জামিন ও জামিননামা বলিতে কি বুঝেন? জামিনযােগ্য অপরাধ এবং জামিন অযােগ্য অপরাধ বলিতে কি বুঝেন? কোন অপরাধ জামিনযােগ্য এবং কোন অপরাধ জামিন অযােগ্য তা কিভাবে নির্ধারণ করিবেন- আলোচনা করুন।

অথবা,

জামিনের দরখাস্ত দাখিল সংক্রান্ত আইনের বিধানবলী উল্লেখ করুন। 

অথবা,

ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭ ও ৪৯৮ ধারাগুলি জামিন সংক্রান্ত বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির বিধানমতে কোন কোন অবস্থায় জামিন লাভ করা যায় বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে জামিন(bail) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিনা  বিচারে কোন ব্যক্তিকে আটক রাখা যাবে না এই নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জামিন অপরাধীর ক্ষেত্রে একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ফৌজদারী কার্যবিধিতে জামিন সংক্রান্ত বিধান আলােচনা করা হয়েছে।

জামিন (bail)

ফৌজদারী কার্যবিধিতে জামিনের কোন সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। সাধারণ অর্থে পুলিশের হেফাজত হতে মুক্তি দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট দিনে এবং সময়ে আদালতে হাজির হওয়ার শর্তে জামিনদারের নিকট সমর্পণ করাকেই জামিন বলে। জামিন (bail) অভিব্যক্তিটির মৌলিক ধারণা হলো যেকোন ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজত হতে প্রতিশ্রুতিদাতা বা জামিনদারের হাতে অর্পণ এবং উক্ত প্রতিশ্রুতিদাতা এমন ব্যক্তি যিনি আদালত  যখনই প্রয়ােজন মনে করেন তখনই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

জামিন সংক্রান্ত সাধারণ কিছু ধারণা: 

জামিনের ২ (দুটি) শর্ত।

১। জামিননামা (bail bond) 

২। জামিনদার (Surety)

জামিননামা (bail bond)

জামিননামা হলাে আদালতে রাখা একটি নির্ধারিত ফরম । ফৌজদারী কার্যবিধির ১৮৯৮ এর প্রথম তফসিলে ক্রমানুসারে ৪২ নম্বর নির্ধারিত (মুচলেকা) ফরমটি সম্পাদন করতে হয়। এই ফরমটি জামিননামা(bail bond) নামে পরিচিত। যে ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় সেই ব্যক্তি এটা পূরণ করে সম্পাদন করে। জামিননামাটি নির্ধারিত ফরম অনুযায়ী সম্পাদন করা না হলে, যে ব্যক্তি এটা সম্পাদন করছে তার কোন দায় তৈরী হবে না। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে জামিনে বা তার নিজের বজে মুক্তি দেওয়ার পূর্বে উক্ত ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তা বা আদালত যেরুপ। আশখাব মনে করেন সেইরুপ পরিমাণ অর্থের জন্য একটি মুচলেকা সম্পাদন করবে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৯ ধারায় আদালত বা পুলিশ জামিনের জন্য অর্থ নির্ধারণ করে তা জামিননামায় উল্লেখ করতে হবে।

জামিনদার (Surety):

জামিনদার হলাে এমন ব্যক্তি যে জামিননামায় স্বাক্ষর করে এই শর্তে যে, যে ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে সে যদি জামিনের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয় বা হাজির না হয় তাহলে জামিনদার জামিননামায় উল্লেখিত অর্থ পরিশােধ করবে ।

জামিন সংক্রান্ত অন্যান্য বিধানসমূহ

ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ থেকে ৫০২ ধারায় জামিন সংক্রান্ত বিধান আলােচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৯৬, ৪৯৭ এবং ৪৯৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধে কখন জামিন দেওয়া যায় এবং কখন জামিন দেওয়া যাবে না তা আলােকপাত করা হয়েছে। এই দিক হতে জামিনকে নিম্নলিখিত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১। জামিনযােগ্য অপরাধে জামিন। 

২। জামিনঅযােগ্য অপরাধে জামিন

৩। আগাম জামিন।

নিচে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে।

জামিনযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন

ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(খ) জামিনযােগ্য অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। জামিনযােগ্য অপরাধ বলতে ফৌজদারী কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে জামিনযােগ্য অপরাধ বলে উলেখিত অপরাধসমূহ এবং বর্তমানে কার্যকর কোন আইন কর্তৃক জামিনযােগ্য করা হয়েছে এমন কোন অপরাধ। জামিনযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত বা পুলিশ কখন জামিন দিতে পারে তা ৪৯৬ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। ৪৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি জামিনযােগ্য অপরাধে আটক হলে অথবা তাকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক করা হলে বা সে আদালতে হাজির হলে বা তাকে হাজির করা হলে, সে যদি উক্ত কর্মকর্তার হেফাজতে থাকার সময় বা উক্ত আদালতের কার্যধারার কোন পর্যায়ে জামিন দিতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে আটককৃত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে।

