“স্বপ্ন মতির অফুরন্ত।”—মতির বাবার নাম কী? উদ্ধৃত উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।

মতি হারু ঘোষের মেয়ে।

হারু মতির জন্য বাজিতপুরে পাত্র দেখতে গিয়ে এক দুর্দৈবের সন্ধ্যায় বজ্রের আঘাতে আহত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। গাওদিয়ার গোপসমাজের মেয়ে মতি। সমাজের সংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশে অনূঢ়া কন্যা নানা দিক থেকে প্রশ্ন ও সমস্যার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তাই তার ভাল বিয়ের কথা ভেবে হারু ঘোষ বাজিতপুর গিয়েছিল। পরাণ মতির ভাই, অগ্রজ, কুসুমের স্বামী। কুসুম মতিকে ঈর্ষা করত। শশী ডাক্তার মতির প্রতি ছিল স্নেহপরায়ণ। এই নিয়ে পরিবারে ছিল সূক্ষ্ম চোরাস্রোত। প্রতিবেশী নিতাই সুদেবের সঙ্গে মতির বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পরাণ তা মেনে নিতে চায় না। হারুর মৃত্যুর পর পরাণ দমে গেছে। কুসুমের সঙ্গে মতির সম্পর্কে একটা রেষারেষি থাকে। এই সব পরিবেশে মতির দিন কাটে। মতির জীবনে অনেক বাসনা। শশী তাকে ম্যালেরিয়া থেকে ভালো করে তুলেছে। তাই শশী তার কাছে দেবতার মতো। শশী অন্য সমাজের মানুষ। মতির কাছে অন্য গ্রহের নক্ষত্র। মতির স্বপ্নের জগতে শশী নায়ক। মতির স্বপ্নের শেষ নেই। তার কৈশোরের চাপল্য কাটে এই রূপকথার স্বপ্নলোক যাত্রার মধ্য দিয়ে। তালপুকুরের ধারে সে আলস্য ভোগ করতে করতে স্বপ্ন দেখে। সুদেবকে তার পছন্দ নয়, তাই সে সুদেবকে তার স্বপ্নের কাছেও ঘেঁষতে দেয় না। মতির ইচ্ছে বড়লোকের বাড়িতে তার বিবাহ হয়। যে সংসারে কাজ নেই, বকাঝকা নেই, বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, সুমিষ্ট ভাষায় কথা বলে, তাসপাশা খেলে, কলের গান বাজায়, বাড়ির বৌকে কেবল তারা আদর করে। আদর করে তারা বৌকে লক্ষ্মী বৌ, সোনা বৌ, বাড়ি-আলো করা বৌ বলে ডাকে। তার বরটা কিন্তু যেন হয় শশীর মতো। ঝলমলে গয়না পরে, ঝকঝকে শাড়ী পরে, ঘোমটার আড়ালে চন্দনচর্চিত মুখখানা লজ্জারঙীন হয়ে শোভা পাচ্ছে। এমন একটা ছবি মতি স্বপ্ন দিয়ে এঁকে রচনা করে। মতির অশেষ স্বপ্ন তার অনাগত দিনগুলোর জন্য পড়ে আছে। তালপুকুরের ধারে প্রকৃতির মহোৎসব চলে। সেই উৎসব থেকে বাড়ী ফেরার পথে মতির মনে হয় সুদেব ব্যাটা মরে যাক। মতি শুধুই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে সুখী সংসারের, যে সংসারে আছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশানা। মতির কিশোরী-মানসে এই সুখের স্মৃতির কোনো শেষ নেই। সুখকল্পনায় মতি বিভোর বলেই স্বপ্ন অফুরন্ত।

“জীবনে যে যত পুণ্য অর্জন করিয়াছে, তার পাপের হিসাবটা আজ এখনকার মতো ধারায় তালবনের গভীর নির্জনতায় হঠাৎ তাহার পুরস্কার কে দিল মানুষের বুদ্ধিতে তাহার বিশ্লেষণ নাই।”—কার কথা বলা হয়েছে? উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

এখানে শশীর বন্ধু কুমুদের কথা বলা হয়েছে।

হারু ঘোষের বাড়ির পেছনে তালবন। তালবনের উঁচু টিলার দিকে তাকালে সংসারের পাপ-পুণ্যের একটা অপার্থিব হিসাব মনে আসে। কুমুদ শশীর বন্ধু। সে গাওদিয়ার ছেলে। শশীর সঙ্গে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছে, তারপর গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে কাজের সন্ধানে এসে নানা বৈচিত্র্যময় জীবনের স্বাদ পেতে থাকে। তারপর বিনোদিনী অপেরা-পার্টির একজন অভিনেতা হয়ে আবার গাওদিয়া গ্রামে এসে বাল্যস্মৃতির রুদ্ধদ্বার খুলে শশীর সঙ্গে হৃদয়াবেগ-বিনিময়ে। শশীর বাড়িতে আমন্ত্রণ পেয়ে পারিবারিক আবহাওয়ায় সে মুগ্ধ হয়েছে। সকলের পরিচয় জানতে সে কৌতূহলী। সকলের কাছে সে যেতে চায়। কিন্তু গ্রামের সরল মানুষও তাকে দেখে পর্দার আড়াল দিয়েছে। এই ঘটনা তাকে দুঃখিত করেছে। শশীর ঘরে এসে তার সাজানো ঘর দেখে সে মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু পর্দা প্রথার আড়ালে শশীর বাড়ির মেয়েদের গতিবিধি দেখে সে মনে মনে সংসারী হবার বাসনা পোষণ করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ একটা ছেলে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দেওয়ায় সে আহত হয়। একটা পরিবারের গোপন স্পন্দন দেখে ফেলার অপরাধ তাকে পীড়িত করতে থাকে। সে জামা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হারু ঘোষের বাড়ির পেছনে ভালবনের মাটির টিলাটির দিকে সে হাঁটতে আরম্ভ করে। এই নির্জন পরিবেশে এসে পাপ-পুণ্যের হিসাব করতে করতে সে ভাবে যে শশীর বাড়ির অন্তঃপুরের অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে এক সংসার জীবনে ফিরে যাবার পুরস্কার। এই আহ্বান তার ছন্নছাড়া জীবনের পুরস্কার। শশীর বাড়ির লোকেরা যে লাঞ্ছনা তাকে দিয়েছিল, তার ক্ষতিপুরণ হিসেবে এই অপূর্ব পরিবেশে সে শান্তি লাভ করল। পাখির কলরব মুখরিত, দীর্ঘ তালগাছ-বেষ্টিত প্রকৃতির পরিবেশে সে এক জীবনের সন্ধান পেয়েছিল। ভাবপ্রবণ কুমুদ, সেন্টিমেন্টাল কুমুদ সুখী পরিবারের অন্তঃপুর দেখে এইভাবেই ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। তার জীবনে পুণ্যার্জনের পুরস্কার হিসেবে সাময়িক সুখের অনুভূতি তার জীবনের পুরস্কার। ভালবনের নির্জন পরিবেশে এই পুরস্কার পেয়ে সে গর্বিত হয়। মানুষ বুদ্ধি দিয়ে এই হঠাৎ-প্রাপ্তির ব্যাখ্যা করতে পারে না।