প্রশ্নঃ জেন্ডার অসমতা কী? উন্নয়নশীল দেশে জেন্ডার অসমতার কারণ আলােচনা কর।
অথবা, জেন্ডার অসমতা কী? উন্নয়নশীল দেশে জেন্ডার অসমতার কারণ বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ সভ্যতার শুরু থেকেই নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযােগী হিসেবে সমাজবিনির্মাণে অবদান রেখে আসছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় সব সমাজেই নারী ও পুরুষের মাঝে স্পষ্ট অসমতা বিদ্যমান। উন্নত-অনুন্নত, প্রাচ্য পাশ্চাত্য সব সমাজেই নারীকে অমূল্যায়ণ করা হয় যা অনুচিৎ। মানবজাতির অর্ধেক যেহেতু নারী-সেহেতু নারীদের অধিকার বঞ্চিত রেখে কোনাে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই কাঙ্খিত উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা বিধান অপরিহার্য।

লিঙ্গভিত্তিক অসমতা সংজ্ঞাঃ লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলতে ঐ ধরনের অসমতাকে বুঝায়, যেখানে জেন্ডার বা লিঙ্গের কারণে একই সমাজ বা রাষ্ট্রে বসবাসকারি নারী ও পুরুষের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অসমতাসহ জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সেখানে লিঙ্গকেই অধিকার ভােগ ও ভূমিকা পালনের মূল মানদন্ড ধরা হয়। অর্থাৎ লিঙ্গের ওপর ভিত্তি করে যে অসমতা, এক কথায় তাকে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলে। যা মূলত নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্যকেই বুঝায়। যা লিঙ্গভিত্তিক অসমতার কারণ ও পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা হওয়ার কারণে আমাদের দেশে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে নারীরা পুরুষের অর্ধাংশ হওয়ার সত্ত্বে উন্নয়নে তাদের কার্যকরি ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। লিঙ্গভিত্তিক অসমতা থেকে বেরি আসতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটাতে হবে। নারীকে নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার মানষিকতা তৈরি করতে হবে। তাহলেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা করা সম্ভব হবে। নিম্নে লিঙ্গভিত্তিক অসমতার কারণগুলাে বর্ণনা করা হলাে:

(১) জৈবিক কারণঃ দৈহিক গঠনের কারণে নারী-পুরুষ জন্মগতভাবেই একটা অসম ভিত্তির ওপর অবস্থান করে । যেখানে নারী-পুরুষের বিভিন্ন জৈবিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নারী ও পুরুষ জন্মগত ও হরমােনগতভাবে আলাদা। অথচ আমাদের সমাজে পুরুষরা জৈবিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কারণ তাদের ধারণা নারীরা, দুর্বল, অসহায়। তারা পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। তাদের ধারণা সন্তান তাদের বীর্যের ফসল। কারণ নারীর কাজ হলাে সন্তান ধারণ, স্তন্যদান ও লালন-পালন।

(২) মনস্তাত্ত্বিক কারণঃ একজন মানুষ শুধু শারীরিকভাবে একজন মানুষ নয়। একজন মানুষ হচ্ছে শরীর ও মনের সমষ্টি। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন ছেলে সন্তানের সামাজিকীকরণ হলে সে নারীর প্রতি বৈষম্য করাই দেখে যা তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়। যার ফলে সমাজে একজন পুরুষের কাছে মনঃস্তাত্ত্বিকভাবে একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়।

(৩) সামাজিক কারণঃ সামাজিকভাবে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বিদ্যমান। কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হওয়ার কারণে ২ নারীর ইচ্ছাকে কোনাে মূল্য দেয়া হয় না। এ অবস্থায় নারী হয় অবহেলিত যার ফলে সামাজিকভাবে সে থাকে পিছিয়ে। যেখানে নারীর কোনাে সামাজিক নিরাপত্তা থাকে না। তা ছাড়া সামাজিকভাবে লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন হওয়ায় নারীরা স্বাবলম্বি হতে পারে না।

(৪) দৈহিক গঠনঃ দৈহিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে দূর্বলভাবে। যার ফলে দেখা যায়, একই কাজ ও পরিশ্রম করে নারীরা পুরুষ অপেক্ষা কম মজুরি পায়। তা ছাড়া নারীরা দূর্বল বলে অনেকক্ষেত্রে তাদেরকে কাজ করতে দেয়া হয় না। অথচ তারা তা করতে সক্ষম। তাই দৈহিক গঠন লিঙ্গভিত্তিক অসমতার অন্যতম প্রধান কারণ।

(৫) মানসিক কারণঃ মানসিকভাবে নারীরাও নিজেদেরকে পুরুষের থেকে দূর্বল ভাবে। ফলে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে পিছিয়ে রাখে এবং হীনমন্যতায় ভােগে। যা মানসিক দিক দিয়ে পুরুষদেরকে সামনে নিয়ে যায় এবং নারীদেরকে বৈষম্যের মুখে ফেলে দেয়। ফলে মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণে নারীরা লিঙ্গভিত্তিক অসমতার শিকার হচ্ছে।

