অথবা, জেন্ডার বলতে কী বুঝ? জেন্ডারের ভূমিকা বর্ণনা কর।
অথবা, জেন্ডার কাকে বলে? জেন্ডারের ভূমিকা বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জেন্ডার একটি অন্যতম প্রধান আলােচিত বিষয় হিসেবে বিবেচ্য। তাই জেন্ডার হচ্ছে বর্তমান সময়ে মানব উন্নয়নের অন্যতম কেন্দ্রীয় প্রত্যয়। জেন্ডার বিষয়টি কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলাে উক্ত বিষয়ে পশ্চাৎপদ। তাই উন্নত দেশগুলাের সার্বিক সহযােগিতায় তৃতীয় বিশ্বে জেন্ডার সম্পর্ক একটা সামাজিক বিষয় হিসেবে স্বীকৃত হতে যাচ্ছে।
জেন্ডার কিঃ জেন্ডার শব্দটি একটি ইংরেজি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে (SEX) বা লিঙ্গ। লিঙ্গ বা SEX এর সংজ্ঞায় বলা হয়- প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে সৃষ্ট নারী-পুরুষের বৈশিষ্ট্যসূচক ভিন্নতা বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের স্বাতন্ত্রতাকে বুঝায়। সহজভাবে বলা যায়- ‘Gender is the socio-cultural definition of women and men given by the society.’ তাই আমরা বলতে পারি, জেন্ডার হলাে সমাজ আরােপিত নারী ও পুরুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান।
জেন্ডার ধারণার উৎপত্তিঃ ১৯৭০ সালের দিকে জেন্ডার ধারণাটি বিকশিত হতে থাকে নারীবাদীদের দ্বারা। কথাটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয় যে, প্রতিটি সংস্কৃতিতে নারীরা পুরুষদের সাথে একইভাবে সম্পর্কযুক্ত নয় এবং বিভিন্ন সমাজে ও বিভিন্ন সময়ে নারীর মর্যাদা ভিন্ন হয়। এ্যান ওকলে (Anne Oakley) সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্টভাবে সেক্স এবং জেন্ডার- এর মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরেন।
জেন্ডার ভূমিকাঃ সমাজ কর্তৃক আরােপিত কাজ ও দায়-দায়িত্ব নারী ও পুরুষ দ্বারা পালন করাই হলাে জেন্ডার ভূমিকা। অর্থাৎ বিভিন্ন সমাজে নারী-পুরুষ বিভিন্ন ধরনের কাজের মাধ্যমে যে ভূমিকা পালন করে থাকে, তাই হলাে জেন্ডার ভূমিকা। এক সমাজের কাজ অন্য সমাজে পরিবর্তিত হতে পারে। আবার এক সমাজে বসবাস করেও জেন্ডার ভূমিকা ভিন্ন হতে পারে। মূলত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদার কারণে জেন্ডার ভূমিকা ভিন্ন হয়। জেন্ডার ভূমিকা তিন ধরনের:
(১) উৎপাদনমূলক ভূমিকাঃ যে কাজের বিনিময় মূল্য এবং ব্যবহারিক মূল্য আছে, সে কাজ হলাে উৎপাদনমূলক। আর যে উৎপাদনমূলক কাজে সংশ্লিষ্ট থাকে, বলা যায় সে উৎপাদনমূলক ভূমিকা পালন করে। যেকোনাে সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় পুরুষরা সাধারণত এমন সব কাজে নিয়ােজিত থাকে, যে কাজ দ্বারা আয় বা উপার্জন হয়। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা হয় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। কারণ নারী যেহেতু পূনঃউৎপাদনমূলক কাজে জড়িত, সেহেতু তার এই কাজকে কম (উৎপাদন ভূমিকা) গুরুত্ব দেয়া হয় এবং উৎপাদনমূলক কাজে নারী জড়িত থাকলেও তা অস্বীকার করা হয়।
(২) পূনঃউৎপাদনমূলক ভূমিকাঃ যে কাজের কোনাে বিনিময় মূল্য নেই বা যে কাজ দ্বারা কোনাে অর্থ উপার্জন হয় না, অথচ গুরুত্বপূর্ণ এমন কাজকে পূনঃউৎপাদনমূলক কাজ বলা হয়। সন্তান জন্মদান, লালন-পালন সংক্রান্ত কাজ পূনঃউৎপাদনমূলক কাজ বলে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ সন্তান জন্মদান, লালন-পালন, রান্নাকরাসহ গৃহস্থলির সকল ধরনের কাজগুলাে পূনঃউৎপাদনমূলক কাজ।
(৩) সামাজিক ভূমিকাঃ যে কাজের কোনাে বিনিময় বা আর্থিক মূল্য নেই, অথচ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজের কল্যাণে করা হয়, সেই সকল কাজ করাকে সামাজিক ভূমিকা বলা হয়। সামাজিক ভূমিকাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর একটি হল সামাজিক ব্যবস্থাপনা ভূমিকা এবং অন্যটি হল সামাজিক রাজনৈতিক ভূমিকা। সামাজিক ভূমিকাকে নিম্নে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
