প্রশ্নঃ জামিনের অর্থ ব্যাখ্যাপূর্বক জামিন সংক্রান্ত আইনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আলোচনা কর। জামিন বাতিলের ক্ষেত্রে কোন নীতিগুলো আদালতের বিবেচনা করা উচিত?

Explain the meaning of bail and discuss the basic philosophy underlying the law relating to bail. What principles should the court follow, while canceling the bail?

উত্তরঃ জামিনের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ফৌজদারী কার্যবিধিতে দেয়া হয়নি, তবে জামিন সংক্রান্ত আইন এতে রয়েছে। সাধারণত জামিন বলতে সংশ্লিষ্ট আদালতে সময় মত হাজির করার শর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে আইনগত হেফাজত হতে মুক্তি প্রদান করে জামিনদারের নিকট সমর্পণ করা বুঝায়। Wood roffe এর ভাষায়, “Bail is the release of the accused from custody of the officers of law and entrusting of the accused to the private custody of the persons called his ‘bail’ who then become bound as sureties to produce him to answer the charge at a stipulated time or date.”

কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ থাকলেই তাকে দোষী বলা যায় না। আদালতে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ ধরতে হবে এটাই হচ্ছে আইনের একটি নীতি। তাই বিচারে দোষী প্রমাণিত হবার পূর্বে অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক রাখা হলে তা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হবে। এছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি আটক থাকলে তার মানসিক কষ্ট ছাড়াও শারীরিক, পারিবারিক, সামাজিক ও বহুবিধ সমস্যা হতে পারে। তাই অহেতুক তাকে আটক রাখা আইনে সমর্থনীয় নয়। আবার বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আদালতে থাকা প্রয়োজন। বিচারের সময় তার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করার জন্য ফৌজদারী কার্যবিধিতে জামিনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। আসামীর পক্ষে এক বা একাধিক ব্যক্তি একটা মুচলেকা প্রদান করেন এবং নির্দিষ্ট তারিখে ও সময়ে নির্দিষ্ট আদালতে আসামীকে হাজির করার প্রতিশ্রুতি দেন। এতে ব্যর্থ হলে জামিনদার একটি নির্ধারিত অঙ্কের টাকা আদালতে জমা দিতে বাধ্য থাকেন।

মুল বিচারকার্য চলার সময়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি সশরীরে আদালতে উপস্থিত থাকবেন তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন। এ লক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তির বয়স, সামাজিক অবস্থান শারিরিক ও মানসিক অবস্থা এবং অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করা প্রয়োজন। একজন যুবক অতি সহজেই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারে যা একজন বৃদ্ধ লোকের জন্য সহজসাধ্য নয়, সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আটক রাখলে তার পারিবারিক বা ব্যবসায়-কিংবা অফিস সংক্রান্ত কাজকর্মে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, সর্বোপরি সয়-সম্পত্তি, বাড়ি, ব্যবসা বা অফিস ছেড়ে দিয়ে গোপনে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে কিন্তু একজন রাস্তার লোক যার সংসার বা ব্যবসা-বানিজ্য, সয়-সম্পত্তি কিছু নেই অর্থাৎ যার কোন পিছু টান নেই সেরূপ ব্যক্তির পালিয়ে যাবার আশংকা তুলনামুলকভাবে বেশি। একইভাবে শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তির এরুপভাবে সক্ষম ব্যক্তির তুলনায় আত্মগোপন করা বা দেশ থেকে পালিয়ে যাবার আশংকা তুলনামুলকভাবে কম থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিযোগের গুরুত্ব। মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন করাদন্ড দন্ডিত হতে পারে এরূপ অভিযোগ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে জামিনের বিষয়ে আদালতের নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করা উচিত যতক্ষন না বিপরীত মর্মে কোন কিছু প্রকাশ পায়৷

জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামীর একটা ‘আইনগত অধিকার। এটা আদালতের অনুকম্পা বা দয়া নয়। এ সম্পর্কে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ ধারায় বিধান রয়েছে।

