনে পাসরি উপায় কি করি পদের মধ্যে। এরকম আরও বহু পদে উভয় কবির মধ্যে সাদৃশ্য বা মিল দেখা যায়। জ্ঞানদাসের রচনায় চণ্ডীদাসের এই প্রভাবের কারণেই জ্ঞানদাসকে ‘চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য’ বলা হয়ে থাকে। তবে সেইসঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, জ্ঞানদাস অনেক ক্ষেত্রে চণ্ডীদাসের প্রভাবকে স্বীকার করলেও তিনি চণ্ডীদাসের হুবহু অনুকরণ করেননি। কবি হিসেবে জ্ঞানদাস অনেক ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রেরও দাবি রাখেন।

জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভা: চৈতন্য-পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব পদাবলির অন্যতম প্রধান পদকর্তা হলেন জ্ঞানদাস। সহজসরল ভঙ্গিতে গভীর ভাবের পদ রচনায় চণ্ডীদাসের সঙ্গে সাদৃশ্যের কারণে জ্ঞানদাসকে ‘চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য’ বলা হয়ে থাকে।

পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ ও নিবেদন পর্যায়ের পদেই জ্ঞানদাসের প্রতিভার সার্থক বিকাশ লক্ষ করা যায়। জ্ঞানদাসের পদে ভক্তি এবং শিল্পবােধের আশ্চর্য মিল চোখে পড়ে। নায়ক নায়িকার রূপ বর্ণনায়, প্রেমাবেগের তীব্র আকুলতা প্রকাশে তাঁর রচনা শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। তার রাধা চণ্ডীদাসের রাধার মতাে নিজেকে ভুলে থাকতে পারেন না, বরং তিনি অনেক বেশি রূপসচেতন নারী-

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। 

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মাের।।

জ্ঞানদাসের পদে এভাবেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেমের অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। আক্ষেপানুরাগের পদে প্রেমিকা রাধার অনুতাপে জর্জরিত হৃদয়ের যে পরিচয় জ্ঞানদাস তুলে ধরেছেন, তা তুলনাহীন-

সুখের লাগিয়া    এ ঘর বান্ধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়া-সাগরে    সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল।।

ভাব ও রূপের মিলনে সচেষ্ট জ্ঞানদাসের পদে রাধাকৃয়ের প্রেমের বিষয়টি এমনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, একালের পাঠকের চোখে অনেক সময় তা রােমান্টিক বলে মনে হয়।

এভাবেই জ্ঞানদাসের পদে রাধাকৃয়লীলাকে অবলম্বন করে বিকশিত হয়ে উঠেছে কবিত্ব—ভক্তি বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের‌ অনুশাসন যাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।

গােবিন্দদাসের কবিপ্রতিভা: গােবিন্দদাস কবিরাজ বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। গােবিন্দদাস। কবিরাজের পদাবলিতে গভীর ভক্তির সঙ্গে অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যের আশ্চর্য মিলন ঘটেছে।

গােবিন্দদাসের পদাবলি আস্বাদন করতে গিয়ে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার গৌরচন্দ্রিকার পদগুলি। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের ভাবময় জীবনকে তিনি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার গৌরচন্দ্রিকা পর্যায়ের পদে-

নীরদ নয়নে    নীরঘন সিনে

পুলক-মুকুল-অবলম্ব

স্বেদ মকরন্দ    বিন্দু বিন্দু চুয়ত

বিকশিত ভাবকদম্ব।।

এরকম বিভিন্ন পর্যায়ের পদে তার কৃতিত্ব ফুটে উঠলেও গােবিন্দদাসের শ্রেষ্ঠত্ব মূলত অভিসার পর্যায়ের পদরচনার জন্য। গােবিন্দদাসের অভিসারিকা রাধার মধ্যে যে দুর্বার কৃষ্ণমুখীনতা লক্ষ করা যায়, তার তুলনা বৈয়বগ্রন্থ নেই বললেই চলে। অভিসার যাত্রার আগে রাধার প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনাতেও আছে সুকঠিন কৃচ্ছসাধনার পরিচয়-

কণ্টক গাড়ি    কমলসম পদতল

মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।

গাগরি-বারি ঢারি    করি পথ পীছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।

হৃদয়ের গভীর অনুভূতি আর সৌন্দর্যচেতনার সার্থক সমন্বয়ে গােবিন্দদাসের পদ অবধারিতভাবেই উৎকৃষ্ট কাব্যের স্তরে উন্নীত হয়েছে। অন্ত্যমিলের রহস্যে, শব্দচয়নে, ছন্দের বিন্যাসে এবং অলংকারের প্রয়ােগে তাঁর নৈপুণ্য চোখে পড়ার মতাে। গৌড়ীয় বৈয়ব দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় গােবিন্দদাসের পদাবলিতে সখীভাবের সাধনা বা মঞ্জরীভাবের সাধনার প্রকাশ লক্ষ করা যায়।

চৈতন্যদেবের আগমনের ফলে বৈষ্ণব পদাবলিতে যে গুণগত এবং মাত্রাগত পরিবর্তনের সূচনা হয় তার ফলে প্রাকচৈতন্য এবং চৈতন্য-পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব পদসাহিত্যের মধ্যে নানা স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এই পার্থক্যগুলি হল-

  • প্রাকচৈতন্য যুগে রাধাকৃষ্ণের প্রেমসম্পর্কই ছিল বৈষ্ণব পদাবলি রচনার একমাত্র বিষয়। কিন্তু চৈতন্য-পরবর্তী যুগে এর বিষয় হয়ে ওঠেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। তাকে নিয়ে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ এবং ‘গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ’ লেখা শুরু হয়। এমনকি লীলাকীর্তনের শুরুতে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ গাওয়াও রীতি হয়ে দাঁড়ায়।

  • প্রাকৃচৈতন্য যুগে যেখানে কৃষ্ণের ঐশ্বর্যভাবই ছিল বৈয়ব পদসাহিত্যের মূলকথা, সেখানে চৈতন্য-পরবর্তীকালে পদাবলি সাহিত্যের মূল বিষয় হয়ে ওঠে কৃষ্ণের মাধুর্য। কংসদমনকারী কৃষ্ণের জায়গা নেয় বাঁশিবাদক মুরলীধর কৃষ্ণ।

  • প্রাকচৈতন্য যুগের বৈষ্ণব পদকর্তারা মােক্ষকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য ভেবেছিলেন। কিন্তু চৈতন্য-পরবর্তী যুগে সখীভাবে ভাবিত বৈষ্ণব পদকর্তারা যুগে যুগে রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমলীলা আস্বাদনের জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসতে চেয়েছেন। তাই মােক্ষ-র ধারণা এসময় বাদ যায়।

  • প্রাকচৈতন্য যুগে রাধা এবং চন্দ্রাবলী ছিলেন এক। কিন্তু চৈতন্য-পরবর্তী যুগে ‘মহাভাবস্বরূপিণী’ রাধার থেকে আলাদা হয়ে চন্দ্রাবলী প্রতিনায়িকা হয়ে উঠলেন।