দিল্লির সুলতানি শাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সুলতান নানান দৃঢ় রাজতান্ত্রিক বা নরপতিত্বের আদর্শ গ্রহণ করেন। মূলত ইলতুৎমিস, গিয়াসউদ্দিন বলবন, আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ বিন তুঘলক সুলতানি নরপতিত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন।

[1] ইলতুৎমিস: ইলতুৎমিস দিল্লির সুলতানি শাসনকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি মধ্য এশিয়ার গজনি ও ঘুর রাজ্যের প্রভাব মুক্ত করে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে একটি সার্বভৌম শক্তি হিসেবে গড়ে তােলেন। তিনি ‘মুইজি’ ও কুতবি’ নামে আমলাদের সরিয়ে দাস-তুর্কি, স্বাধীন তুর্কি ও স্থানীয় হিন্দুদের নিয়ে নতুন আমলাতন্ত্র গড়ে তােলেন এবং শাসনকার্যে অভিজাতদের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করেন। তিনি সিংহাসনের মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বাগদাদের খলিফার কাছ থেকে ‘সুলতান ই-আজম’ উপাধি গ্রহণ করেন (১২২৯ খ্রি.)।

[2] বলবন: বলবন মনে করতেন যে, চরম স্বৈরতন্ত্রের দ্বারাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও প্রজাদের আনুগত্য আদায় করা সম্ভব। তাই তিনি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ঘােষণা করেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা অপছন্দ করতেন এবং বংশকৌলীন্য অনুযায়ী দেশে সরকারি কাজে কর্মী নিয়ােগ করতেন। তিনি রাজদরবারে নতুন পারসিক আদবকায়দার প্রচলন করেন।

[3] আলাউদ্দিন খলজি: আলাউদ্দিন খলজি সুলতানের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও রাজার ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষের চেয়ে অধিক জ্ঞানী বলে মনে করতেন। তার ইচ্ছাই ছিল আইন। তিনি রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করেন এবং প্রশাসনে। অভিজাত ও উলেমাদের প্রভাব খর্ব করে রাজতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন।

[4] মহম্মদ বিন তুঘলক: মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ভারতের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ঐক্য স্থাপন। এই উদ্দেশ্যে তিনি দাক্ষিণাত্যে মুসলিম সংস্কৃতির প্রসারেও নজর দেন। তিনি বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হন। তিনি তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান। অভিজাতদের ক্ষমতা খর্ব করে এক নতুন অভিজাত গােষ্ঠী তৈরি করেন।

দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি কীরূপ ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ড. এ. এল. শ্রীবাস্তব, ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ, ড. রামশরণ শর্মা প্রমুখ মনে করেন যে, দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ধর্মাশ্রয়ী। অন্যদিকে, সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনি দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে জাহান্দারি বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ বলে অভিহিত করেছেন। ড. সতীশ চন্দ্র, ড. মহম্মদ হাবিব প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিক এই অভিমত সমর্থন করেন।

[1] ধর্মাশ্রয়ী বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি:

  • খলিফার প্রতি আনুগত্য: আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া দিল্লির সব সুলতানই ইসলামি জগতের শাসক ও ধর্মগুরু খলিফার স্বীকৃতি গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য জানিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।

  • উলেমা ও শরিয়তের গুরত্ব: সুলতানি শাসনে উলেমাদের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল। ইসলামি আইন শরিয়তের ব্যাখ্যাকর্তা এই উলেমারা আশা করতেন যে, সুলতান অমুসলিমদের বিনাশসাধনে উদ্যোগ নেবেন এবং শরিয়তের বিধান মেনে ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলাম অর্থাৎ ইসলামের পবিত্র ভূমিতে পরিণত করবেন।

  • হিন্দুদের উপেক্ষা: সুলতানি রাষ্ট্রে অমুসলিম হিন্দুরা উপেক্ষিত ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছিল। তারা ‘জিম্মি হিসেবে গণ্য হত এবং তাদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হত।

[2] ধর্মনিরপেক্ষ বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি:

  • পৃথক রাজতন্ত্র: শরিয়তের বিধান অনুসারে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। তার প্রতিনিধি হলেন প্রথমে হজরত মহম্মদ এবং পরে খলিফা। কিন্তু ভারতের সুলতানি রাষ্ট্রে এই নিয়ম থেকে স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল।

  • খলিফার প্রতি আপাত আনুগত্য: কোনাে কোনাে সুলতান রাজনৈতিক প্রয়ােজনে খলিফার অনুমতি নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিল একান্তই সুলতানের ইচ্ছাধীন বিষয়।

  • সুলতানের স্বাধীনতা: ইসলামি আইন অনুসারে খলিফা সমগ্র মুসলিম ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রধান হলেও ভারতে এই রীতি গুরত্ব পায়নি। এখানে সুলতানগণ খলিফার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে শাসন চালাতে পারতেন।

  • হিন্দুদের গুরত্ব: সুলতানি আমলে হিন্দুদের গুরুত্ব একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি। তখন বহু হিন্দু উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত হতেন এবং দেশের নানা স্থানে বহু হিন্দু সামন্ত রাজ্যের অস্তিত্বও ছিল।

  • উলেমাদের সুলতান-নির্ভরতা: সুলতানি আমলে উলেমারা সুলতানদের প্রভাবিত করতে পারতেন না, বরং বাস্তবে উলেমারা সুলতানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কাজ করতেন।

  • ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র: উপরােক্ত বিভিন্ন যুক্তির নিরিখে অধিকাংশ পণ্ডিত সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলেই অভিহিত করেন।

তাই রাষ্ট্ররূপে দিল্লি সুলতানির প্রকৃতি নির্বাচন করা কিছুটা কঠিন, কারণ ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মনিরপেক্ষ এই দুই ধরনের রাজতান্ত্রিক প্রবৃত্তিই দেখা গেছে এর মধ্যে। রাজনৈতিক মাপগণ্ডির বিচারেও কেউ কেউ দিল্লি সুলতানিকে কেন্দ্রীভূত এবং কেউ বা আবার বিকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করেছেন।