(i) সামাজিক ব্যবস্থাপনা ভূমিকাঃ সামাজিক ব্যবস্থাপনা ভূমিকা বলতে সেই ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজকে বুঝানাে হয়, যে কাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে এবং সকলেই এর দ্বারা উপকৃত হয়। যেমন চলাচলের সুবিধার্থে গ্রামের সকলে বা কয়েকজন মিলে সাঁকো বা বাঁধ নির্মাণ করা, বিবাহ বা মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সাহায্য সহযােগিতা করা প্রভৃতি।
(ii) সামাজিক রাজনৈতিক ভূমিকাঃ সামাজিক রাজনৈতিক ভূমিকা বলতে সেই ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজকে বুঝানাে হয়, যে কাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিকে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেয়া হয়। অর্থাৎ সামাজিক ব্যবস্থাপনা ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকাই হচ্ছে সামাজিক রাজনৈতিক ভূমিকা।
(৪) জৈবিক ভূমিকাঃ দৈহিক গঠনের কারণে নারী-পুরুষ জন্মগতভাবেই একটা অসম ভিত্তির ওপর অবস্থান করে। সেখানে নারী-পুরুষের বিভিন্ন জৈবিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নারী ও পুরুষ জন্মগত ও হরমােনগতভাবে আলাদা। অথচ আমাদের সমাজে পুরুষরা জৈবিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কারণ তাদের ধারণা নারীরা দূর্বল ও অসহায়। তারা পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। তাদের ধারণা সন্তান তাদের বীর্যের ফসল। আর নারীর কাজ হলাে সন্তান ধারণ, স্তন্যদান ও লালন-পালন।
(৫) মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকাঃ একজন মানুষ শুধু শারীরিকভাবে একজন মানুষ নয়। একজন মানুষ হচ্ছে শরীর ও মনের সমষ্টি। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়, মনস্তাত্বিকভাবে নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন ছেলে সন্তানের সামাজিকীকরণ হলে সে নারীর প্রতি বৈষম্য করাতেই দেখে, যা তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়। যার ফলে সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য পুরুষের কাছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়।
(৬) অর্থনৈতিক ভূমিকাঃ আমাদের দেশে সম্পত্তির মালিকানা থাকে পুরুষের হাতে। যার ফলে ভূমির ওপর নারীর কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় ভূমি বা জমির মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ পুরুষের হাতে। এ ছাড়া নারীকে গৃহস্থলির কাজে আটকে রাখা হয়। যার ফলে নারী কোনাে আয় করে না। ফলে পারিবারিক সিদ্ধান্তে নারীর কোনাে ভূমিকা থাকে না। তাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর যে ভূমিকা থাকা উচিত তা আমাদের সমাজে নেই।
(৭) রাজনৈতিক ভূমিকাঃ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হিংসাত্বক কার্যকলাপ ও বিশঙখলা জন্ম দেয়। সাধারণত সরকার ও বিরােধী দলের মধ্যে বিরােধপূর্ণ সম্পর্ক, নেতৃত্বের সংঘাত, দলীয় কোন্দল, সংখ্যালঘু সমস্যা ইত্যাদি সহনশীলতার অভাব সংগঠিত হয়। কিন্তু এসব রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর জেন্ডার ভূমিকা খুবই নগন্য।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নারীরা পূনঃউৎপাদনমূলক, উৎপাদনমূলক এবং সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ভমিকা পালন করে থাকে এবং পুরুষরা উৎপাদনমূলক ও সামাজিক রাজনৈতিক ভূমিকা এই দুই ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। তবুও সমাজে নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে।
Leave a comment