অথবা, জেমসের সত্য সম্পর্কে প্রয়ােগবাদী মতবাদ বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ জ্ঞানের উৎপত্তির ব্যাপারে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয় উল্লেখযােগ্য যে চারটি মতবাদ রয়েছে সেগুলাের মধ্যে অভিজ্ঞতাবাদ অন্যতম। বুদ্ধিবাদী দর্শনের এক প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ রূপেই অভিজ্ঞতাবাদের উদ্ভব। আধুনিক দর্শনে অভিজ্ঞতাবাদ অন্যতম আলােচ্য বিষয়। অভিজ্ঞতাবাদ মােতাবেক অভিজ্ঞতাই জ্ঞানলাভের যথার্থ উৎস। আর দর্শনের জন্মকালেই অভিজ্ঞতাবাদের জন্য। অপরপক্ষে দর্শনের ইতিহাসে প্রয়ােগবাদ প্রধানত ভাববাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ একটা নতুন ও সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি সংবলিত মতবাদ। প্রয়ােগ বাদের একটি প্রধান মতবাদ হচ্ছে জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদ বা চরম অভিজ্ঞতাবাদ। নিম্নে জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদ এবং সত্য সম্পর্কে প্রয়ােগবাদী মতবাদ আলােচনা করা হলাে-
জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদঃ প্রয়ােগবাদের একটি প্রধান মতবাদ হচ্ছে জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদ বা চরম অভিজ্ঞতাবাদ। তিনি চরম অভিজ্ঞতাবাদের সংজ্ঞায় বলেন যে, একে অভিজ্ঞতাবাদ বলা হয় কেননা এ অভিজ্ঞতাবাদের মতাে ঘটনা বা তথ্য বিষয়ক কোনাে সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে মনে করে না, বরং মনে করে যে, যেকোনাে তথ্য বিষয়ক কোনাে সিদ্ধান্তই ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতার পরিবর্তিত হওয়া সাপেক্ষ প্রকল্পমাত্র। আবার একে চরম বলা হয় কেননা এ এমন এক ধরনের অভিজ্ঞতাবাদ যা এর সংগঠনে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয় না এমন কোনাে উপাদানকে স্বীকার করে না। বা এর সংগঠনের সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এমন কোনাে উপাদানকেও বাদ দেয় না। জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদে আমরা তিনটি নীতি লক্ষ্য করি, যথা-
(১) সম্পর্ক সাপেক্ষেঃ দার্শনিক জ্ঞান অভিজ্ঞতার জগতে সীমাবদ্ধ থাকবে। যেসকল বিষয়ে অভিজ্ঞতামূলক কোনাে দিক নেই সেসকল বিষয়ে দার্শনিক আলােচনা করা উচিত হবে না।
(২) অভিজ্ঞতাসাপেক্ষঃ একটি বস্তু বা বিষয়ের সাথে অন্য বস্তু বা বিষয়ের যে সম্পর্ক তাও ঐ বস্তু বা বিষয়ের মতাে অভিজ্ঞতালব্ধ। অর্থাৎ বস্তু বা বিষয় যেমন অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ তাদের মধ্যকার সম্পর্কও হতে হবে অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ।
(৩) ভিন্ন সত্তার সাহায্যঃ আমাদের প্রাপ্ত সকল খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে এমন একক সূত্রে গ্রথিত যে, আমাদের অভিজ্ঞতার দ্বারাই এদের সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায়। এদের অস্তিত্ব বা ঐক্য বিধানের জন্য কোনাে প্রকার ভিন্ন সত্তার সাহায্য গ্রহণ করতে হয় না।
ব্যাপক অর্থে অভিজ্ঞতাবাদঃ গতানুগতিক অভিজ্ঞতাবাদীরা নানাভাবে অভিজ্ঞতা শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। সাধারণভাবে অভিজ্ঞতা বলতে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সংবেদনকে বুঝায়। আর জেমস ইন্দ্রিয় সংবেদন এবং প্রত্যক্ষণসহ কামনা করা, প্রচেষ্টা করা, ইচ্ছা করা, আসা করা, ভয় করা, সন্দেহ করা এবং নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনা, সৌন্দর্যানুভূতি ইত্যাদিকেও অভিজ্ঞতা বলে অভিহিত করেন।
(১) অভিজ্ঞতা হলাে ক্রিয়াঃ জেমস্ অভিজ্ঞতাকে একটি ধারক সত্তা মনে না করে বরং একে একটি ক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ক্রিয়ার উৎস জড়ত্ব নয়, চেতনাও নয় বরং একটি নিরপেক্ষ পদার্থ। জেমস্ এটির নাম দিয়েছেন বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা। তার মতে, এই বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জগতের মূল উপাদান। জেমসের এই মতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীতে রাসেলসহ অন্যান্য দার্শনিক নিরপেক্ষ একত্ববাদ নামক এক মতবাদ প্রতিজ্ঞা করেন।
(২) জ্ঞান নির্বাচনধর্মীঃ জেমসের মতে, আমাদের জ্ঞান সর্বদা নির্বাচনধর্মী। আমরা আমাদের নির্বাচন অনুযায়ী কোনাে বস্তু বা বিষয়ের অভিজ্ঞতা লাভ কর। বস্তুজগতের নিজস্ব কোনাে অর্থ নেই। অভিজ্ঞতা ক্রিয়ার দ্বারা যেভাবে এর স্বরূপ চিত্রিত হয় এর অর্থ তাই দাঁড়ায়।