 ৪৯৬ ধারায় শুধুমাত্র জামিনযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে এবং যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ  হেফাজতে থাকে বা আটক থাকে তাহলে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে। যে ব্যক্তি স্বাধীন অর্থাৎ যাকে আটক করা হয়নি তাকে ৪৯৬ ধারায় জামিনে মুক্তি দেওয়া যায় না। কারণ জামিনে মুক্তি অর্থ হলাে পুলিশ হেফাজত হতে মুক্তি দিয়ে অভিযুক্তকে জামিনদারের নিকট অর্পণ করা। ৪৯৬ ধারায় জামিনযােগ্য অপরাধে জামিন পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনগত অধিকার এবং জামিনযােগ্য অপরাধে জামিন দেওয়া আদালতের জন্য আদেশসূচক। অর্থাৎ ৪৯৬ ধারায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং আদালত উভয় আটককৃত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে জামানত গ্রহণ করে বা জামানত গ্রহণের পরিবর্তে হাজির হওয়ার নিমিত্তে জামিনদার ব্যতীত আটকৃত ব্যক্তি মুচলেকা সম্পাদন করলে, তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে। শর্তের দিক হতে এই ধারা আদেশমূলক এবং আদালত এর বিধিবিধান পালনে বাধ্য। জামিনযােগ্য প্রত্যেকটি অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন একটি অধিকার, অনুগ্রহ নহে। ৪৯৬ ধারায় সন্তোষজনক জামানতের শর্তে জামিনযােগ্য অপরাধগুলােতে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাবার অপরাজেয় অধিকার আছে।

২। জামিনঅযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন

(Bail in non bailable offence)

ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(খ) ধারা অনুযায়ী দ্বিতীয় তফসিলে উল্লেখিত জামিনযােগ্য অপরাধ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ জামিনঅযােগ্য। ৪৯৭ ধারায় কখন জামিনঅযােগ্য অপরাধে জামিন মঞ্জুর করা যায় তা আলােচনা করা হয়েছে। ৪৯৭ ধারায়। জামিনঅযােগ্য অপরাধে জামিন পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনগত অধিকার না বরং জামিন অযােগ্য অপরাধে জামিন দেওয়া আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (Discretionary Power) | আদালত ইচ্ছা করলে জামিন দিতে পারে আবার। নাও দিতে পারে । 

Captain (Retd) Nurul Huda vs State;55 DLR (AD) 33 মামলায় বলা হয়েছে, জামিন মঞ্জুর করা আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা এবং আদালত তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারে যদি মামলার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আদালত সন্তুষ্ট হয় যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করা সম্ভব হবে না। ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি জামিনঅযােগ্য অপরাধে আটক হলে অথবা তাকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্তৃক ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক করা হলে বা আদালতে হাজির হলে বা তাকে হাজির করা হলে, তাকে জামিনে মুক্তি প্রদান করা যেতে পারে (may be released on bail).

কিন্তু জামিন অযােগ্য অপরাধে আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিবে না। (shall not be released on bail) যদি সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডণীয় কোন অপরাধে অপরাধী বলে বিশ্বাস করার আদালতের যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে। অর্থাৎ মত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডণীয় কোন অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন দেওয়া আদালতের জন্য আদেশসূচক (imperative).

রাষ্ট্র বনাম ফয়সাল আলম আনসারী মামলায় হাইকোর্ট বিভাগে জামিন আবেদনে। আদালত দেখে যে প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে অভিযুক্ত ব্যক্তির খুন করার সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় ছিল  পুলিশ তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় অভিযােগপত্র দাখিল করেছে এবং মামলার প্রতিবেদন ইতােমধ্যে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট বিচারের জন্য পাঠানাে হয়েছে এবং পরবর্তী শুনানীর দিন নির্ধারিত হয়েছে ১৯-১১-২০০০। এই প্রেক্ষাপটে মহামান্য হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত প্রদান করে যে, উপরে উল্লেখিত বিষয় এবং প্রেক্ষাপটে আদালত জামিন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে তার বিচারিক স্বেচ্ছাধীন  ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারে না। 

