রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার জটিলতম এবং দুর্বোধ্যতম কবি সম্ভবত জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক যুগ ও জীবনের বহুমাত্রিক জটিলতা এবং তারই বিপরীতে পৃথিবীর কল্যাণকামী সংবেদনশীল কবিমনের সংঘাত জীবনানন্দের কবিতাকে জটিল ও দুর্বোধ্য করেছে। কিন্তু কবিস্বভাবকে পূর্বাপর অনুধাবন করতে পারলে সেই জটিল দুর্বোধ্যপ্রায় অনুভবের অন্তর্গত মর্মকথাটিকে মোটামুটি বুঝে নেওয়া পাঠকের পক্ষে হয়ত অসম্ভব নয়।
‘সুচেতনা’ কবিতাটি ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। ‘বনলতা সেন’ নামক নাম-কবিতাটিতেই কবি জীবনের বন্ধুর পথে ক্লান্ত হয়ে নির্জন দারুচিনি দ্বীপের ছায়ায় নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের আশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। ‘বনলতা সেন’ সে দিক থেকে হয়ত প্রেমের কবিতা। আবার প্রেমের কবিতার রূপে সেটি হয়ত কবির জীবনদর্শনেরও কবিতা হতে পারে। অস্থির ক্লান্ত জীবনে কল্যাণকামী জীবনের আর্তিই হয়ত ‘বনলতা সেন’-এর মূল কথা। আর এই প্রেক্ষিতেই আমাদের দেখতে হবে ‘সুচেতনা’ কবিতাটিকেও।
‘সুচেতনা’ সম্বোধনে কবিতাটির সূচনা। আর প্রথম স্তবকের সমাপ্তির উচ্চারণ-“তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।” এখানেও সেই ‘দ্বীপ’ এবং ‘দারুচিনি-বনানী’-র নির্জনতার ঘন ছায়া। ফলে মনে হতেই পারে, ‘সুচেতনা’ কবিতাটিও আসলে একটি প্রেমেরই কবিতা। জীবনের সফেন সমুদ্রে দিগ্ভ্রান্ত ক্লান্ত হতাশ্বাস নাবিকের মতোই ‘সুচেতনা’ কবিতায় ‘পৃথিবীর রণ-রক্ত-সফলতার অতি ব্যস্ততায় কবি ক্লান্ত। আর সেই ক্লান্তি ও উদ্বেগের মুহূর্তেই যেন সুস্থ প্রেমময় জীবনের আশ্বাস খুঁজে পাওয়া যায় বনলতা কিংবা সুচেতনার সান্নিধ্যে।
কিন্তু ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির আদ্যোপান্ত যে স্নিগ্ধ প্রেমের স্পর্শ আছে, ‘সুচেতনা’ কবিতায় সেই প্রেমচিহ্ন কেবলমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে প্রথম স্তবকটিতে। ফলে খুব নিশ্চিতভাবে খোলামনে কবিতাটিকে প্রেমের কবিতা হিসাবে গ্রহণ করতেও সংশয় জাগে। এজন্যই জনৈক আলোচক মন্তব্য করেছেন—“সুচেতনা এমনই দ্বিস্তরিক কবিতা, যেখানে ব্যক্তি প্রেমের আবেগ ও বোধি মিশে গেছে। আবার সেইসঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র বিষয়ে কবির গভীর ভাবনা, উদ্বেগ, আশাবাদ ধ্বনিত হয়েছে।”
সুচেতনা কবিমনের প্রার্থিত প্রেমময়ী নারীই হোক অথবা কবির প্রার্থিত জীবনছন্দই হোক, আলোচ্য কবিতায় তাকে বলা হয়েছে ‘দূরতর দ্বীপ’। অর্থাৎ কবির যুদ্ধপীড়িত সমকাল, সভ্যতার বাহ্য সম্পদে ভরে ওঠা সময় মানুষের মন থেকে অপ্রয়োজনবোধে ছিঁড়ে নিয়েছে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার মতো সুকুমার বৃত্তিগুলি। সেই নষ্ট সময়ে সুচেতনার মতো স্নিগ্ধতাময়ী নারী তথা মানবিক শ্রেয় ‘দূরতম দ্বীপ’-এর মতোই প্রায় অপ্রাপনীয়। কবির মনে সভ্যতার বাহ্য অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো আপত্তি নেই।
পৃথিবীর ‘রণ রক্ত সফলতা’-র ক্রমাগত প্রয়াসের মধ্য দিয়েই মানুষ গড়ে তোলে সভ্যতার পথ। এই পথ ধরেই কবির কর্মক্ষেত্র নগর কলকাতাও হয়তো একদিন ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। কিন্তু এই বাহ্য অগ্রগতি কবির কাছে ‘সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।’ কবির কাছে শেষ সত্য হয়তো মানবতা, সুস্থতা, মানবিক ভালোবাসার অনুকূল নির্জন স্নিগ্ধতা, কবির হৃদয়ে সেই স্বপ্ন নিবিড়ভাবে লগ্ন থাকে বলেই তিনি পৃথিবী বা কলকাতার উন্নয়নের যাবতীয় উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডকে অস্বীকার না করেও বলেন, সুচেতনাই তাঁর কাঙ্ক্ষিত—“তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।”