(৩) অভিজ্ঞতা পরিবর্তনশীলঃ জেমসের মতে, অভিজ্ঞতা সর্বদা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল এই অভিজ্ঞতা ক্রিয়ার অন্তরালে কোনাে স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় ধারক সত্তা বা মন বলে কিছু নেই। অভিজ্ঞতা হচ্ছে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। নিয়ত পরিবর্তনের মধ্যেও এটি কখনও খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন হয় না।
(৪) অভিজ্ঞতা আত্মগতঃ প্রয়ােগবাদী দার্শনিকগণ অনেক বিষয়ের মধ্যে সত্যতার সমস্যাকেও গুরুত্ব সহকারে আলােচনা করেছেন। তবে সকল প্রয়ােগবাদী দার্শনিক সত্যতার উপর সমান গুরুত্ব আলােচনা করেননি। এদের মধ্যে উইলিয়াম জেমস সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে সত্যতার বিষয়টি আলােচনা করেছেন। আর আমরা সত্যতার আলােচনায় সাধারণত জেম্সকে অনুসরণ করব।
সত্য সম্পর্কে প্রয়ােগবাদী মতবাদঃ প্রয়ােগবাদী দার্শনিকগণ অনেক বিষয়ের মধ্যে সত্যতা সমস্যাকেও গুরুত্বসহকারে আলােচনা করেছেন। তিনি তার Pragmatism এবংThe theory of truth নামক গ্রন্থে সত্যতা সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। বি জেমসের মতে, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কোনাে ধারণা বা বিশ্বাসের কার্যকারিতা নিরূপণের মধ্যেই সত্যতা নিহিত। কোনাে ধারণাকে সত্য বলে স্বীকার করার পূর্বে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার ব্যবহারিক মূল বা ফলপ্রসূ যাচাই করতে হবে, কেননা অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ নিরন্তর সনাতন সত্য বলে কোনাে কিছু নেই। তার মতে, আমাদের আচরণের ক্ষেত্রে যে ধরনের আচরণ সুবিধাজনক তা সত্য, সুবিধাজনক বা হিতকর বিশ্বাস মাত্রই সত্য। সুতরাং সত্যতা সম্পর্কে জেমস তথা প্রয়ােগবাদী মতকে নিম্নেক্ত বৈশিষ্ট্যের আলােকে তুলে ধরা যায়-
(১) সত্যতার গুণঃ সত্যতা কোনাে বচনের অন্তর্নিহিত গুণ নয়, সত্যতা বচনের মধ্যে অন্তর্নিহিতভাবে থাকে না। এটি বচনের উপর আরােপিত হয়।
(২) উপযোগিতা সাপেক্ষঃ এটা বাস্তবিক জীবনের কার্যকারিতা বা উপযােগিতার উপর নির্ভরশীল। এ সম্পর্কে Titus বলেন, “Work ability, satisfactions, an consequences and results are the key work in pragmtic concept of truth. (Titus H.S Type of Philosophy p-1 107)
(৩) সত্যতা পরিবর্তনশীলঃ সত্যতা পরিবর্তনশীল। সত্যতা যেহেতু উপযােগিতার সাথে সম্পর্কিত তাই যে ধারণা যখন উপযােগিতা দেবে তা তখন সত্য। আর একারণে সত্যতা ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
সমালােচনাঃ প্রয়ােগবাদ সাম্প্রতিককালের দর্শনে একটি ব্যাপকভাবে আলােড়ন সৃষ্টিকারী মতবাদ। এ সত্ত্বেও এ মতবাদ বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচনার সম্মুখীন হয়। যেমন-
(১) তত্ত্ব ও যুক্তির চিন্তনের দুর্বলতাঃ প্রয়ােগবাদীরা তাদের মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তত্ত্ব ও যুক্তি চিন্তনকে কোণঠাসা করে ব্যবহারিক ফলাফলের উপর গুরুত্বারােপ করে দর্শনকে জনপ্রিয় করতে গিয়ে এমন এক দুর্বল ও উদ্ভট যুক্তি উপস্থাপন করেন যার ফলে তাদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি কার্যক্রমে উপেক্ষার বস্তু হয়ে দাড়িয়েছে।
(২) প্রয়ােগ বচনের অর্থঃ প্রয়ােগ বচনের অর্থ সম্পর্কে যে ধরনের মত প্রকাশ করে তা গ্রহণযােগ্য নয়। কোনাে বচন উক্তি বা বিবৃতির অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে এ মতবাদ কার্যকারিতা আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু কার্যকারিতা যদি অর্থের মানদণ্ড হয় তাহলে যেকোনাে ব্যক্তি তার আত্ম-স্বার্থ অনুযায়ী কোনাে কিছুর অর্থ নির্ধারণ করে বসবে।
(৩) বাট্রার্ড রাসেলের সমালােচনাঃ সত্য সম্পর্কীর প্রয়ােগবাদী মত বাট্রান্ড রাসেলসহ অন্যান্য দার্শনিকদের দ্বারা কঠোরভাবে সমালােচিত হয়েছে। প্রয়ােগবাদ থেকে সত্যের একটি মানদণ্ড পাওয়া যেতে পারে। তবে এটাই সত্যের একমাত্র বা সর্বোত্তম মানদণ্ড নয়, তার চেয়েও বড় কথা, সত্যের অর্থ সম্পর্কে প্রয়ােগবাদী মত সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর এবং সামাজিক দিক থেকে বিপজ্জনকও বটে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অন্যান্য মতবাদের ন্যায় প্রয়ােগবাদও বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছে। তবে আসল কাজ হলাে এ মতবাদ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। কোনাে সত্য চিরকালের জন্য সত্য নয়। এই মূলনীতি এই মতবাদগ্রহণ করেছে। আমরা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মূলেও এই সত্যের কার্যকারিতা লক্ষ্য করি। সুতরাং সার্বিক আলােচনায় এ মতবাদকে কোনােক্রমেই উপেক্ষা করা চলে না।
Leave a comment