কবির জীবনের আশা যে পূর্ণ হয়নি, প্রথম স্তবকেই কবি তা জানিয়েছেন— 

‘এত কালো মেখেছি দু হাতে

এত কাল ধরে

কখনো তোমার করে, তোমাকে ভাবি নি।,

জীবনটাকে কবি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটি হয়তো পাননি। ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই/যাহা পাই তাহা চাই না : মানবজীবনের এটাই চিরন্তন ট্র্যাজেডি। মানুষ চায় এক, হয় আর এক। ক্ষুদ্র স্বার্থ পূরণের জন্য মানুষ কত অন্যায়, কত অত্যাচার, কত অবিচারই না করে। আত্মকেন্দ্রিকতা বা অহং চেতনার বাইরে মানুষ তখন নিজেকে নিয়ে অন্য কিছু আর ভাবতে চায় না। অথচ সে ভুলে যায়, মানব জীবন একটা হাট ছাড়া আর কিছু নয়—

‘নূতন করিয়া বসা আর ভাঙা

পুরানো হাটের মেলা;

দিবস রাত্রি নূতন যাত্রী

নিত্য নাটের খেলা!

খোলা আছে হাট মুক্ত বাতাসে

বাঁধা নাই ওগো যে যায় যে আসে, 

কেহ কাঁদে, কেহ গাঁটে কড়ি বাঁধে

ঘরে ফিরিবার বেলা।

উদার আকাশে মুক্ত বাতাসে

চিরকাল একই খেলা! (হাট / যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত)

সংসারে আবর্তিত মানুষের মন সর্বদা আত্মকেন্দ্রিকতার দিকেই ছুট কাটিয়ে নিয়ে যায় ৷ বড়, গাড়ি, সুন্দরী, স্ত্রী, ঘুষ, জালিয়াতি, এইসবই তখন স্বর্গ মনে হয়। বিদ্যাপতি বলেছেন—

‘আধ জনম হাম    নিদে গোঙায়লু

জরা শিশু কতদিন গেলা। 

নিধুবনে রমণী     রসরঙ্গে মাতলু

তোহে ভজব কোন বেলা ।

জীবনানন্দ দাশ ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতায় লিখেছেন—

‘দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা 

পথে-ঘাটে ট্রাক ট্রামলাইনে ফুটপাতে ; 

কোথাও পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে-মনে হয়, 

জলের মতন দামে।

সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছুবে

সকলের আগে সকলেই তাই।

অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়, তবু

নিলেমের ঘরবাড়ি আসবার অথবা যা সকলের জন্যে নয়

সে-সব জিনিস 

বহুকে বঞ্চিত করে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে। 

পৃথিবীতে সুদ খাটে, সকলের জন্যে নয়। 

অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দু জনের হাতে। 

পৃথিবীর এইসব উঁচু লোকদের দাবি এসে 

সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।

যাদের আছে তাদের সব আছে, যাদের নেই তাদের কিছু নেই। ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষকে কবি পশুর মতো জীবনধারণ করতে দেখেছেন। বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘বহু শতাব্দী ধরে জনসাধারণকে শুধু শেখানো হয়েছে তারা ছোটো, তাদের বলা হয়েছে তারা কেউ নয়, বিশ্বের সমস্ত জনসাধারণকেই বলা হয়েছে যে তারা মনুষ্য-পদবাচ্য নয়। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শত শত বৎসর জীবনযাপন করে তারা অজ্ঞ পশুর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মানুষকে কেন্দ্র করে বণিকতন্ত্রের লোভের সীমা-পরিসীমা নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘প্রভু সমস্ত আপনার জন্য লইবে, দাস সমস্তই প্রভুর জন্য ভোগাইবে যার জোর আছে সে রথ হাঁকাইবে, যার জোর নেই সে পথ করিয়া দিবে। ভোগই জীবনের বড়ো কথা হয়ে উঠলো। কিন্তু অনেকে আছেন যারা ভোগের সব উপকরণ পেয়েও খুশি হতে পারেননি। জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার নায়কের আর্থিক স্বচ্ছলতা, সুন্দরী বধূ, সন্তান, ভোগের সব উপকরণ ছিল, তবু তিনি আত্মহত্যা করেছেন মানবজীবনকে তিনি কীট-পতঙ্গের জীবন বলে ভাবতে পারেননি। সেই নায়কের দাম্পত্য কিংবা জীবনের মাধুর্য অপূর্ণ থাকেনি। তথাপি সব থেকেও তিনি কিছু পাননি—