(৬) অর্থনৈতিক কারণঃ আমাদের দেশে সম্পত্তির মালিকানা থাকে পুরুষের হাতে। যার ফলে ভূমির ওপর নারীর কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ভূমি বা জমির মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ পুরুষের হাতে। তা ছাড়া নারীকে গৃহস্থলির কাজে আটকে রাখা হয়। যার ফলে নারী কোনাে আয় করে না। ফলে পারিবারিক সিদ্ধান্তে নারীর কোনাে ভূমিকা থাকে না। তাই অর্থনৈতিক কারণ লিঙ্গভিত্তিক অসমতার অন্যতম প্রধান কারণ। নিম্নে দুটি কারণ তুলে ধরা হলাে:

(ক) সম্পত্তির মালিকানাহীনতাঃ ক্ষমতায়ন অর্থ সম্পত্তিসহ অন্যান্য বিষয়ে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন। অথচ সম্পত্তিতে নারীর নিয়ন্ত্রণতাে দূরের কথা নারী সম্পত্তি অধিকারটুকুও বুঝে পায় না। কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সম্পদের মালিকানা এবং উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয় পুরুষের দিক থেকে।

(খ) কর্মসংস্থানের অভাবঃ বাংলাদেশে অন্যান্য সমস্যার ন্যায় বেকার সমস্যাও বিদ্যমান। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব নারীকে ক্ষমতাহীন করে। তা ছাড়া সমাজ নারীদের গৃহস্থালী কাজকে বেশি প্রাধান্য দেয়ায় নারীর জন্য কর্মের সংস্থান করা হয় খুব কমই । উপরন্তু নারীরা যেসকল কাজ করে থাকে তা মূলত পারিশ্রমিকবিহীন এবং তা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত।

(৭) রাজনৈতিক কারণঃ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। যার কারণে নারীরা রাজনৈতিকভাবে লিঙ্গভিত্তিক অসমতার শিকার। এ ছাড়া রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ, স্বাধীন ভােটদানে বাধা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারীর নিম্ন অংশগ্রহণ ইত্যাদি এ অসমতার অন্যতম প্রধান কারণ। রাজনৈতিক কারণকে নিম্নে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:

(ক) পুরুষ প্রাধান্য রাজনীতিঃ বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বই মনে করে পুরুষদের কাজের ক্ষেত্র ঘরের বাইরে। আর উপযুক্ত ক্ষেত্র হলাে রাজনীতি। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবােধের কারণেই রাজনীতিতে পুরুষের অংশগ্রহণ অধিক। পুরুষ প্রাধান্যের কারণে রাজনীতিতে নারী অংশগ্রহণ কম এবং নারী বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু উপেক্ষিত হয়।

(খ) রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নঃ রাজনীতিতে পেশিশক্তি, কালাে টাকার ব্যবহার প্রভৃতির কারণে রাজনৈতিক অঙ্গন কলুষিত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া রাজনীতিতে সীমাহীন, দুর্নীতি এবং অবৈধ প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে রাজনীতিতে নারীরা অংশগ্রহণ করতে অনাগ্রহী হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায়নের সর্বোচ্চ স্তরে নারীর অংশগ্রহণ নিম্ন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দুর্বত্তায়ণই লিঙ্গবৈষম্যবাদের অন্যতম প্রধান কারণ।

(৮) সংস্কৃতিক কারণঃ আমাদের দেশে নারীর প্রতি যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তা অনুকূল নয়। কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মূল্যবােধকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষরা। তাই পুরুষ কর্তৃক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি ও পরিচালিত হওয়ায় তা নারীর ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক অসমতার সৃষ্টি করেছে যা লিঙ্গভিত্তিক অসমতার অন্যতম কারণ।

(৯) ধর্মীয় কারণঃ আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ মুসলমান বসবাস করে। যাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত যাদের তেমন কোনাে ধর্মীয় জ্ঞানও নেই। ফলে তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করার মাধ্যমে নারীকে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে রাখে, যা সকল দিকে নারীকে লিঙ্গভিত্তিক অসমতার সম্মুখীন করে। তাই লিঙ্গভিত্তিক অসমতার ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা মূখ্য নয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যেখানে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমগ্র বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে লিঙ্গভিত্তিক অসমতার কারণে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে। তাই লিঙ্গভিত্তিক অসমতাকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে, যদি আমরা কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীরা আমাদেরই মা-বােন অথবা স্ত্রী, যারা আমাদের অপরিহার্য অঙ্গ। তাদের পেছনে ফেলে কোনাে উন্নয়নই সম্ভবপর নয়।