প্রশ্ন: জামিনের সংজ্ঞা দিন। জামিন মঞ্জুর কারী কর্তৃপক্ষ কারা? জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন মঞ্জুর কি বাধ্যতামূলক? আলোচনা করুন।

প্রশ্ন: জামিন মঞ্জুরের পূর্ব শর্ত কি কি? জামিন বাতিলের কারণগুলো লিখুন।

প্রশ্ন-কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আদালত বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে জামিন প্রদান করতে পারেন? আলোচনা করুন।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় জামিন একটি মৌলিক দিক যা অভিযুক্তের ন্যায্য বিচারের অধিকার নিশ্চিত করে। ব্যক্তির স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্যই  জামিনের সৃষ্টি হয়েছে। কোন অপরাধে অভিযুক্ত হলে ব্যক্তিকে কোনক্রমেই দোষী বলা যায় না। খুব গুরুতর অবস্থা না হলে ঐ মানুষটির স্বাধীনতা নষ্ট করা উচিত নয়। আইনের চোখে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী নয়, এবং যেহেতু তিনি আসামী, সেহেতু তাকে আদালতে বারবার আসতে হয়। আসামী যাতে আদালতের আদেশ মত নির্দিষ্ট স্থানে এবং নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির হন সেজন্য জামিনের ব্যবস্থা।  যুক্তিসঙ্গত, ন্যায্য ও ন্যায্য পদ্ধতিঅর্থাৎ আইন অনুযায়ী ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে তার  জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হবে না। [গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩২] জামিন(Bail) এমন একটি প্রক্রিয়া যা আসামিদের কোনো অযৌক্তিক সুবিধা না দিয়ে তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। 

জামিন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Bail শব্দটি old French শব্দ “Bailer”(give/deliver) থেকে উদ্ভব হয়েছে (Webster’s Dictionary, 1938)। সাধারণত আইনানুগ আটক থেকে ব্যক্তিকে বিচার না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি দেওয়াকে জামিন বলে। 

জামিনঃ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে শর্তাধিনে সাময়িক সময়ের জন্য মুক্তি প্রদান করে অথবা গ্রেফতারযোগ্য ব্যক্তিকে শর্তাধিনে সাময়িক সময়ের জন্য গ্রেফতার না করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে আদালত বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আদেশনামার মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক চলাচল অব্যাহত রাখাকে জামিন বলে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৭(২), ৫৯(৩), ১৬৯, ১৭০, ৪৯৬, ৪৯৭(২) ধারা।


কোন ব্যক্তিকে আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখে হাজিরের শর্তে পুলিশ বা আদালতের এখতিয়ার থেকে জামিনদারের হাতে সমর্পণকে ‘জামিন’ বলে। জামিনের শর্তানুসারে জামিনপ্রাপ্ত আসামী আদালতের নির্দেশক্রমে নির্দিষ্ট আদালতে, নির্দিষ্ট তারিখে ও সময়ে হাজির হতে বাধ্য থাকবেন। আসামী এতে ব্যর্থ হলে জামিন বাতিল হবে এবং জামিনদার আদালত বরাবরে একটি নির্ধারিত অংকের টাকা জমা দিতে বাধ্য থাকবেন। জামিন প্রদানের সময় জামিন প্রার্থিত ব্যক্তির অপরাধের অভিযোগ জামিনযোগ্য না জামিন অযোগ্য সেটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। জামিনযোগ্য এবং জামিনের অযোগ্য অপরাধ গুলো কি তা ফৌজদারী কার্যবিধিতে বলা হয়েছে।

জামিন প্রদানের বিবেচনায় অপরাধের শ্রেণীবিভাগ:


জামিন প্রদানের বিবেচনায় অপরাধকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যথা-

১। জামিনযোগ্য অপরাধ (Bailable offences) এবং

২। জামিন অযোগ্য অপরাধ (Non-bailable offences)।


জামিনযোগ্য অপরাধ 

(Bailable offences) 