ক্যাপটেন (অব:) নুরুল হুদা বনাম রাষ্ট্র, মামলায় বলা হয়েছে জামিন মঞ্জুর করা বা প্রত্যাখ্যান করা প্রত্যেকটি মামলার বিশেষ প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে এবং অপরাধী মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে শাস্তিযােগ্য শুধুমাত্র এই কারণে জামিন প্রত্যাখ্যান করা পর্যাপ্ত কারণ না। অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডণীয় শাস্তিযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে মামলার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আদালত জামিন দিতে পারে। যেমন, ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে জামিন অযােগ্য অপরাধের (যেকোন শাস্তিযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে) আদালত নিম্ন লিখিত অভিযুক্তদের জামিন দিতে পারবে, যদি

১) তার বয়স ১৬ বছরের নিচে হয়। 

২) স্ত্রী লােক হয়।

৩) পীড়িত বা অক্ষম লােক হয় । 

একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যার বয়স ১৬ বছরের নিচে না বা কোন মহিলা বা কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া যায় না যদি বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে যে সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডণীয় অপরাধ করেছে।

৫টি ক্ষেত্রে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হযেছে তার জামিন বাতিল করে জেলে পাঠানাে যায়।

১) জামিনের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি তাকে যে অপরাধে বিচার করা হচ্ছে সে একই অপরাধ করেছে; 

২) যদি সে তদন্ত বাধাগ্রস্থ করে; 

৩) যদি সে সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট করে;

৪) যদি সে বিদেশে চলে যায় বা জামিনদারের এখতিয়ারের বাইরে চলে  যায়;

 ৫) যদি সে প্রতিশােধের জন্য সংঘাত করে।

৩। আগাম জামিন (Anticipatory bail)

ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এ আগাম জামিন সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট বিধান করা হয় নি। ৪৯৮ ধারায় হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা আদালতকে জামিন মঞ্জুরের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু সে ক্ষমতা বিচার বিবেচনার সাথে প্রয়ােগ করতে হবে। শুধুমাত্র ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় আগাম জামিনের আবেদন করা যায়, অন্যকোন ধারায় জামিনের আবেদন করা না। আগাম জামিন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা আদালতের একই ক্ষমতা আছে। গুরুবিকাশ সিং সিভা বনাম স্টেট অব পাঞ্জাব, মামলায় বলা হয়েছে, ৪৯৮ ধারায় জামিনের যে সুযােগ দেওয়া হয়েছে তা সাধারণত আগাম জামিন নামে পরিচিত যে অভিব্যক্তিটি সর্ব প্রথম ভারতীয় আইন কমিশন তার ৪১তম প্রতিবেদনে ব্যবহার করেছিল।

জামিনের আদেশ এবং আগাম জামিনের আদেশের মধ্যে পার্থক্য হলাে জামিনের। আদেশ অভিযুক্তকে আটকের পরে মঞ্জুর করা হয় এবং জামিনের আদেশ বলতে বােঝায় পুলিশ হেফাজত হতে আটককৃত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া। অন্যদিকে আগাম জামিন আটকের আগে মঞ্জুর করা হয়। অন্য কথায় বলা যায় এটা হলাে আটক পূর্ব আইনগত কার্যপদ্ধতি যা নির্দেশ প্রদান করে যে, যে ব্যক্তির অনুকূলে এই আদেশ মঞ্জুর করা হয়েছে, সেই ব্যক্তিকে যে ক্ষেত্রে বা অভিযােগের জন্য এই আদেশ প্রদান করা হয়েছে সেই অভিযােগে আটক করা হলে, তাকে জামিনে মুক্তি দিতে হবে। অর্থাৎ আগাম জামিনের আদেশ আটক হওয়ার সাথে সাথে কার্যকর হয়। পুলিশ রিপাের্ট জমা দেওয়ার পর , আগাম জামিন মঞ্জুর করার কোন সুযােগ নেই। অগ্রিম জামিন হাইকোর্ট কর্তৃক সচরাচর ব্যবহার করা হয়। আটকের আশংকা আছে এমন কোন ব্যক্তিকে আটকের আগে যখন জামিন দেওয়া হয় তখন তাকে আগাম জামিন (Anticipatory bail) বলে । জামিন অযােগ্য অপরাধে আটকের আশংকা আছে মনে করলে, কোন ব্যক্তি হাইকোর্টে বা দায়রা আদালতে জামিনের আবেদন করতে পারবে।

Draft…