জানি—তবু জানি 

নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ নয় সবখানি 

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়-

আরো এক বিপন্ন বিস্ময় 

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে 

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্তি করে।

ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;

এই ক্লান্তি আর মনকে যন্ত্রণায় যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছিল। সুতরাং আর্থিক সচ্ছলতা বা ভোগবাদী জীবন সকলকে সুখী করতে পারে না। কবিকেও পারেনি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে লিখেছেন—

‘চরণ ধরিতে দিয়ে গো আমারে, নিওনা নিওনা সরায়ে।

জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।।

তথাপি শক্তি জীবনকে বাদ দিয়ে মুক্তির কথা চিন্তা করতে পারেন না। শঙ্করাচার্যের মতো তিনি ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, একথা কল্পনা করতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথের মতো শক্তিও মনে করেন মানুষের জীবনলীলা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে ঈশ্বর পরিব্যাপ্ত—বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যিনি সর্বজগদ্‌গত ভূমা তাকে উপলব্ধি করবার সাধনায় এমন উপদেশ পাওয়া যায় যে, লোকালয় ত্যাগ করো, গুহাগহ্বরে যাও নিজের সত্তাসীমাকে বিলুপ্ত করে অসীমে অন্তর্হিত হও। এই সাধনা সম্পর্কে কোনো কথা বলবার অধিকার আমার নেই। অন্তত আমার মন যে-সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে—তিনি নিখিল মানবের আত্মা। তাকে সম্পূর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে কোনো অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন, তবে সে কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই। কেননা আমার কল্পনা মানব কল্পনা, আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানব বুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তা মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে যাকে উপলব্ধি করি তিনি ভূমা, কিন্তু মানবিক ভূমা। তার বাইরে অন্য কিছু থাকা বা না থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন। শক্তিও মানুষকে বিলুপ্ত করে মানুষের মুক্তি চান নি। তাই সন্তানের মুখ ধরে চুমু খাওয়া শক্তির কাছে বড়ো কথা হয়ে উঠেছে। তাঁর জীবনের যা কিছু সঞ্চয় সন্তানকে দিয়ে ধন্য হয়ে উঠতে চেয়েছেন। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই কবি তখন স্বর্গসুখ উপভোগ করেন—

‘কত যে যুগ-যুগান্তরের পুণ্যে

জন্মেছি আজ মাটির পরে ধূলা মাটির মানুষ।

স্বৰ্গ আজি কৃতা তাই আমার দেহে, 

আমার প্রেমে, আমার স্নেহে

আমার ব্যাকুল বুকে,

আমার সজ্জা আমার লজ্জা, আমার দুঃখে, সুখে।…

স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটি মায়ের কোলে, 

বাতাসে সেই খবর ছোটে আনন্দ কল্লোলে। (রবীন্দ্রনাথ)

জীবনকে সত্যরূপে গ্রহণ করে সন্তানের মধ্যে জীবনের প্রেম ভালোবাসাকে রক্ষা করে শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবনকে সার্থক করে তুলতে চেয়েছেন। তাই চিতাকাঠ ডাকলেও কবির সেদিকে যাবার সময় নেই। ‘চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়’। কবি তাঁর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই দেখেছেন চাঁদকে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই কবি ভুলেছেন, জীবনের সব গ্লানিমাকে—

‘একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো-

দেখবে, নদীর ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে 

পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল

নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো। (একবার তুমি)