এবার কবি উচ্চারণ করেন তাঁর নষ্ট সময়ের যন্ত্রণাদায়ক কিছু অভিজ্ঞতা। সভ্যতার রূঢ় পথে রৌদ্রের তাপে দগ্ধ হয়ে চলতে চলতে মানুষকে ভালোবাসতে গিয়েও কবি দেখেন অমানবিক হিংসা, ঈর্ষা, পারস্পরিক প্রেমহীনতার অসংখ্য দৃষ্টান্ত। দেখেন তাঁর নিজেরই হাতে হয়তো নিহত পরিজন-আত্মীয়। অর্থাৎ সভ্যতা লক্ষচ্যুত, পথভ্রষ্ট। পৃথিবী প্রেমহীনতার ব্যাধিতে আক্রান্ত—“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।”
তবু জীবনানন্দ আধুনিক কবিদের অধিকাংশের মতো নৈরাশ্যপীড়িত নন। অদ্ভুত এক সদর্থক মানবিক বিশ্বাসে তিনি স্থিত থাকতে চান। কেননা এই বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যেও তিনি অধিকার করেন—“মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”
কবি সভ্যতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে এরপর বন্দরে জাহাজ আসার চিত্রকল্প রচনা করেন। সমুদ্রপার বা পাশ্চাত্যের সভ্যতার অনুপ্রবেশের কথা বলেন হয়তো। সেই সমুদ্রপার থেকে আসা জাহাজগুলো যে শস্য নিয়ে আসে আমাদের প্রাচ্যের বন্দরে, আশ্চর্য তাকে কবি বলেন ‘অগণন মানুষের শব’। অর্থাৎ এই আধুনিক সভ্যতা হয়তো আমাদের মধ্যযুগীয় অন্ধকার দূর করে আধুনিকতা দিয়েছে অনেকখানি, কিন্তু তা কেড়ে নিল অনেক মানুষের প্রাণ। ঔপনিবেশিক লোভ আর অমানবিক কপটতার দ্বারা ধর্ষিত হল শান্তি, উচ্ছিন্ন হল প্রেমময় স্নিগ্ধতা, নষ্ট হল জীবন। প্রাচ্যভূমিতে বহুকাল থেকে বুদ্ধ বা কনফুশিয়াসের মতো যে-সব মনীষীরা—যাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন, প্রচার করেছেন, তাঁরা এই আধুনিক সভ্যতার পটভূমিতে তাঁরা মুক নির্বাক। কেননা অন্য এক কবিতাতে জীবনানন্দ বলেছেন—
“যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই–করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।”
এই সব অন্ধ মানবতাহীন লোভী মানুষেরাই আজ পৃথিবীর পরিচালকের পদে আসীন। ফলে বুদ্ধ, কনফুশিয়াসরা যেমন কালের ব্যবধানে নির্বাক, আজকের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানবতাবাদী কল্যাণকামী মানুষেরাও সেই-সব ধূর্ত কপট লোভী মানুষদের দাপটে মূক, বাক্যহীন। কিন্তু আবারও কবি নৈরাশ্যের অন্ধকার ভেদ করে উচ্চারণ করেন আলোর মন্ত্র —“তবু চারিদিকে রক্ত ক্লান্ত কাজের আহ্বান।”
মানুষের এই ক্রমাগত কল্যাণবাসনা, বহু লক্ষ মনীষীর যুগযুগান্তরের প্রয়াসের পথেই “পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে” বলে কবির বিশ্বাস। প্রতিকূল পরিবেশে হয়তো সেই সাধনা ও উচ্চারণকে সাময়িকভাবে মূক হতে হয়, কিন্তু এই শুভ বোধ মানুষের ভিতরে জায়মান। মানবসভ্যতা এখনও হয়তো শ্রেয়কে খুঁজে পায়নি, বা খুঁজতে গিয়ে পথভ্রষ্ট, তবু কবি বিশ্বাস করেন একদিন সেই উত্তরণ ঘটবেই। যদিও সেই আবিষ্ট “অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ” এবং সেই প্রার্থিত শুভ লগ্ন আসবে—“আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।”
‘ঢের দূর’ হলেও সেই নির্মল প্রভাত আসবে একদিন, এই সুস্থিত বিশ্বাসই কবিতাটির প্রধান মর্মকথা। ‘দূরতর দ্বীপ’ হয়েও সেই ‘সুচেতনা’ যেমন কবির হৃদয়ের আবিষ্ট, তেমনি সেই শুভ সমাজও ‘ঢের দূর’ হলেও কবির মানবযাত্রার লক্ষ্য। আধুনিক যুগের ক্লান্তি, নৈরাশ্য, মৃত্যু কামনাকে অতিক্রম করে এক পরম বিশ্বাস ও কালগত চিরন্তন সত্যে আস্থাই কবির ‘সুচেতনা’ কবিতার মূল কথা— “শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।”
Leave a comment