ফৌজদারী কার্যবিধির ৪ (খ) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘জামিনযোগ্য অপরাধ’ হলো সেই সকল অপরাধ যা ফৌজদারী কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে জামিনযোগ্য বলে দেখানো হয়েছে অথবা যা বর্তমানে বলবৎ অন্য কোন আইন দ্বারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত আসামী অধিকার হিসেবে জামিনে মুক্তি দাবি করতে পারে। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর সম্পর্কে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় বলা হয়েছে।

জামিন অযোগ্য অপরাধ 

(Non-bailable offences) 


ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জামিন অযোগ্য অপরাধ’ বলতে এমন ধরণের অপরাধকে বুঝাবে, যে অপরাধের জন্য জামিন প্রদান করা যায় না। এ সকল অপরাধগুলো গুরুতর প্রকৃতির(serious in nature)। এ ধরণের অপরাধগুলোকে ফৌজদারী কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে জামিন অযোগ্য বলে দেখানো হয়েছে। জামিন অযোগ্য বা অ-জামিনযোগ্য অপরাধে অপরাধী আসামী অধিকার হিসেবে জামিনে মুক্তি দাবি করতে পারেন না। এজন্য অ- জামিনযোগ্য অপরাধের জন্য আদালত আসামীকে জামিন মঞ্জুর করতে পারেন  আবার না-মঞ্জুরও করতে পারেন। এটি আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা(discretionary power) ।

জামিন মঞ্জুরের পূর্বশর্ত

Pre-condition for grant of bail

(In what cases bail to be taken)


ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ ধারার বিধান অনুযায়ী জামিন মঞ্জুরের আবেদন বিবেচনায়  বিবেচনায় নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিম্নবর্ণিত তিনটি পূর্বশর্ত(Pre-condition) অবশ্যই পূরণ করতে হবে-

১) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জামিনযোগ্য অপরাধে(Bailable offences) অভিযুক্ত থাকবেন।

২) জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে  গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই কোন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গ্রেফতার/আটক(arrested/detained)রেখেছেন কিংবা আদালতে হাজির করেছেন। 


৩) জামিন মঞ্জুরের আবেদন যিনি করেছেন তাকে হেফাজতে থাকাকালে বা আদালতের চলমান কার্যধারার যে কোন পর্যায়ে  জামানত(sureties) দিতে হবে।


তাছাড়া, জামিন মঞ্জুরের আবেদনকারি (অভিযুক্ত ব্যক্তি) কোনভাবেই বিচার কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে না-এমন শর্তেই আদালত জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। 

জামিন মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ

 

জামিন মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারা মোতাবেক জামিন মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হলেন হাইকোর্ট বিভাগ, দায়রা আদালত ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ৪৯৮ ধারা মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগ ও দায়রা আদালত গ্রেফতারের পূর্বেই জামিনের আবেদন গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারেন।


একজন পুলিশ অফিসার ফৌজদারী কার্যবিধির৫৭(২), ৫৯(৩), ১৬৯, ১৭০, ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারার অধীনে আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যতিরেকে আসামীকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন প্রদানঃ জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য জামিন হচ্ছে অধিকার, কোন অনুকম্পা নয়। অপরাধ জামিনযোগ্য ধারার হলে ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের নিকট আসামীর অপরাধ গুরুতর মনে হলেও শাস্তি হিসাবে জামিন অস্বীকার করা উচিত নয়। কিন্তু জামিন মঞ্জুর বাধ্যতামূলক নয়।

আসামী জামিনে গেলে যদি সাক্ষীদের ভয় দেখানোর সম্ভাবনা থাকে বা তদন্ত কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থাকে অথবা আসামী জামিনদারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট জামিনের আবেদন না-মঞ্জুর করতে পারেন।

জামিন বাতিলের কারণ

Grounds for cancellation of Bail

অথবা,

জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী বা ব্যক্তিকে পুনরায় গ্রেফতার 

Re-arrest of accused or person released on bail


জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী বা ব্যক্তিকে যে কারণে  মঞ্জুরীকৃত জামিন বাতিল করে পুনরায় গ্রেফতার করা যায় তা  নিচে আলোচনা করা হলো—

১. ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১২৪(৬) ধারানুযায়ী মুচলেকা দিতে ব্যর্থ(যখন উপ-ধারা (৫) এর অধীনে শর্তসাপেক্ষ আদেশ বাতিল) এমন ব্যক্তিকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির আদেশ দেবার পর মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি উক্ত শর্তভঙ্গ করলে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা যাবে এবং পরে তাকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে হাজির করতে হবে।।( মূল বিধান– 124(6).When a conditional order of discharge has been canceled under sub-section (5), such person may be arrested by any police-officer without warrant, and shall thereupon be produced before the District Magistrate) 

২. ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৪০১ (৩) এবং পিআরবি ২৮৬ নিয়মানুযায়ী কোন দণ্ডিত ব্যক্তির দন্ড যেই শর্তে স্থগিত বা মওকুফ করা হয়েছে উক্ত শর্ত পালন না করলে সরকার উক্ত স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করার পর উক্তব্যক্তি মুক্ত থাকলে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা যাবে।  (মূল বিধান– 401(3). If any condition on which a sentence has been suspended or remitted is, in the opinion of the Government not fulfilled, the Government may cancel the suspension or remission, and thereupon the person in whose favour the sentence has been suspended or remitted may, if at large, be arrested by any police-officer without warrant and …..)


৩. ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৪৯৭ (৫) ধারানুযায়ী জামিনে মুক্ত ব্যক্তিকে পুনরায় গ্রেফতার করা যাবে।(মূল বিধান–497(5).The High Court Division or Court of Session and, in the case of a person released by itself, any other Court may cause any person who has been released under this section to be arrested and may commit him to custody.)

৪. ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫০১ ধারানুযায়ী জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত জামানত(sureties) যদি ভুল, জালিয়াতি বা অন্য কোন কারণে অপর্যাপ্ত হয়,বিবেচনামূলক ক্ষমতা ভুলভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে জামিন মঞ্জুর করা হয় তবে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা যাবে। (মূল বিধান– 501. If, through mistake, fraud or otherwise, insufficient sureties have been accepted, or if they afterwards become insufficient, the Court may issue a warrant of arrest directing that the person released on bail be brought before it and may order him to find sufficient sureties, and, on his failing so to do, may commit him to jail.)


৫. ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫০২ ধারানুযায়ী জামিনে মুক্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির জামিনদার কর্তৃক বন্ড বাতিলের আবেদন অর্থাৎ Discharge of sureties এর পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে পুনরায় গ্রেফতার করা যাবে।


৬. জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি পুনরায় একই অপরাধ করে কিংবা মামলার তদন্ত কার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে অথবা সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্টের চেষ্টা করে কিংবা বিদেশে পলায়ন/আত্মগোপন/জামিনদারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে(Possibility of the accused absconding) অথবা তদন্তকারী অফিসার বা সাক্ষীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করলে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারানুযায়ী জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা আদালতে বা যেই আদালত জামিনে মুক্তি দিয়েছেন সেই আদালত পুনরায় গ্রেফতারের আদেশ দিতে পারেন। মোটকথা আপনি যদি জামিনে থাকাকালীন জামিনের শর্ত ভঙ্গ বা অপব্যবহার(actual misuse of bail) করেন তবে আপনার  জামিন বাতিল এবং পুনরায় গ্রেফতার হতে পারেন।

আরো পড়তে আমাদের অন্য ব্লগগুলোতে চোখ রাখুন……। ধন্যবাদ

জামিনের দরখাস্ত দাখিল সংক্রান্ত আইনের বিধানাবলী উল্লেখ করুন(Bail : an overview)  

জামিন ও জামিননামা বলিতে কি বুঝেন? জামিনযােগ্য অপরাধ এবং জামিন অযােগ্য অপরাধ বলিতে কি বুঝেন? কোন অপরাধ জামিনযােগ্য এবং কোন অপরাধ জামিন অযােগ্য তা কিভাবে নির্ধারণ করিবেন- আলোচনা করুন।

 জামিনের সংজ্ঞা দিন। জামিন মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ কে?