যে সকল ক্ষেত্রে আসামী জামিনদার দিতে ব্যর্থ হয় এবং যে সকল ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশ রয়েছে সে সকল ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে আসামী জামিনে মুক্তি পেতে আইনত হকদার এবং আদালত কোনক্রমেই তাকে জামিনে মুক্তি দিতে অস্বীকার করতে পারেন না।

জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন সম্পর্কে বিধান রয়েছে ৪৯৭ ধারায়। এখানে বলা হয়েছে যে, জামিনের অযোগ্য অপরাধে কোন ব্যক্তি গ্রেফতার হলে বা কোন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক বিনা পরোয়ানায় আটক রাখা হলে কিংবা আদালতে হাজির হলে বা হাজির করা হলে তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবার মত অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে তাকে উক্ত রূপে মুক্তি দেয়া যাবে না।

তবে এরূপ অপরাধের ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৬ বছরের কম বয়ষ্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত বা অক্ষম হলে তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া যেতে পারে।

এই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে যে, তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচারের কোন পর্যায়ে যদি প্রতীয়মান হয় যে, আসামী জামিনের অযোগ্য কোন অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই; তবে অপরাধ সম্পর্কে আরো অনুসন্ধানের পর্যাপ্ত হেতু রয়েছে তাহলে এরূপ অনুসন্ধান সাপেক্ষে আসামীকে জামিনে অথবা জামিনদার ব্যতীত ব্যক্তিগত মুচলেকা সম্পাদনের মাধ্যমে মুক্তি দিতেহবে।

৪ উপধারায় আরো বলা হয়েছে যে, জামিনের অযোগ্য কোন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার সমাপ্ত হওয়ার পর এবং রায়দানের পূর্বে কোন সময় আদালত যদি মনে করেন যে, আসামী উক্ত অপরাধে দোষী নয় বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, তাহলে আসামী হাজতে থাকলে রায় শোনার উদ্দেশ্যে হাজির হওয়ার জন্য জামিনদার ব্যতীত মুচলেকা সম্পাদনের পর আদালত তাকে মুক্তি দিবেন।

জামিনের অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করার বিষয় আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাভূক্ত । কিন্তু যথাযথ সাবধানতা ও সতর্কতার সাথে এবং ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। যদি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের যোগ্য অপরাধে আসামী অভিযুক্ত না হয় তবে জামিন মঞ্জুর করাই হচ্ছে সাধারণ বিধি, মঞ্জুর না করাই হচ্ছে একটা ব্যতিক্রম এবং এজন্য কারণ লিপিবদ্ধ করতে হয়।

জামিন বাতিলের ক্ষেত্রে যে সকল নীতিমালা বিবেচনা করা উচিত। নিম্ন বর্ণিত ক্ষেত্রে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন বাতিল করে জেল হাজতে পাঠানো যায়ঃ

(১) বিচারাধীন থাকা অবস্থায় বা যে অপরাধের জন্য শাস্তি ভোগ করছে সে অবস্থায় আসামী যদি আবার সে অপরাধ সংগঠন করে।

(২) জামিনে গিয়ে যদি তদন্ত কার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

(৩) আসামী যদি সাক্ষ্য বিনষ্ট করার পায়তারা করে। 

(৪) আসামী যদি জামিনদারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়৷

(৫) আসামী যদি হুলিয়া বা সাক্ষীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কোন কাজ করে।

এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের বিচারিক সিদ্ধান্তে নিমোক্ত ক্ষেত্রে জামিন বাতিল করা হয়েছে। এক আদালত কর্তৃক জামিন মঞ্জচুর হবার পর পরবর্তীতে অন্য আদালতে মামলার শুনানী হলে পূর্ববর্তী আদালত জামিন বাতিল করেছেন (৪১ বোম্ভে ৫৪৯)।